রাজধানীতে ৬৪ হাজারের মধ্যে ‘ব্যবহারের অনুমোদন’ আছে সর্বোচ্চ ৩২০০ ভবনের

মহানগর ইমারত নির্মাণ বিধিমালায় বলা হয়েছে, কোনো ভবনে বসবাস বা ব্যবহারের আগে রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ থেকে ব্যবহার বা বসবাস সনদ নিতে হবে।
ঢাকার ভবনের চিত্র। ছবি: শেখ এনাম/স্টার

ঢাকার বেইলি রোডের একটি বহুতল ভবনে ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডে ৪৬ জনের মৃত্যুর পর ভবন ব্যবহারে বহু ধরনের অনিয়ম ও গাফিলতির তথ্য উন্মোচিত হচ্ছে। রেস্তোরাঁ ব্যবসার অনুমোদন না থাকার পরও অগ্নিনিরাপত্তাহীন এই ভবনে আটটি রেস্তোরাঁ চলছিল বছরের পর বছর ধরে।

অথচ বিধি অনুসারে নির্মাণ শেষে ওই ভবনটি ব্যবহার শুরুর আগে রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (রাজউক) থেকে বাধ্যতামূলক সনদ (অকুপেন্সি সার্টিফিকেট) নেওয়ার কথা ছিল মালিকের। সেটা হলে ভবনটি কী কাজে ব্যবহার করা হচ্ছে কিংবা এর নকশা অথবা ব্যবহারের ক্ষেত্রে কোনো পরিবর্তন এসেছে কি না, তা রাজউকের নজরে আসত। এতে হয়তো মর্মান্তিক, প্রাণঘাতী এই দুর্ঘটনাটি এড়ানো যেত।

মহানগর ইমারত নির্মাণ বিধিমালায় বলা হয়েছে, কোনো ভবনে বসবাস বা ব্যবহারের আগে রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ থেকে ব্যবহার বা বসবাস সনদ নিতে হবে। ২০০৮ সালে এই আইন চালুর পর ১৬ বছর পেরিয়ে গেছে। এই দেড় দশকে অন্তত ৬৪ হাজার ভবন নির্মাণ হয়েছে রাজধানীতে। অথচ মাত্র দুই থেকে পাঁচ শতাংশ ভবন এই সনদ নিয়েছে। সংখ্যায় হিসাব করলে এর পরিমাণ দাঁড়ায় এক হাজার ২৮০ থেকে তিন হাজার ২০০টি।

স্টার ডিজিটাল গ্রাফিক্স

নগরবিদ ও বিশেষজ্ঞদের অভিমত, অকুপেন্সি সার্টিফিকেট না নেওয়ায় নকশা অনুযায়ী ভবন নির্মিত হচ্ছে কি না, তা নজরদারি করা সম্ভব হচ্ছে না। কোনো ভবন মালিক অনিয়ম করে নকশায় পরিবর্তন আনলেও তা ধরা পড়ছে না। ফলে নির্মিত ভবনটি ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে উঠলেও তা চিহ্নিত হচ্ছে না। আর ভবন ব্যবহার সনদ না নিলে রাজউক থেকে আইনগত ব্যবস্থা নেওয়ার কথা থাকলেও এখন পর্যন্ত কারও বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার কোনো নজির নেই।

এক্ষেত্রে রাজউকের 'দুর্নীতিপ্রবণ মানসের' পাশাপাশি ভবন মালিক কিংবা কর্তৃপক্ষের অতি মুনাফার ঝোঁককেও দায়ী করেছেন বিশেষজ্ঞরা।

জানতে চাইলে নগর পরিকল্পনা বিশেষজ্ঞ এবং নগর গবেষণা কেন্দ্রের অধ্যাপক নজরুল ইসলাম দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, রাজউককে মানুষ একটি দুর্নীতিগ্রস্ত সংস্থা হিসেবে চেনে। এখানে নকশা অনুমোদন থেকে শুরু করে প্রতিটি পর্যায়ে যে ভোগান্তির ভেতর দিয়ে যেতে হয় গ্রাহককে, তাতে ভবন নির্মাণের পর অকুপেন্সি সার্টিফিকেট নিতে তারা আগ্রহী হন না। আবার নানা কারণে রাজউকের দিক থেকেও এটা নজরদারি করা হয় না। অথচ ভবন নির্মাণে অনিয়ম রোধ ও ঝুঁকি নিরসনে এটা একটা ভালো পদ্ধতি।

২০০৮ সালের ঢাকা মহানগর ইমারত বিধিমালার দ্বিতীয় অধ্যায়ের ১৮ ধারায় বলা হয়েছে, ইমারত আংশিক বা সম্পূর্ণ নির্মাণ শেষের পরে তা ব্যবহার বা বসবাসের জন্য সনদ নিতে হবে। এই সনদ পাওয়ার আগে ইমারত আংশিক বা সম্পূর্ণ কোনো অবস্থাতেই ব্যবহার করা যাবে না। এই ব্যবহার বা বসবাস সনদের মেয়াদ হবে পাঁচ বছর। পাঁচ বছর পরপর এটি নবায়নও বাধ্যতামূলক।

রাজউকের প্রধান নগর পরিকল্পনাবিদ ও বিশদ অঞ্চল পরিকল্পনা (ড্যাপ) প্রকল্পের পরিচালক আশরাফুল ইসলাম গত রোববার ডেইলি স্টারকে জানান, প্রতি বছর রাজউক থেকে গড়ে পাঁচ থেকে সাত হাজার ভবনের নকশা অনুমোদন দেওয়া হয়।

ঢাকার ভবনের চিত্র। ছবি: শেখ এনাম/স্টার

সংশ্লিষ্টদের ভাষ্য, অনুমতি নেওয়ার পরের তিন বছর এই নকশার মেয়াদ থাকে। প্রতিবছর অনুমোদিত নকশার ৮০ শতাংশ ভবন নির্মিত হয়। সে হিসেবে গত ১৬ বছরে রাজধানীতে অন্তত ৬৪ হাজার ভবন নির্মিত হয়েছে।

এর মধ্যে কতগুলো ভবন অকুপেন্সি সার্টিফিকেট নিয়েছে, জানতে চাইলে আশরাফুল ইসলাম বলেন, 'এই তালিকা আমাদের কাছে আছে। দেখে বলতে পারব।'

এরপর কয়েক দফায় আশরাফুল ইসলামের নম্বরে ফোন করলেও তিনি ধরেননি। পরে কথা হয় রাজউকের প্রধান প্রকৌশলী উজ্জ্বল মল্লিকের সঙ্গে। তার ভাষ্য, 'এটা (অকুপেন্সি সার্টিফিকেট) নেওয়া খুবই জরুরি। এটা হলে সব ক্লিয়ার হয়ে যায়। সর্বোচ্চ দুই থেকে পাঁচ পারসেন্ট ক্লায়েন্ট এটা নিয়েছে। এর বেশি কোনোভাবেই না।'

উজ্জ্বল মল্লিক আরও বলেন, 'গুলশান, বনানী, বারিধারা, নিকুঞ্জের মতো রাজউকের আবাসিক প্রকল্পগুলোর জমির মালিকরা অকুপেন্সি সার্টিফিকেট নিতে বাধ্য হন। কারণ এটা ছাড়া আমরা অন্য কোনো ক্লিয়ারেন্স দেই না। কিন্তু সব ভবনের ক্ষেত্রেই অকুপেন্সি সার্টিফিকেট নেওয়ার নিয়ম আছে। তবে ব্যক্তিমালিকানাধীন জায়গার মালিকরা সাধারণত নকশা অনুমোদনের পর আমাদের এখানে আসার তেমন প্রয়োজন বোধ করেন না কিংবা তারা আসেন না। আমাদের (রাজউকের আবাসিক প্রকল্প) ক্ষেত্রে নামজারি কিংবা অন্য বিভিন্ন কাজে আসলে আমরা অকুপেন্সি সার্টিফিকেট চেয়ে বসি। কিন্তু বেশিরভাগ ভবন মালিক অকুপেন্সি সার্টিফিকেট নেননি। ডেভিয়েশন থাকার কারণেও অনেকে এটা নিতে পারছেন না।'

স্টার ডিজিটাল গ্রাফিক্স

অকুপেন্সি সার্টিফিকেটের এই বিষয়টি দেখভালের মূল দায়িত্ব রাজউকের উন্নয়ন নিয়ন্ত্রণ শাখার। বিষয়টি নিয়ে বিস্তারিত জানার জন্য এই শাখার সদস্য ও রাজউকের বোর্ড মেম্বার মোহাম্মদ আব্দুল আহাদের মোবাইলে একাধিকবার যোগাযোগ করা হয় ডেইলি স্টারের পক্ষ থেকে। কিন্তু তিনি ফোন ধরেননি। পরিচয় জানিয়ে এসএমএস পাঠানো হলেও সাড়া দেননি।

তবে একই শাখার সাবেক এক সদস্য নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, অনেক ক্ষেত্রেই ভবন নির্মাণের সময় অনুমোদিত নকশার বিচ্যুতি ঘটে। অনেকে ডানে-বাঁয়ে এক-দেড়-দুই ফুট পর্যন্ত বাড়িয়ে ফেলেন। আটতলার অনুমোদন নিয়ে সাড়ে আট বা নয়তলা বানিয়ে ফেলেন। কিন্তু নির্মাণ শেষে ব্যবহার সনদ না নেওয়া হলেও এসব ভবন মালিকের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হয় না।

নগর পরিকল্পনাবিদ ও বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ভবনগুলো পাঁচ বছর পরপর অকুপেন্সি সার্টিফিকেট নবায়ন করলে রাজউক সহজেই ঝুঁকিপূর্ণ ভবন চিহ্নিত করতে পারত।

এ বিষয়ে নগর–পরিকল্পনাবিদদের সংগঠন বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব প্ল্যানার্সের (বিআইপি) সভাপতি আদিল মুহাম্মদ খান বলেন, 'ভবনের কাজ শেষ হলে রাজউক দেখবে সেটা নকশা অনুসারে নির্মিত হয়েছে কি না। সেটা অকুপেন্সি সার্টিফিকেট পাওয়ার প্রথম শর্ত। কিন্তু এটা পাওয়ার পর কেউ কেউ তো সেটা পরিবর্তন করে ফেলতে পারেন। আবাসিক ভবন বাণিজ্যিক কাজে ভাড়া দিয়ে ফেলতে পারেন। এটা যেন না হয়, তার জন্য পাঁচ বছর পর পর এটা নবায়নের বিধান রাখা হয়েছে সরেজমিন পরিদর্শন সাপেক্ষে।

'এটা যখন ভায়োলেট করা হচ্ছে বার বার, তখন এই ভায়োলেশনের বিরুদ্ধে রাজউককে দৃশ্যমান কোনো পদক্ষেপ নিতে দেখা যায়নি কখনো। এত বছর ধরে এত অগ্নিকাণ্ড নিয়ে আলোচনা হচ্ছে, কিন্তু অকুপেন্সি সার্টিফিকেট না নেওয়ার কারণে কারও কোনো শাস্তি হয়েছে এমন নজির নেই। সুতরাং যে সমাজে এ ধরনের অপরাধ করে পার পেয়ে যাওয়া যায়, সেখানে তো আবাসিক ভবনে রেস্তোরাঁ হবে, গুদাম হবে—এটা তো অবধারিত।'

জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের আরবান ও রিজিওনাল প্ল্যানিং বিভাগের এই অধ্যাপকের পর্যবেক্ষণ হলো, অকুপেন্সি সার্টিফিকেটের বিধানটি নিশ্চিত করতে পারলে অগ্নিদুর্ঘটনাসহ যেকোনো ধরনের বিপর্যয় অনেকটাই রোধ করা সম্ভব। কারণ প্রতি পাঁচ বছর পর পর এটা নবায়ন করার অর্থ হচ্ছে আবার ভবনটিকে পরীক্ষার সামনে ফেলা। একটা মূল্যায়নের ভেতর রাখা।'

স্টার ডিজিটাল গ্রাফিক্স

অধ্যাপক নজরুল ইসলাম মনে করেন, 'রাজউক একটা জরুরি প্রতিষ্ঠান। এটা হতে হবে গ্রাহকবান্ধব। রাজউকের প্রয়োজনীয়তা আছে। সংস্থাটিকে আরও শক্তিশালী করা দরকার। লোকবল বাড়ানো দরকার। আবার লোকবল বাড়ানোর পর দুর্নীতি যদি না কমে, তাহলে হবে না।'

অবশ্য রাজউকের লোকবলের বিষয়টির সঙ্গে দ্বিমত পোষণ করে আদিল মুহাম্মদ খান বলেন, 'রাজউকের তো পরিদর্শক আগের চেয়ে অনেক বেড়েছে। প্রতি বছর গড়ে পাঁচ হাজার ভবন হচ্ছে। এটা তো পাঁচ লাখ না। এক্ষেত্রে আড়াইশ পরিদর্শক নিয়মিত কাজ করলেই হয়। আর পুরো পপুলেশন ধরে তো জরিপ করার প্রয়োজন নেই। দৃষ্টান্ত স্থাপনের জন্য যদি বছরে পাঁচ শতাংশ ভবনেও জরিপ করা হয়, সে অনুসারে ভায়োলেশনের জন্য দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দেওয়া যায়, তাহলে তো সবাইকেই একটা বার্তা দেওয়া যায়।'

বিআইপি সভাপতি মনে করেন, এমন কোনো দৃষ্টান্ত রাজউক এখন পর্যন্ত দেখাতে পারেনি। রাজউকের পরিদর্শকসহ পুরো দলের সঙ্গে বড় ধরনের দুর্নীতির সংশ্লিষ্টতা আছে। এর সঙ্গে রাজউকের পাশাপাশি অন্য সেবাখাতগুলোও যুক্ত। এরা সবাই মিলে এই ধরনের অনিয়ম-অব্যবস্থাপনাকে পরিচর্যা করছে।

Comments