১২ মাসে ১১ বিদেশ সফর!

যা বিদেশ ভ্রমণ নিয়ে সরকারি নির্দেশনার লঙ্ঘন

কৃষি সচিব ওয়াহিদা আক্তারের ঘন ঘন বিদেশ সফর তার সহকর্মী সরকারি কর্মকর্তাদের মধ্যে আলোচনার জন্ম দিয়েছে। নথি অনুযায়ী, গত বছর ওয়াহিদা আক্তার ১১টি দেশ সফর করেছেন, যার মধ্যে মে থেকে ডিসেম্বরের মধ্যে তিনি গেছেন ছয়টি দেশে। যা বিদেশ ভ্রমণ নিয়ে সরকারি নির্দেশনার স্পষ্ট লঙ্ঘন।

২০২৩ সালের মে থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত তিনি ছয় বার এবং ২০২৪ সালের জানুয়ারি-মে পর্যন্ত পাঁচ বার তিনি বিদেশ সফর করেছেন।

২০১১ সালের ১৯ জুন প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় 'বিদেশ ভ্রমণের অনুমতি এবং অনুসরণীয় আনুষঙ্গিক বিষয়াদি' শিরোনামে একটি সার্কুলার জারি করে, যেখানে বলা হয়েছে, একজন সচিব বছরে সর্বোচ্চ চার বার সরকারি কাজে বিদেশ ভ্রমণ করতে পারবেন।

তবে সম্প্রতি সরকারি কর্মকর্তাদের মধ্যে সম্মেলন ও কর্মশালায় যোগ দিতে বা জ্ঞান বিনিময় কর্মসূচিতে অংশগ্রহণের জন্য এই ধরনের বিদেশ ভ্রমণের প্রবণতা বাড়ছে। এমন অনেক ভ্রমণের ফল অবশ্য খুব কমই পাওয়া যায়, কারণ যেসব কর্মকর্তা এসব ভ্রমণে যান তাদের বেশিরভাগই সরাসরি সেই বিষয়গুলোর সঙ্গে যুক্ত নন।

ওয়াহিদা আক্তারের ১১টি বিদেশ ভ্রমণের মধ্যে দুটি সরকারের অর্থায়নে এবং নয়টি আয়োজকদের অর্থায়নে হয়েছে।

এসব ভ্রমণে তিনি কমপক্ষে ৪৭ দিন বিদেশে কাটিয়েছেন এবং কর্মশালা, গোলটেবিল বৈঠক, আলোচনা, দ্বিপাক্ষিক বৈঠক এবং চুক্তি স্বাক্ষর অনুষ্ঠানে যুক্ত ছিলেন।

চুক্তি স্বাক্ষর এবং দ্বিপাক্ষিক বৈঠক ছাড়া অন্যান্য ইভেন্টগুলোতে সচিবের অংশগ্রহণ পিএমওর আরেকটি নির্দেশনার লঙ্ঘন। যেখানে বলা হয়েছে কর্মশালা, গোলটেবিল বৈঠক এবং আলোচনার মতো ইভেন্টের ক্ষেত্রে জুনিয়র বা মাঠ পর্যায়ের কর্মকর্তারা অগ্রাধিকার পাবেন।

সাবেক সচিব ও সিভিল সার্ভিস গবেষক আবদুল আউয়াল মজুমদার বলেন, একজন সচিবের এভাবে ঘন ঘন বিদেশ ভ্রমণ শুধু সরকারি নির্দেশনার লঙ্ঘনই নয়, জুনিয়র কর্মকর্তাদের কাছেও ভুল বার্তা দেয়।

তিনি দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, 'পররাষ্ট্র বিষয়ক এবং ইআরডি (অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগ) সচিব ছাড়া আমার মনে হয় না অন্য কারও এমন কাজ আছে যার জন্য বছরে তিন থেকে চার বার বিদেশ সফরের দরকার হয়।'

এ বিষয়ে নজরদারির প্রশ্ন তুলে তিনি বলেন, 'সরকার কেন অনুমতি দিচ্ছে? দেখার কি কেউ নেই?'

নির্দেশনার লঙ্ঘন

২০১১ সালের প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের সার্কুলার অনুসারে, বিদেশ সফর শুধুমাত্র জাতীয় স্বার্থ সংশ্লিষ্ট বিষয়- যেমন সমঝোতা স্মারক সই, চুক্তি সই বা আন্তর্জাতিক সংস্থায় বাধ্যতামূলকভাবে দেশের প্রতিনিধিত্বের জন্য করতে হবে।

এতে স্পষ্ট করে নির্দেশনা দেওয়া আছে যে শিক্ষা সফর, সেমিনার, সিম্পোজিয়াম এবং কর্মশালার মতো ইভেন্টের জন্য জুনিয়র অফিসার এবং মাঠ পর্যায়ের কর্মকর্তাদের অগ্রাধিকার দিতে হবে।

এই সংবাদপত্রের হাতে আসা নথি অনুসারে, গত বছর কৃষি সচিবের তিনটি সফর এসব নিয়ম লঙ্ঘন করেছে। দুবার কর্মশালায় অংশগ্রহণ নিয়ে এবং আরেকবার চুক্তি আলোচনা নিয়ে।

চলতি বছর এরই মধ্যে ওয়াহিদা আক্তার পাঁচ বার বিদেশ ভ্রমণ করেছেন। মে মাসে তিন বার, এপ্রিলে একবার এবং জানুয়ারিতে একবার। এসব সফরে ছিল দুটি গোলটেবিল বৈঠক আর সভা এবং তিনটি ভ্রমণ ছিল চুক্তি স্বাক্ষর নিয়ে।

তিনি সিঙ্গাপুর, চীন, তিউনিসিয়া, কানাডা, সৌদি আরব এবং মরক্কোতে চুক্তি স্বাক্ষর করতে ছয় বার বিদেশ ভ্রমণ করেন।

কৃষি মন্ত্রণালয়ের অপারেশনাল বাজেটের আওতায় এসব সফরের ব্যয় মেটানো হয়। যা অপারেশনাল বা উন্নয়ন বাজেটের অর্থায়নে বিদেশ ভ্রমণ করা যাবে না বলে আরেকটি নির্দেশনার লঙ্ঘন।

চলতি বছরের ২১-২৩ মে ওয়াহিদা আক্তারের নেতৃত্বে পাঁচ কর্মকর্তার একটি প্রতিনিধি দল দ্বিপক্ষীয় বৈঠক এবং বাণিজ্য ও বিনিয়োগ সংক্রান্ত বৈঠকের জন্য অস্ট্রেলিয়ায় যান।

গত ৬ মে কৃষি সচিব ওয়াহিদা কৃষিমন্ত্রী আবদুস শহীদের সঙ্গে নেদারল্যান্ডসে এক গোলটেবিল বৈঠকে অংশ নেন। যা প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের আরেকটি নির্দেশনার লঙ্ঘন। নির্দেশনায় মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রী ও সচিবকে একসঙ্গে বিদেশ সফর না করতে বলা হয়েছিল।

তবে জাতীয় স্বার্থে বিশেষ ক্ষেত্রে, যেমন- বিশ্বব্যাংক, আন্তর্জাতিক মুদ্রা ইত্যাদির বার্ষিক সভা ও দাতাগোষ্ঠীর সঙ্গে বৈঠকে একসঙ্গে বিদেশ ভ্রমণ অপরিহার্য হলে সীমিত ক্ষেত্রে এর ব্যত্যয় করা যেতে পারে বলে নির্দেশনায় বলা হয়েছে।

গত ১৫ থেকে ১৯ এপ্রিল ডিজিটাল কৃষি সম্পর্কে শিক্ষা নিতে কেনিয়া যাওয়ার কথা থাকলেও পরে তা বাতিল হয়।

গত বছরের নভেম্বরে তিনি ফিলিপাইনে একটি কর্মশালায় অংশ নেন।

গত বছরের ১-৪ সেপ্টেম্বর কৃষি সচিব চীনে এক কর্মশালায় যোগ দেন, ১-৫ আগস্ট তিনি মালয়েশিয়ায় আলোচনায় অংশ নেন এবং ৪-৯ জুন তিনি বর্তমান চুক্তির আওতায় কানাডা সফর করেন।

'চুক্তি স্বাক্ষরের জন্য সাধারণত যে যে বিভাগের প্রধান তারা যান। বড় ধরনের কোনো জটিলতা না থাকলে সচিবদের যাওয়ার দরকার নেই, বলছিলেন সাবেক সচিব আউয়াল মজুমদার।

জানতে চাইলে কৃষি সচিব বলেন, এ ধরনের কোনো নির্দেশনা নেই।

আউয়াল মজুমদার আরও বলেন, 'আমার মেয়াদকালে আমি জুনিয়র অফিসারদের এসব সফরে পাঠাতাম। কারণ তারা আমার চেয়ে বেশি সময় ধরে দেশের সেবা করবে। বর্তমান সচিবরা যে নজির স্থাপন করেছেন তা ভবিষ্যতে আরও নেতিবাচক প্রভাব ফেলবে।'

দ্য ডেইলি স্টারের সঙ্গে আলাপকালে ওয়াহিদা আক্তার বলেন, 'সচিবরা দেশের স্বার্থে বিদেশ ভ্রমণ করেন, নিজেদের আনন্দের জন্য না।'

তিনি বলেন, 'আপনারা নিশ্চয়ই জানেন, সচিবদের বিদেশ সফরের অনুমোদন আসে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় থেকে। সচিব দেশের স্বার্থে যতবার প্রয়োজন মনে করবেন, ততবার সফর করতে পারবেন।'

সমালোচনার বিষয়ে ওয়াহিদা বলেন, 'আমি জানি না কারা এসব সমালোচনা করছে, কিন্তু আপনারা (এই পত্রিকা) যা বলছেন তা আমি মেনে নিতে পারছি না। আমাদের মন্ত্রণালয়ের সবাই জানেন এই সফরের উদ্দেশ্য সম্বন্ধে।'

কৃষিমন্ত্রী আবদুস শহীদ বলেন, 'বিদেশ সফর সংক্রান্ত ফাইল আমার কাছে না এলে আমি হস্তক্ষেপ করতে পারি না।'

তার অনুমোদন ছাড়া সচিবের সফরের ফাইল প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে পাঠানো হতে  পারে কি না জানতে চাইলে তিনি বলেন, 'সচিবকে এ বিষয়ে জিজ্ঞাসা করুন। ...নিয়ম অনুযায়ী আমার কাছে যা আসে সে কাজ আমি নিষ্পত্তি করি।'

তবে কিছু ফাইল তার কাছে পৌঁছায় না বলে স্বীকার করেন মন্ত্রী।  তিনি বলেন, 'যদি ফাইল না আসে, তাহলে আমি সেটা নিয়ে কী বলব? আমার সঙ্গে আলোচনা না হলে বলতে পারব না কোনটা ঠিক আর কোনটা ঠিক না।'

জনপ্রশাসন গবেষক ফিরোজ মিয়া বলেন, 'বিদেশ সফরের জন্য মন্ত্রীর অনুমোদন দরকার। এর ব্যতিক্রম হলে সেটা অন্য ইস্যু হতে পারে।'

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একজন মন্ত্রী বলেন, 'বিদেশ সফরের জন্য মন্ত্রীর অনুমোদন লাগে। যদি না থাকে, তাহলে এটা মন্ত্রী ও সচিবের মধ্যে সম্পর্ক ভালো না থাকার ইঙ্গিত দেয়।'

 

Comments