হারিয়ে যেতে বসেছে যমুনা পাড়ের শতবর্ষ পুরোনো ‘নৌকা ভাঙার ব্যবসা’

নদীপাড়ের মানুষের কাছে নৌকা ভাঙা গ্রামীণ ব্যবসা হিসেবে চলে আসলেও, এ ব্যবসার নেই কোনো পৃষ্ঠপোষকতা, নেই কোনো সরকারি সহযোগিতা।
পাবনার বেড়া উপজেলার নদী পাড়ের নাকালিয়া বাজারে একসময় কয়েকডজন নৌকা ভাঙার কারখানা থাকলেও, এখন টিকে আছে শুধু দুটি কারখানা। ছবি: আহমেদ হুমায়ুন কবির তপু/স্টার

যমুনা নদীবিধৌত পাবনার বেড়া উপজেলার নদী পাড়ের নাকালিয়া বাজারে দুই দশক আগেও চোখে পড়ত কয়েক ডজন কাঠের কারখানা। 

এসব কারখানায় নতুন কাঠ নয়, পুরোনো ও ব্যবহার অনুপযোগী নৌকা কিনে সেগুলো থেকে কাঠ সংগ্রহ করে তৈরি হতো খাট, চৌকি, আলনা, কাপড় রাখার আলমারিসহ নানা ধরনের গৃহস্থালি আসবাবপত্র।

কালের বিবর্তনে এসব দোকানের বেশিরভাগের এখন আর কোনো অস্তিত্ব নেই। 

নদী পাড়ে নিভু নিভু প্রদীপের মতো শুধু দুটি নৌকা ভাঙার কারখানা টিকে আছে শত বছরের পুরোনো ব্যবসার ঐতিহ্য ধারণ করে। 

আগের মতো জৌলুস না থাকলেও, নাকালিয়া বাজারের নৌকার কাঠের আসবাবের গুরুত্ব এখনো আছে নদী পাড়ের দরিদ্রদের কাছে।

ব্যবসায়ীরা পুরোনো নৌকা কিনে সেগুলোর ভেঙে কাঠ দিয়ে বিভিন্ন আসবাবপত্র তৈরি করেন। ছবি: আহমেদ হুমায়ুন কবির তপু/স্টার

যমুনা নদী বিধৌত পাবনার বেড়া উপজেলা ও সিরাজগঞ্জের বিস্তীর্ণ নদী পাড়ের এলাকার মানুষকে বছরের বেশিরভাগ সময় নৌকায় চলাচল করতে হয়। বর্ষার সময় নৌকা ছাড়া কোনো বাহন থাকে না নদীপাড়ের গ্রামগুলোতে। 

শুস্ক মৌসুমে নৌকার প্রয়োজনীয়তা কমে গেলেও, চর এলাকার মানুষকে নদী পার হতে প্রতিদিন নৌকা নিয়েই যাতায়াত করতে হচ্ছে। তাই যমুনার পাড়ের মানুষদের কাছে নৌকা নিত্যসঙ্গী। তবে কাঠের তৈরি এসব নৌকা বেশিদিন পানিতে টেকে না। 

ইঞ্জিনচালিত বড় নৌকা কয়েকবছর চালানো হলেও ছোট ডিঙ্গি নৌকাগুলো প্রায় এক বা দুই বছরের মধ্যেই নষ্ট হয়ে চলাচলের অযোগ্য হয়ে পড়ে। 

বর্ষার পর প্রতি বছর নদী পাড়ে বিপুল সংখ্যক ব্যবহার অযোগ্য নৌকা ফেলে দিয়ে আবার নতুন করে নৌকা তৈরি করতে হয় মাঝিদের। তবে পুরোনো ও ব্যবহারের অযোগ্য এসব নৌকা পানিতে চলাচলের অনুপযোগী হলেও, এর কদর রয়েছে নদীপাড়ের গ্রামীণ জনপদে।

নাকালিয়া বাজারের পুরোনো নৌকার ব্যবসায়ী মো. সিদ্দিক আলি গত তিন দশক ধরে পৈত্রিক সূত্রে এ পেশায় আছেন। নৌকা ভাঙার ব্যবসা করে আসছেন নাকালিয়া বাজারে। 

দ্য ডেইলি স্টারকে তিনি জানান, প্রায় অর্ধ শতাব্দী আগে তার দাদা এ ব্যবসা শুরু করেন। 

৮০'র দশকে তিনি যখন ব্যবসার হাল ধরেন তখন এ নাকালিয়া ঘাটে প্রায় দুই ডজন ব্যবসায়ী পুরোনো নৌকা কিনে সেগুলো ভেঙে বিভিন্ন আসবাবপত্র তৈরি করতেন। 

নদী তীরবর্তী পাবনা ও সিরাজগঞ্জের বিভিন্ন এলাকা থেকে পুরোনো ও ভাঙা নৌকা কিনে এনে ঘাটেই সেগুলো ভেঙে তা থেকে কাঠ সংগ্রহ করা হতো।

এ শিল্পের সঙ্গে জড়িত ছিলেন নদীপাড়ের কয়েকশত মানুষ। 

একটি বড় নৌকা থেকে কমপক্ষে ৮-১০ টি চৌকি আর ডজনখানেক মুরগির ঘর তৈরি করা যায়। ছবি: আহমেদ হুমায়ুন কবির তপু/স্টার

সিদ্দিক আলি বলেন, 'সে সময় বড় বড় বজরা নৌকা, মহাজনী নৌকা শাল বা দামী কাঠ দিয়ে তৈরি হতো। ফলে পুরোনো নৌকা কিনে অনেক লাভ হতো। কালের বিবর্তনে এখন বড় মহাজনী নৌকার সংখ্যা কমে গেছে। বজরা নৌকা নেই বললেই চলে। এখন খেয়া পারাপারের জন্য ইঞ্জিনচালিত নৌকাই বেশি, যেগুলোর বেশিরভাগ শিশু, কড়ই, জামরুল, আম কাঠের তৈরি। তবে শাল কাঠেরও কিছু নৌকা হয়।'

তিনি বলেন, 'কাঠের তৈরি এসব নৌকা বেশিদিন পানিতে চালানোর মতো সক্ষমতা থাকে না। ইঞ্জিনচালিত বড় বড় নৌকা কয়েক বছর চালানো হলেও ছোট ডিঙি নৌকা এক বা দুই বছরের মধ্যেই নষ্ট হয়ে চলাচলের অযোগ্য হয়ে পড়ে।'

সিদ্দিক ডেইলি স্টারকে বলেন, 'প্রতি সপ্তাহে ৮-১০টি পুরোনো নৌকা কিনে নদীপাড়ের বিশাল বালু চরে স্থাপিত কারখানায় কাঠের চৌকি, মুরগির ঘরসহ বিভিন্ন আসবাব তৈরি করি। তবে সব নৌকা থেকে একরকম কাঠ পাওয়া যায় না। কোনো কোনো সময় যে দামে নৌকা কেনা হয়, তার চেয়ে কম দামে ভেঙে বিক্রি করা হয়।'

তিনি জানান, বড় শাল কাঠের পুরোনো নৌকা কিনতে প্রায় ১ লাখ টাকা খরচ হয়। এছাড়া বিভিন্ন সাইজের নৌকার বিভিন্ন রকম দাম। ইঞ্জিনবিহীন ছোট ও মাঝারি নৌকা কিনতে খরচ হয় ৮-১০ হাজার টাকা। 

সিদ্দিক বলেন, 'ইঞ্জিনচালিত নৌকা কিনে নদীপাড়েই ভেঙে বিভিন্ন অংশ আলাদা করে কারখানায় নিয়ে আসি। নৌকার পুরোনো ইঞ্জিন আর লৌহ জাতীয় অংশ আলাদাভাবে বিক্রি করি।' 

'পুরো নৌকা ভেঙে কাঠ নিয়ে আসা হয় কারখানায়। কাঠের যে অংশ ব্যবহারের অযোগ্য হয়ে পড়ে, সেগুলো লাকড়ি হিসেবে বিক্রি করা হয়,' বলেন তিনি।

এই কারিগর জানান, বড় নৌকা থেকে কমপক্ষে ৮-১০ টি চৌকি আর ডজনখানেক মুরগির ঘর তৈরি করা যায়। এছাড়া, আলমারিসহ অন্যান্য ফার্নিচারও তৈরি করা যায়। নদীপাড়ের দরিদ্র শ্রেণির মানুষ এসব পণ্যের মুল ক্রেতা।  

নদী পাড়ের আরেক ব্যবসায়ী মো. ইউনুস আলি জানান, বড় শাল কাঠের নৌকা কিনে ভাঙার পর বিভিন্ন পণ্য বিক্রি করে কমপক্ষে ১০-১৫ হাজার টাকা আয় করা যায়। 

আর ছোট ও মাঝারি নৌকা কিনে সেগুলো ভেঙে বিক্রি করে ২-৩ হাজার টাকা লাভ হয়।

নৌকার কাঠ থেকে তৈরি পণ্য নদীপাড়ের বিভিন্ন বাজারে বিক্রি করা হয় বলে জানান তিনি।

ইউনুস বলেন, 'নদীপাড়ের গ্রামগুলোর বাসিন্দারা বন্যার সময় অনেক আসবাবপত্র হারিয়ে ফেলে, অনেক আসবাবপত্র নষ্ট হয়ে যায়। তারা কম দামে নৌকার কাঠের এসব পণ্য কিনে নেন।'

পাবনা ও সিরাজগঞ্জের যমুনা নদী বিধৌত বিভিন্ন এলাকা থেকে প্রতিদিন ভাঙ্গা নৌকা কিনে এনে সেগুলো ভেঙ্গে বিভিন্ন পণ্য তৈরি করে নদী পারের ব্যাজার গুলিতে বিক্রি করছেন তারা। 

ইউনুস জানান, নদী পারের গ্রাম গুলোতে বেশিরভাগ মানুষ বন্যার সময় অনেক আসবাবপত্র হারিয়ে ফেলে। নিম্ন আয়ের এসব মানুষ কম দামে নৌকার কাঠের এসব পণ্য সহজেই কিনতে পারছে বলে জানান তিনি। 

পুরোনো নৌকার ব্যবসায়ীরা বলছেন, বাংলাদেশসহ পৃথিবীর প্রায় সব দেশে সমুদ্র পাড়ের এলাকাগুলোর জাহাজভাঙা শিল্পের ইতিহাস অনেক পুরোনো। নদীপাড়ের মানুষের কাছে নৌকা ভাঙা গ্রামীণ ব্যবসা হিসেবে চলে আসলেও, এ ব্যবসার নেই কোনো পৃষ্ঠপোষকতা, নেই কোনো সরকারি সহযোগিতা।

নিজেদের মতো করেই বছরের পর বছর চালিয়ে যাচ্ছে নৌকা ভাঙ্গার এ ব্যবসা। কিন্তু, পৃষ্ঠপোষকতা না থাকায় পৈত্রিক এ ব্যবসা টিকিয়ে রাখা দায় হয়ে পড়েছে তাদের জন্য। 

শত বছরের পুরোনো এ ব্যবসার নেই ন্যূনতম স্বীকৃতিটুকুও। এখনো তাদের কাঠের ব্যবসার লাইসেন্স নিয়ে চালাতে হচ্ছে পৈত্রিক ব্যবসা। ফলে কোথাও থেকে তারা আর্থিক সহায়তাও পান না।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে যমুনাবিধৌত পাবনার বেড়া উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান মো. রেজাউল হক দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, 'নদীপাড়ের পুরোনো নৌকার ব্যবসায়ীরা ইতোপূর্বে এ ধরনের কোনো আবেদন করেননি। তাদের সমস্যা নিয়ে সরকারি দপ্তরে আসেননি। তাই তাদের সমস্যাগুলো চিহ্নিত করে ব্যবস্থা নেওয়া সম্ভব হয়নি প্রশাসনিকভাবে।'

'তারা তাদের সমস্যা নিয়ে আমাদের কাছে এলে আলোচনা করে ব্যবস্থা নেওয়া যাবে,' বলেন তিনি।

 

Comments