যেভাবে দুবাই প্রবাসীদের টাকা হাতিয়ে নেন আরাভ খান

গত বছরের ১৮ নভেম্বর ১০ ভুক্তভোগী অর্থ আত্মসাতের অভিযোগে দুবাইয়ের বাংলাদেশ কনস্যুলেটে আরাভ খানের বিরুদ্ধে অভিযোগ করেন এবং তাদের অর্থ ফেরত পেতে বাংলাদেশ মিশনের হস্তক্ষেপ চান।

১৬ বছরের প্রবাস জীবনে অল্প অল্প করে ১ লাখ ৩১ হাজার দিরহাম (৪৪ লাখ টাকা) জমিয়েছিলেন দুবাই প্রবাসী আয়নাল সিপাত আলী। এই টাকার পুরোটাই আত্মসাৎ করে নেন হত্যা মামলার পলাতক আসামি রবিউল ইসলাম ওরফে আরাভ খান। 

শুধু আয়নাল নন; দুবাই প্রবাসী আরও নয় বাংলাদেশির কাছ থেকে ৪ লাখ ২৫ হাজার ৫০০ দিরহাম (প্রায় ১ কোটি ৪৬ লাখ টাকা) টাকা আত্মসাৎ করেছেন তিনি।

দুবাইয়ে স্বর্ণের দোকান চালু করে সম্প্রতি আলোচনায় আসেন আরাভ খান। তিনি পুলিশ কর্মকর্তা মামুন ইমরান খান হত্যা মামলা ও একটি অস্ত্র মামলার পলাতক আসামি। হত্যা মামলা দায়েরের পর তিনি ভারতে পালিয়ে যান এবং আরাভ খান নাম নিয়ে ভারতীয় নাগরিকত্ব গ্রহণ করেন।

গোপালগঞ্জের বাসিন্দা রবিউল ইসলাম বর্তমানে আরাভ খান পরিচয়েই ভারতীয় নাগরিক হিসেবে দুবাইয়ে থাকছেন। তিনি ৩৭ দিনের জন্য দুবাইতে ইন্টারপোলের হাতে গ্রেপ্তার থাকলেও ভারতীয় নাগরিক হওয়ার কারণে বাংলাদেশ সরকার তাকে দেশে ফিরিয়ে আনতে পারেনি।

গত বছরের ১৮ নভেম্বর ১০ ভুক্তভোগী অর্থ আত্মসাতের অভিযোগে দুবাইয়ের বাংলাদেশ কনস্যুলেটে আরাভ খানের বিরুদ্ধে অভিযোগ করেন এবং তাদের অর্থ ফেরত পেতে বাংলাদেশ মিশনের হস্তক্ষেপ চান।

এ বিষয়ে দুবাইয়ের বাংলাদেশের কাউন্সেল জেনারেল বিএম জামাল হোসেন গত ২১ ডিসেম্বর ফোনে ডেইলি স্টারকে বলেন, 'যেহেতু আরাভ এখন একজন ভারতীয় নাগরিক, তাই আমরা ক্ষতিগ্রস্তদের দুবাইয়ে ভারতের কনস্যুলেট জেনারেলের কাছে আবেদন করার পরামর্শ দিয়েছি।'

অভিযোগ অনুযায়ী, দুবাই প্রবাসী তরিকুল ইসলামের কাছ থেকে ১ লাখ ৭৮ হাজার দিরহাম, আয়নাল সিপাত আলীর কাছ থেকে ১ লাখ ৩১ হাজার দিরহাম, ইউসুফ আলীর কাছ থেকে ৩৭ হাজার ৫০০ দিরহাম, মোহাম্মদ রাফসান জনির কাছ থেকে ৩১ হাজার ৫০০ দিরহাম, হাসান খানের কাছ থেকে ২৫ হাজার দিরহাম, ইশতিয়াক আহমেদের কাছ থেকে ১০ হাজার দিরহাম, মো. সাব্বিরের কাছ থেকে ১০ হাজার দিরহাম এবং সারোয়ার আহমেদের কাছ থেকে ৫ হাজার দিরহাম আত্মসাৎ করেছেন আরাভ খান।

ভুক্তভোগীদের মধ্যে চারজন দ্য ডেইলি স্টারকে জানান, তারা দুবাইয়ে ভারতের কনস্যুলেট জেনারেল অফিসেও অভিযোগ করেছেন কিন্তু কোনো লাভ হয়নি।

এ বিষয়ে জানতে দুবাইয়ে ভারতের কনসাল জেনারেল কে কালিমুথু ও আরাভ খানের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলেও তারা কেউ সাড়া দেননি।

ভুক্তভোগীরা জানান, আরাভ খান তার ট্রাভেল এজেন্সি 'আরভ খান ট্রাভেলসে'র মাধ্যমে ইউরোপ ও উত্তর আমেরিকার বিভিন্ন দেশের ভিসা পাইয়ে দেওয়ার নামে প্রতারণা করছেন।

'সে (আরাভ) আমার জীবন নষ্ট করে দিয়েছে—এখন আমার কাছে স্ত্রীর চিকিৎসার জন্যও কোনো টাকা নেই,' আয়নাল বলেন।

২০২২ সালের জুলাই মাসে ছেলের আকস্মিক মৃত্যুর পর, বাংলাদেশে ফিরে আসার সিদ্ধান্ত নেন আয়নাল। তখনই তিনি আরাভের সঙ্গে যোগাযোগ করেন। আরাভ তাকে বলেছিলেন, তার সঞ্চয় বাংলাদেশে ফেরত পাঠানোর ব্যবস্থা করবেন।

আয়নালের বয়স এখন প্রায় ৬০ বছর। তিনি চট্টগ্রামের সাতকানিয়ায় একজন নিরাপত্তাকর্মী হিসেবে চাকরি করছেন।

'সে আমাকে বাবা বলে সম্বোধন করেছিল। আমি তার আচরণে খুশি হই। সে আমাকে বলেছিল "তুমি মানসিকভাবে বিপর্যস্ত, আমাকে টাকা দাও, আমি তোমার পরিবারের কাছে পাঠিয়ে দেব",' বলেন তিনি।

দুবাইয়ের সফটওয়্যার ইঞ্জিনিয়ার তরিকুল ইসলামের গল্পটা অন্যরকম। ২০২২ সালের ডিসেম্বরে তরিকুলকে একটি ব্যাংক অ্যাকাউন্টে পাঁচ মিনিটের জন্য ১ লাখ ৭৮ হাজার দিরহাম জমা দেওয়ার অনুরোধ করেছিলেন আরাভ খান। তিনি বলেছিলেন, আরভ জুয়েলার্সের জন্য লিজ চুক্তিতে সই করতে হলে প্রয়োজনীয় অ্যাকাউন্ট ব্যালেন্স দেখাতে হবে।

'আমি একজন বাংলাদেশি হিসেবে তাকে সাহায্য করেছিলাম। গত বছরের ডিসেম্বরে আমি তার অ্যাকাউন্টে টাকা পাঠাই। কিন্তু সেই পাঁচ মিনিট আর শেষ হয়নি,' তরিকুল বলেন।

তরিকুলের কাছ থেকে টাকা নেওয়ার তিন মাস পর দুবাইয়ে স্বর্ণের দোকান চালু করেই সবার নজরে আসেন আরাভ খান। ক্রিকেটার সাকিব আল হাসানসহ আরও কয়েকজন তারকা ওই অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন।

এই জুয়েলার্সের নাম করে ছয়জনের কাছ থেকে টাকা হাতিয়ে নেন আরাভ খান।

আরভ জুয়েলার্সে ৩৭ হাজার ৫০০ দিরহাম বিনিয়োগ করেছিলেন ইউসুফ আলী। তিনি বলেন, 'আমি তার কথা শুনে নিশ্চিত হয়েছিলাম যে এখানে বিনিয়োগ করলে ভাগ্য পরিবর্তন হবে। কিন্তু আরাভ জুয়েলার্সে আমি কোনো অংশীদারিত্ব পাইনি।'

অন্যদিকে আরাভ জুয়েলার্সের ৫০ শতাংশ শেয়ারের জন্য চারটি চেকের মাধ্যমে আরাভকে ১২ লাখ ৭০ হাজার টাকা দিয়েছিলেন মোহাম্মদ হোসেন ফয়সাল।

'টাকা দেওয়ার পরই আমি ভুল বুঝতে পারি এবং আদালতের মাধ্যমে শেয়ারটি আরাভকে ফেরত দিয়ে দিই। কিন্তু সে আমাকে এখনো চেক ফেরত দেয়নি। উল্টো আমাকে মেরে ফেলার হুমকি দিয়েছে,' বলেন তিনি।

পরে আরাভের বিরুদ্ধে দুবাইয়ের নায়েফ থানায় একটি মামলা করেন ফয়সাল এবং যে অ্যাকাউন্ট থেকে তিনি আরভকে চেকগুলো ইস্যু করেছিলেন সেখান থেকে টাকা সরিয়ে নেন।

পরে চাকগুলো বাউন্স করায় ফয়সালের বিরুদ্ধে মামলা করেন আরাভ। পরে ফয়সালও চেক জালিয়াতির অভিযোগে আরাভের বিরুদ্ধে মামলা করেন। দুটি মামলাই এখন বিচারাধীন রয়েছে।

তবে আয়নাল এখনো কোনো মামলা করতে পারেনি।

'যদি কোনো আইনি ব্যবস্থা নিই তাহলে ইয়াবা রাখার অভিযোগে আমার পরিবারের সদস্যদের মেরে ফেলা হবে বলে হুমকি দিয়েছেন আরাভ,' বলেন আয়নাল।

Comments

The Daily Star  | English

Abu Sayed’s death in police firing: Cops’ FIR runs counter to known facts

Video footage shows police shooting at Begum Rokeya University student Abu Sayed, who posed no physical threat to the law enforcers, during the quota reform protest near the campus on July 16. He died soon afterwards.

12h ago