ফিটনেসবিহীন-পুরোনো যানবাহন পরীক্ষা: সরকারের ব্যর্থতায় বাড়ছে বায়ুদূষণ

গাড়ি থেকে নির্গমিত বায়ু পরীক্ষা করার মতো সরঞ্জাম বিআরটিএর কাছে নেই বলে জানান বিশেষজ্ঞরা।
ফাইল ফটো

রাজধানী ঢাকার বাসিন্দারা উচ্চমাত্রার বায়ুদূষণের শিকার। এর মধ্যেই সরকারের কিছু সিদ্ধান্ত ও উদ্যোগহীনতা বায়ুদূষণের মাত্রা আরও বাড়িয়েছে এবং মানুষের জীবনকে ঝুঁকির মধ্যে ফেলছে।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, গত আগস্টে সরকার বাণিজ্যিক যানবাহনের আয়ুষ্কাল সীমিত করার সিদ্ধান্ত থেকে সরে আসে। এর ফলে বহু বছরের পুরোনো হাজারো গাড়ি সড়কে চলাচল অব্যাহত রাখার সুযোগ পায় এবং এসব যানবাহনের ইঞ্জিন আরও দূষণ সৃষ্টি করছে।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রসায়ন বিভাগের অধ্যাপক আবদুস সালাম দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, পুরোনো যানবাহন ও ত্রুটিপূর্ণ ইঞ্জিনই শহরের বায়ুদূষণের অন্যতম প্রধান কারণ।

এ ছাড়া গাড়ির নির্গমিত বায়ু পরীক্ষা করার মতো সরঞ্জাম বাংলাদেশ রোড ট্রান্সপোর্ট অথরিটির (বিআরটিএ) কাছে নেই বলেও জানান বিশেষজ্ঞরা।

পরিবহন খাত সংশ্লিষ্টরা বলছেন, ডিজেল ও পেট্রোলের চেয়ে সিএনজি (তরলীকৃত প্রাকৃতিক গ্যাস) কম দূষণকারী। কিন্তু সিএনজির দাম বৃদ্ধি ও এই জ্বালানি ব্যবহারে প্রণোদনার অভাবে সিএনজি ব্যবহারকারী যানবাহনের সংখ্যা কমছে।

এয়ার কোয়ালিটি ইনডেক্সের (একিউআই) তথ্য অনুযায়ী, বায়ুদূষণ স্বাস্থ্যের জন্য সবচেয়ে বড় পরিবেশগত ঝুঁকির মধ্যে একটি এবং দুই কোটিরও বেশি বাসিন্দার ঢাকা প্রায়শই সবচেয়ে খারাপ বায়ুমানের শহরগুলোর তালিকায় শীর্ষে থাকছে।

অধ্যাপক আবদুস সালাম বলেন, জ্বালানি অসম্পূর্ণভাবে জ্বলায় পুরোনো যানবাহনগুলো আরও বিষাক্ত গ্যাস নির্গত করে। গাড়িটি যত পুরোনো হবে, তত বেশি দূষণ সৃষ্টি করবে।

'আমরা যদি ঢাকার বায়ুদূষণ নিয়ন্ত্রণ করতে চাই, তাহলে ফিটনেসবিহীন ও পুরোনো যানবাহনের সংখ্যা কমাতে হবে', যোগ করেন তিনি।

ফিটনেসবিহীন-পুরোনো যানবাহন

বিআরটিএর তথ্য অনুযায়ী, ফিটনেস সার্টিফিকেটবিহীন যানবাহনের সংখ্যা বাড়ছে।

চলতি বছরের এপ্রিল পর্যন্ত প্রায় পাঁচ লাখ ৬৮ হাজার নিবন্ধিত যানবাহনের ফিটনেস সার্টিফিকেট ছিল না, যার অর্থ যানবাহনগুলো ফিটনেস পরীক্ষার মধ্য দিয়ে যায়নি। গত বছরের জানুয়ারিতে এই সংখ্যা ছিল পাঁচ লাখ আট হাজার।

পরিবহন খাতের অভ্যন্তরীণ সূত্রে জানা গেছে, দেশে হাজারো অনিবন্ধিত যানবাহন রয়েছে এবং সেসব যানবাহনের ফিটনেসের অবস্থা সম্পর্কে কর্তৃপক্ষের কোনো ধারণাই নেই।

তা ছাড়া বিআরটিএর ফিটনেস পরীক্ষাও প্রশ্নবিদ্ধ বলে মনে করেন পরিবহন বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক হাদিউজ্জামান। তার ভাষ্য, 'গাড়ির নির্দিষ্ট কিছু জিনিস যাচাই করার সরঞ্জামই বিআরটিএর কাছে নেই।'

স্বয়ংক্রিয়ভাবে গাড়ির ফিটনেস পরীক্ষা করার জন্য বিআরটিএর মাত্র একটি ভেহিক্যাল ইন্সপেকশন সেন্টার (ভিআইসি) রয়েছে এবং সেটিও পুরোপুরি কার্যকর নয়। ফলস্বরূপ ফিটনেস ক্লিয়ারেন্স দেওয়ার আগে প্রায় সব পরীক্ষা ম্যানুয়ালি করা হয়।

'কিন্তু বায়ু নির্গমন পরীক্ষা ম্যানুয়ালি করা যায় না। এর মানে তারা (বিআরটিএ) কোনো যানবাহনের দূষণ সৃষ্টির মাত্রা নির্ণয় করতে পারছে না', বলেন অধ্যাপক হাদিউজ্জামান।

চলতি বছরের মে মাসে সরকার ঘোষণা করে, দুর্ঘটনা ও দূষণ কমানোর লক্ষ্যে তারা বাসের আয়ুষ্কাল ২০ বছর এবং ট্রাক ও লরির আয়ুষ্কাল ২৫ বছর নির্ধারণ করেছে।

বিআরটিএর তথ্যে দেখা গেছে, এ বছরের এপ্রিল পর্যন্ত ৭৪ হাজারেরও বেশি নিবন্ধিত বাস, ট্রাক ও অন্যান্য বাণিজ্যিক যানবাহন তাদের অর্থনৈতিক আয়ুষ্কাল অতিক্রম করেছে এবং যানবাহনগুলো ধ্বংস করে ফেলার (ক্রাশিং) কথা ছিল।

কিন্তু পরিবহন সমিতিগুলোর চাপের মুখে সরকার এই উদ্যোগ থেকে সরে আসে।

অধ্যাপক হাদিউজ্জামান বলেন, অর্থনৈতিক আয়ুষ্কাল অতিক্রম করার পর একটি গাড়ির রক্ষণাবেক্ষণের ব্যয় বহুগুণ বেড়ে যায় এবং অনেক মালিক রক্ষণাবেক্ষণের জন্য প্রয়োজনীয় অর্থ ব্যয় করেন না।

'যে যানবাহনগুলো সঠিকভাবে রক্ষণাবেক্ষণ করা হয় না, সেগুলো আরও দূষণ সৃষ্টি করে। এই কারণেই পুরোনো যানবাহনের চলাচল বন্ধ না করার সিদ্ধান্ত দূষণ আরও বাড়িয়েছে। সুতরাং, নীতিনির্ধারকরা প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে শহরের বায়ুদূষণের জন্য দায়ী। হাজারো মানুষের স্বাস্থ্যঝুঁকির দায় তারা এড়াতে পারে না', বলেন তিনি।

সিএনজিচালিত যানবাহন কম

পরিবহন খাতের সংশ্লিষ্টরা বলছেন, গত কয়েক বছরে সিএনজিচালিত যানবাহন, বিশেষ করে বাস, মিনিবাস ও ট্রাকের সংখ্যা অনেক কমে গেছে।

বাংলাদেশ সিএনজি স্টেশন ওনার্স অ্যাসোসিয়েশনের সাধারণ সম্পাদক ফারহান নূর ডেইলি স্টারকে বলেন, পরিবেশের কথা বিবেচনা করে সরকারের উচিত সিএনজিচালিত যানবাহনকে উৎসাহিত করা। বিশেষ করে গণপরিবহনের জন্য (বাস-মিনিবাস) সিএনজির ব্যবহার উৎসাহিত করা উচিত।

সিএনজির ক্রমবর্ধমান দাম ও রিফিলিং স্টেশনগুলো প্রতিদিন পাঁচ ঘণ্টা বন্ধ রাখার সরকারি সিদ্ধান্তকে সিএনজির জনপ্রিয়তা হ্রাসের জন্য দায়ী করেন ফারহান।

রূপান্তরিত প্রাকৃতিক গ্যাস কোম্পানি লিমিটেডের (আরপিজিসিএল) তথ্য অনুযায়ী, চলতি বছরের মে মাস পর্যন্ত সিএনজি ব্যবহারের জন্য নিবন্ধিত গাড়ির সংখ্যা ছিল পাঁচ লাখ সাত হাজার। কিন্তু এখনো কয়টি যানবাহন জ্বালানি হিসেবে সিএনজি ব্যবহার করে, সেটি তারা জানে না।

তবে গত বছর বিআরটিএর তথ্য উদ্ধৃত করে জ্বালানি মন্ত্রণালয় জানায়, মাত্র দুই লাখ ৩৮ হাজার যানবাহন সিএনজি ব্যবহার করছে।

২০২১-২২ অর্থবছরে মাত্র ৬৪২টি যানবাহন সিএনজিতে রূপান্তরিত করা হয়েছে। আরপিজিসিএলের তথ্য অনুযায়ী, ২০১৪-১৫ সালে এই সংখ্যা ছিল ৩৭ হাজার ৩৬৮।

অনুমোদন পাওয়ার পরও কার্যক্রম শুরু না করায় আরপিজিসিএল ১২১টি সিএনজি রূপান্তর ওয়ার্কশপের নিবন্ধন বাতিল করেছে। সিএনজিচালিত গাড়ির সংখ্যা কমে যাওয়ার কারণে এই ওয়ার্কশপের কার্যক্রম আর শুরু করা হয়নি বলে সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন।

বিষয়টি নিয়ে জানতে চাইলে বিআরটিএ চেয়ারম্যান নুর মোহাম্মদ মজুমদার ডেইলি স্টারকে বলেন, বায়ুদূষণ রোধে বিআরটিএ ব্যবস্থা নিচ্ছে।

আগামী ১৯ অক্টোবর মিরপুরে বিআরটিএ কার্যালয়ে একটি ভিআইসি উদ্বোধন করা হবে বলে জানান তিনি।

তিনি আরও বলেন, 'বিআরটিএর বিভিন্ন কার্যালয়ে আরও আটটি ভিআইসি স্থাপনের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। আমরা আশা করছি, আগামী দুই-তিন বছরের মধ্যে এগুলো চালু হবে।'

পর্যায়ক্রমে দেশের প্রতিটি বিআরটিএ অফিসে একটি করে ভিআইসি থাকবে বলেও উল্লেখ করেন তিনি।

নুর মোহাম্মদ মজুমদার বলেন, 'পরিবেশ অধিদপ্তরের কাছ থেকে যানবাহনের বায়ু নির্গমন পরীক্ষার সরঞ্জাম চেয়েছিল বিআরটিএ। তাদের কাছ থেকে কোনো উত্তর না পাওয়ায় আমরা নিজেরাই সেই সরঞ্জাম কেনার সিদ্ধান্ত নিয়েছি।'

খালি চোখে যেসব যানবাহন থেকে কালো ধোঁয়া নির্গত হতে দেখা যায়, বিআরটিএর ভ্রাম্যমাণ আদালত এখন তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিচ্ছে বলে জানান তিনি।

ফিটনেস পরীক্ষা না করা যানবাহনের সংখ্যা কেন বাড়ছে, জানতে চাইলে বিআরটিএ চেয়ারম্যান বলেন, আমাদের ধারণা, ফিটনেস কাগজপত্র ছাড়া যেসব যানবাহন রয়েছে, তার এক-তৃতীয়াংশ এখন আর সড়কে চলাচল করছে না।

এ জন্য বিআরটিএ তাদের তথ্য হালনাগাদ করছে উল্লেখ করে তিনি বলেন, ফিটনেস সার্টিফিকেটবিহীন যানবাহনকে নিয়মিত জরিমানা করা হয়।

বাণিজ্যিক যানবাহনের আয়ুষ্কাল সীমিত করার সিদ্ধান্ত কেন পরিবর্তন করা হলো, জানতে চাইলে বিআরটিএ চেয়ারম্যান বলেন, 'পরিবহন মালিকরা ধারণা করেছিলেন যে, আয়ুষ্কাল নির্ধারণ করা হলে যানবাহনের সংকট দেখা দেবে।'

বাণিজ্যিক যানবাহনের অর্থনৈতিক আয়ুষ্কাল কীভাবে নির্ধারণ করা যায়—স্টেকহোল্ডারদের সঙ্গে আলোচনা করে সে বিষয়ে সুপারিশ করার জন্য বিআরটিএ চেয়ারম্যানের নেতৃত্বে একটি কমিটি গঠন করেছে সড়ক পরিবহন ও মহাসড়ক বিভাগ।

'কমিটি ইতোমধ্যে একটি সভা করেছে এবং আমরা শিগগিরই আমাদের মতামত জানাব', যোগ করেন নুর মোহাম্মদ মজুমদার।

Comments