‘মনজুর আহমেদকে সরিয়ে প্রভাবশালী, দখলদারদের সুরক্ষা দিল সরকার’

‘এটা জনস্বার্থে? নাকি যারা দখলদার, দূষণকারী, প্রভাবশালী তাদের স্বার্থে?’

নদী দখল নিয়ে মন্ত্রী-মেয়রসহ প্রভাবশালীদের বিরুদ্ধে অবস্থান নেওয়া জাতীয় নদী রক্ষা কমিশনের মনজুর আহমেদ চৌধুরীকে 'জনস্বার্থে' মেয়াদ শেষ হওয়ার আগেই চেয়ারম্যানের পদ থেকে সরিয়ে দেওয়ার সরকারি সিদ্ধান্তের তীব্র সমালোচনা করেছেন বিশিষ্টজনরা।

তারা বলছেন, এর মাধ্যমে সরকার দখলদারদেরই স্বার্থ রক্ষা করল, সুরক্ষা দিল। সেইসঙ্গে এটাও প্রমাণিত হলো—যারা দুর্নীতি-দখলদারি নিয়ে কথা বলে, প্রভাবশালীদের বিরুদ্ধে অবস্থান নেয়, তাদের সুরক্ষার ব্যাপারে সরকার আন্তরিক নয়। এটা খুবই শঙ্কাজনক। এভাবে রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতাতেই দুর্নীতি অনেক বাড়ছে।

বুধবার জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের এক প্রজ্ঞাপনে মেয়াদ শেষ হওয়ার দেড় বছর আগেই মনজুর আহমেদের চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ বাতিলের কথা জানানো হয়।

এর আগে ২৪ সেপ্টেম্বর বিশ্ব নদী দিবস উপলক্ষে আয়োজিত অনুষ্ঠানে মনজুর আহমেদ সরাসরি নাম না উল্লেখ করে বর্তমান শিক্ষামন্ত্রী দীপু মনির সমালোচনা করেছিলেন। বলেছিলেন, মেঘনা নদী থেকে অবৈধভাবে যারা বালু উত্তোলন করছেন, তাদের সঙ্গে চাঁদপুরের একজন নারী মন্ত্রীর সম্পর্ক আছে।

মেঘনা নদী থেকে নির্বিচারে বালু উত্তোলনকারীদের 'হায়েনার' সঙ্গে তুলনা করে মনজুর আহমেদ আরও বলেছিলেন, এদের থেকে নদীকে রক্ষা করা যাচ্ছে না।

এরও আগে ২০২২ সালে বিশ্ব নদী দিবসে ঢাকার খাল ও আশপাশের নদী রক্ষায় কার্যকর উদ্যোগ না নেওয়ায় উত্তর সিটি করপোরেশনের মেয়র আতিকুল ইসলাম ও ঢাকা ওয়াসার এমডি তাকসিম এ খানকে মোবাইল কোর্টের (ভ্রাম্যমাণ আদালত) মাধ্যমে বিচার করে কারাগারে পাঠানোর কথা বলেছিলেন মনজুর আহমেদ চৌধুরী।

বিষয়টি নিয়ে দ্য ডেইলি স্টার কথা বলেছে সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা সুলতানা কামাল, সাবেক মন্ত্রিপরিষদ সচিব আলী ইমাম মজুমদার এবং ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের (টিআইবি) নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামানের সঙ্গে।

সুলতানা কামাল বলেন, 'এটা (মনজুর আহমেদকে সরিয়ে দেওয়া) এই বার্তাই দিচ্ছে যে, বাংলাদেশে কোনো বাক স্বাধীনতা নেই। দুর্নীতি দমনে সরকার যে জিরো টলারেন্সের কথা বলে, সেটাও একেবারেই ফাঁকা বুলি। আসলে সরকার চায় না যে দুর্নীতি দমন হোক। বাকস্বাধীনতা থাকুক।'

সুলতানা কামালের ভাষ্য, বাংলাদেশে রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতাতেই দুর্নীতি অনেক বাড়ছে। মনজুর আহমেদের ঘটনা এমন আরেকটি উদাহরণ তৈরি করল।

এই বক্তব্যের ব্যাখ্যায় তিনি বলেন, 'কোনো জনপ্রতিনিধির বিরুদ্ধে অভিযোগ উঠলে তদন্তসাপেক্ষে নিজেকে নির্দোষ প্রমাণের দায় তারও থাকা উচিত। কিন্তু কোনোক্ষেত্রেই তো সেটা হচ্ছে না। বরং যিনি অভিযোগ তুলছেন তার ওপরেই খড়গ নেমে আসছে।'

মনজুর আহমেদকে সরিয়ে দেওয়ার ঘটনায় বাক স্বাধীনতা ও দুর্নীতি দমন—এ দুটো বিষয়ের ওপরেই বড় আঘাত এসেছে বলেও মন্তব্য করেন সুলতানা কামাল। বলেন, 'দুর্নীতি দমনের ক্ষেত্রে সরকারের কোনো আন্তরিকতা নেই এবং যারা হুইসেল ব্লোয়ার, যারা এটা নিয়ে কথা বলছে, তাদের প্রোটেকশনের ব্যাপারেও সরকার আন্তরিক না। বরং সরকার দুর্বৃত্তদের প্রোটেকশন দিয়ে যাচ্ছে। এটা খুবই ভয়ানক, শঙ্কাজনক।'

এ বিষয়ে সাবেক মন্ত্রিপরিষদ সচিব আলী ইমাম মজুমদারের বক্তব্য, 'রংডুয়ার্স যারা, তাদের এনকারেজ করা হচ্ছে। এর বিরুদ্ধে যারা প্রতিবাদ করছে তাদের রেড সিগন্যাল দেখানো হচ্ছে। আমাদের গভর্ন্যান্সের অবস্থা আরও খারাপ হচ্ছে।

'এমনিতেই গুড গভর্ন্যান্স ছিল না। এর ভেতরেও যে দুই-চারজন সাহসী মানুষ ছিলেন তারাও নিরুৎসাহিত হচ্ছেন।'

এ পর্যায়ে গত বছর চাঁদপুরে শিক্ষামন্ত্রী দীপু মনির ভাইসহ আওয়ামী লীগের একাধিক নেতাকর্মীর জমি দখলের বিরুদ্ধে অবস্থানের জন্য আলোচিত ডিসি অঞ্জনা খান মজলিসের বদলি নিয়েও কথা বলেন আলী ইমাম মজুমদার।

তিনি বলেন, 'চাঁদপুরের ডিসিকেও বদলি করা হয়েছে দখলদারি নিয়ে প্রোটেস্ট করার জন্য। তারা (দখলদাররা) বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্য অনেক বেশি দামে জমি কিনতে চেয়েছিল। পাশাপাশি বালু তোলার মতো বিষয়গুলোও ছিল। তারাও ছিল ওই মিনিস্টারের লোক।

'কিন্তু ওই মিনিস্টারকে বাঁচিয়ে ডিসিকে পাঠিয়ে দেওয়া হলো নেত্রকোনা।'

এদিকে যে প্রক্রিয়ায় মনজুর আহমেদকে সরিয়ে দেওয়া হলো, সেটাকে 'প্রশ্নবিদ্ধ' অভিহিত করেন টিআইবির নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান। তিনি বলেন, 'বলা হচ্ছে তাকে (মনজুর আহমেদ) জনস্বার্থে অপসারণ করা হয়েছে। আমাদের প্রশ্ন হলো—এটা জনস্বার্থে? নাকি যারা দখলদার, দূষণকারী, প্রভাবশালী তাদের স্বার্থে?'

ইফতেখারুজ্জামান আরও বলেন, 'সংস্থা হিসেবে নদী কমিশন ছিল অকার্যকর। আইনগতভাবেও এটা খুব একটা কার্যকর না। কিন্তু যতটুকু সক্ষমতা ছিল, সম্ভাবনা ছিল সেটা আমরা কাজে লাগতে দেখিনি। কিন্তু মনজুর আহমেদ অন্তত চেষ্টা করেছেন। মূল জায়গায় হাত দেওয়ার চেষ্টা করেছেন। বিশেষ করে যারা দখলদার তাদের চিহ্নিত করা, তাদের বিরুদ্ধে একটা অবস্থান গ্রহণ করা।'

'এটা মানুষের মধ্যে একটা প্রত্যাশা তৈরি করেছিল। সেটাকে পদদলিত করা হলো। অন্যদিকে আরও অবারিত সুযোগ করে দেওয়া হলো দখলদার, দূষণকারীদের জন্য।'

মনজুর আহমেদের মতো সরকার কর্তৃক দায়িত্বপ্রাপ্ত এমন ব্যক্তিরা যখন তাদের পেশাগত কাজে প্রভাবমুক্ত হয়ে দক্ষতা ও বস্তুনিষ্ঠতার সঙ্গে দৃষ্টান্ত স্থাপন করেন তখনই সরকার তাদের সুরক্ষা না দিয়ে বিপরীতে দাঁড়িয়েছে বলেও মন্তব্য করেন ইফতেখারুজ্জামান।

তিনি বলেন, 'তাদের নাজেহাল করা হয়েছে। বদলি করা হয়েছে। নিয়োগ বাতিল করা হয়েছে। এটা কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্য হতে পারে না। বরং এর মাধ্যমেই সরকারের সর্বোচ্চ পর্যায়ে থেকে দুর্নীতির বিরুদ্ধে জিরো টলারেন্সের যে অঙ্গীকার করা হয়েছে, সেটাকে পদদলিত করা হচ্ছে। দুর্নীতি, অনিয়ম ও অব্যবস্থাপনাকে বিকশিত করার অবারিত সুযোগ করে দেওয়া হচ্ছে।'

Comments