ভালো নেই বাদ্যযন্ত্র কারিগররা

‘১০ বছর আগে যে পরিমাণ আয় করতাম এখন তার অর্ধেকের কম আয় হচ্ছে।’
বাদ্যযন্ত্র কারিগর
পরিমল চন্দ্র মনিদাস তার দোকানে বাদ্যযন্ত্র মেরামতের কাজ করছেন। ছবি: এস দিলীপ রায়/স্টার

লালমনিরহাটের আদিতমারী উপজেলার ভাদাই ইউনিয়নের টাওয়ারপাড়া গ্রামের পরিমল চন্দ্র মনিদাস (৫৫) ৪০ বছর ধরে বাদ্যযন্ত্র তৈরি ও মেরামতের কাজ করছেন। এই কাজ তিনি শিখেছেন বাবা অনিল চন্দ্র মনিদাসের কাছে।

একসময় খেয়েপড়ে দিন চলে গেলেও, গত ১০ বছর ধরে তিনি তার পৈতৃক এ পেশায় সন্তোষজনক আয় করতে পারছেন না। সংসার চালানো নিয়ে পড়েছেন দুশ্চিন্তায়।

পরিমল চন্দ্র মনিদাসের মতোই পৈতৃক এই পেশাকে বাঁচিয়ে রাখতে দুশ্চিন্তায় পড়েছেন লালমনিরহাট ও কুড়িগ্রামের অর্ধশত বাদ্যযন্ত্র কারিগর। তারা বলছেন, সমাজে সাংস্কৃতিক চর্চা কমে যাওয়ায় কমে গেছে বাদ্যযন্ত্রের ব্যবহার। আর এ কারণে কদর কমে গেছে বাদ্যযন্ত্র কারিগরদের।

পরিমল চন্দ্র মনিদাস দ্য ডেইলি স্টারকে জানান, লালমনিরহাট ও কুড়িগ্রামে জেলায় মনিদাস সম্প্রদায়ের প্রায় ১৫০টি পরিবার রয়েছে। এদের মধ্যে ৩০টি পরিবারের লোকজন পৈতৃক পেশা অর্থাৎ বাদ্যযন্ত্র তৈরি ও মেরামতের সঙ্গে জড়িয়ে রয়েছেন। বাকি পরিবারগুলো চলে গেছে অন্য পেশায়।

যারা এখনও রয়ে গেছেন তাদের অনেকেও আবার পৈতৃক পেশা ছাড়ার প্রস্তুতি নিচ্ছেন। তাদের মধ্যে পরিমল চন্দ্র মনিদাস নিজেও একজন।

তিনি বলেন, '১০ বছর আগে যে পরিমাণ আয় করতাম এখন তার অর্ধেকের কম আয় হচ্ছে। আমাদের সমাজে সংস্কৃতিচর্চা কমে গেছে। ফলে বাদ্যযন্ত্রের ব্যবহারও কমে গেছে। পৈতৃক পেশা ছেড়ে দিতে আমিও প্রস্তুতি নিচ্ছি। এ পেশায় আয় করে জীবিকা নির্বাহ কষ্টকর হয়ে পড়ছে।'

বাদ্যযন্ত্রের কারিগররা দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, তারা ঢাকা, ঢোল, খোল, ডুগডুগি, নাল, কঙ্কন, একতারা, দোতারা, সারিন্দা ও বাংলা ঢোলসহ সব ধরনের দেশীয় বাদ্যযন্ত্র তৈরি ও মেরামতের কাজ করেন। এসব বাদ্যযন্ত্র বিভিন্ন সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে বাজানো হয়। বিশেষ করে যাত্রা গান, কুশান গান, পালা গান, ভাওয়াইয়া, পল্লীগীতি ও মনসামঙ্গল গানের আসরে দেশীয় বাদ্যযন্ত্র বাজাতেই হয়।

লালমনিরহাট
বাদ্যযন্ত্র মেরামতের দোকান। ছবি: এস দিলীপ রায়/স্টার

লালমনিরহাট শহরের বিডিআর হাট এলাকার বাদ্যযন্ত্র কারিগর সুশীল চন্দ্র মনিদাস (৪৫) জানান, এক যুগ আগে শুধু বর্ষাকাল ছাড়া সারা বছরই তাদের কর্মতৎপরতা ছিল। কিন্তু এখন তাদের বছরের অধিকাংশ সময় কর্মহীন হয়ে থাকতে হচ্ছে। আগে সাংস্কৃতিকচর্চায় যুক্ত লোকজনের সঙ্গে নিবিড় সম্পর্ক ছিল। তারা প্রায়ই তাদের কাছে আসতেন বাদ্যযন্ত্র তৈরি ও মেরামতের জন্য।

'এখন লোকজন মাঝে মাঝে আমাদের কাছে আসেন শুধু খোল তৈরি ও মেরামতের জন্য। আমাদের আস্তে আস্তে বাদ্যযন্ত্র তৈরি ও মেরামতের কাজ ভুলে যাওয়ার দশা হচ্ছে', তিনি বলেন।

কুড়িগ্রামের উলিপুর উপজেলার হাতিয়া গ্রামের বাদ্যযন্ত্র কারিগর নহেন্দ্র নাথ মনিদাসও (৬৭) হতাশ এই পেশার বর্তমান অবস্থা নিয়ে।

তিনি জানান, তার তিন ছেলেই পেশা ছেড়ে দিয়ে অন্য পেশায় চলে গেছেন। তিনি কোনো রকমে এ পেশাটি ধরে রেখেছেন। কয়েক বছর আগে দোকান ভাড়া নিয়ে বাদ্যযন্ত্র তৈরি ও মেরামতের কাজ করতেন। কিন্তু দোকান ভাড়া যোগান দিতে না পারায় এখন বাড়িতেই এ কাজ করছেন।

'আগামী কয়েক বছর পর বাদ্যযন্ত্র কারিগর পেশার মানুষকে খুঁজে পাওয়া যাবে না,' তিনি বলেন।

সংস্কৃতিচর্চা কমে যাওয়া প্রসঙ্গে কথা হয় কুড়িগ্রামের ফুলবাড়ী উপজেলার বালারহাট গ্রামের যাত্রাশিল্পী পরেশ চন্দ্রের সঙ্গে।

তিনি জানান, গত ১০ বছরে এলাকায় যাত্রা গানের মঞ্চ হয়নি। তাই তিনি অভিনয় করার সুযোগও পাননি। তিনি ১৫ বছর বয়স থেকে যাত্রা গানে অভিনয় করছেন। তার যাত্রা দলের ৫০জন শিল্পী কর্মহীন হয়ে পড়েছেন। তারা সবাই মানবেতর জীবনযাপন করছেন।

পরেশ চন্দ্র বলেন, 'সাংস্কৃতিক চর্চায় এখন পৃষ্ঠপোষকতা মিলছে না। এ কারণে গ্রামে যাত্রা গান, পালা গান, কুশান গানসহ কোনো ধরনের সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান হচ্ছে না।'

লালমনিরহাট সদর উপজেলার কর্ণপুর গ্রামের কুশান গানের শিল্পী অমূল্য চন্দ্র বর্মণ বলেন, 'কুশান গান ইতোমধ্যে বিলুপ্ত হয়েছে। পালা গান, যাত্রা গানও বিলুপ্তির পথে। এখন মাঝেমাঝে ভাওয়াইয়া, পল্লীগীতি ও মনসামঙ্গল গানের আসর বসলেও, তা খুবই কম।'

'দীর্ঘদিন থেকে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের মঞ্চ আয়োজন করা হচ্ছে না। এ কারণে বাদ্যযন্ত্রের ব্যবহার না হওয়ায় শিল্পীরাও বাদ্যযন্ত্র কারিগরদের সঙ্গে যোগাযোগ রাখছেন না। বাদ্যযন্ত্র কারিগরদের মতো শিল্পীরাও মানবেতর জীবনযাপন করছেন', যোগ করেন তিনি।

লালমনিরহাট সমাজসেবা অধিদপ্তরের উপরিচালক আব্দুল মতিন ডেইলি স্টারকে বলেন, 'বাদ্যযন্ত্রের কারিগররা প্রান্তিক জনগোষ্ঠি। প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর লোকজন সমাজসেবায় আবেদন করলে তাদেরকে আর্থিক সহযোগিতা দেওয়া হচ্ছে।'

Comments