বোরো মৌসুম শেষ হলেও ধানের নায্যমূল্য থেকে বঞ্চিত কৃষক
এ বছর বোরো মৌসুম প্রায় শেষ হলেও ধানের দাম বৃদ্ধি না পাওয়ায় হতাশ কৃষক। গত বছরের তুলনায় উৎপাদন খরচ বেশি হলেও এ বছর মণ প্রতি দাম ১০০ থেকে ৩০০ টাকা পর্যন্ত কম পেয়েছেন তারা।
সম্প্রতি সরেজমিনে বগুড়া, জয়পুরহাট, দিনাজপুর, গাইবান্ধার বিভিন্ন এলাকা ঘুরে দেখা গেছে এ বছর ব্যবসায়ীরা কৃষকের কাছ থেকে বিভিন্ন জাতের বোরো ধান কিনছেন প্রতি মণ ৮০০ থেকে ১০৫০ টাকা দরে।
ধানের দাম এত কম কেন জানতে চাইলে গাইবান্ধার ধান চাষী মিজানুর রহমান দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, 'এ বছর ধানের চাহিদা কম। আমদানি বেশি। তাছাড়া আবহাওয়া খারাপ। ভেজা ধান। ঈদের জন্য চাতাল বন্ধ হচ্ছে। ফলে বর্তমানে ধানের দাম এখন কম।'
অন্যদিকে যেসব কৃষক অন্যের জমি পত্তন নিয়ে আবাদ করেছেন তাদের প্রতি বিঘায় লস হয়েছে পাঁচ থেকে ছয় হাজার টাকা।
সরকার ১২৮০ (প্রতি কেজি ৩২ টাকা দরে) টাকা মণ ধান কিনলেও কঠিন শর্তের কারণে সরকারের কাছে ধান বিক্রি করতে পারছেন না বেশিরভাগ কৃষক।
প্রায় দুই মাস আগে বোরো ধান কাঁটা শুরু হলেও শেষ হয়নি এখনো। উত্তরাঞ্চলের যেসব জেলায় কৃষক আলুর পরে ধান চাষ করেছেন সেসব জেলায়ও এখনো ধান কাটা শেষ হয়নি। এর মধ্যে বগুড়া, গাইবান্ধা, জয়পুরহাটে এখনো ২ থেকে ৩ শতাংশ জমির ধান মাঠে রয়েছে। বৈরী আবহাওয়ার জন্য এসব এলাকার কৃষকে কম দামে ধান বিক্রি করতে হচ্ছে।
কৃষকরা জানিয়েছেন, এ বছর শুরু থেকেই সারাদেশে ধানের দাম গত বছরের তুলনায় কম। মৌসুমের শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত বিভিন্ন জাতের ধান প্রতি মণ ৮০০ টাকা থেকে ১১০০ টাকা পর্যন্ত বিক্রি হয়েছে। অনেকে দাম বাড়বে বলে ধান বাড়িতে রেখেও কোনো লাভ হয়নি।
গাইবান্ধা এবং জয়পুরহাটের অনেক কৃষক ধান কেটে, মাড়াই করে রাস্তার পাশে ধান নিয়ে অপেক্ষা করেও ক্রেতার দেখা পাচ্ছেন না। অনেক বাধ্য হচ্ছেন কম দামে ধান বিক্রি করতে।
এমনই একজন কৃষক গাইবান্ধার গোবিন্দগঞ্জ উপজেলার শাখাহার গ্রামের মাহবুর সরকার। তিনদিন আগে মাহবুর ৫২ মণ ব্রি ধান ২৯ বিক্রি করেছেন প্রতি মণ ৮৪০ টাকা। ধান কেটে মাড়াই করে ধান বিক্রি করতে লেগেছে প্রায় ৮ দিন। এই এত দিন তিনি ধান রাস্তার পাশে রেখে ক্রেতার সন্ধান করেছেন।
মাহবুর বলেন, 'গত বছর একই ধান বিক্রি করেছি হাজার টাকা মণ। এবার সেই ধান বিক্রি করলাম ৮৪০ টাকা মণ। তাও ৮ দিন অপেক্ষা করার পরে।'
জয়পুরহাট জেলার কালাই উপজেলার আর একজন কৃষক হাবিবুর রহমান। ৩০ শতক জমির ধান কেটে সেই ধান বিক্রি করার জন্য তিনি রাস্তায় ছিলেন দুইদিন। তার পরে ধান বিক্রি করেছেন ৯০০ টাকা মণ।
গতকাল বৃহস্পতিবার দুপুরে হাবিবুর বলেন, 'এবার ধানের চাহিদা কম। দুদিন ব্যবসায়ীদের পিছু ঘুরছি। বুধবার থেকে ধান নিয়ে রাস্তায় অপেক্ষা করছি। ব্যাপারী আসার কথা বলেও এখনও আসেননি। গত বছর এই ধান বিক্রি করেছি ১ হাজার ৫০ টাকা মণ।'
বগুড়া, গাইবান্ধা, দিনাজপুর এবং জয়পুরহাটে এক বিঘা জমির হিসেবের মধ্যে তারতম্য রয়েছে।
বগুড়ায় ৩৩ শতকে এক বিঘা ধরা হয়। জয়পুরহাট ও গাইবান্ধার কিছু এলাকায় ৪০ শতকে এক বিঘা হিসেব করা হয়। আবার দিনাজপুরের অনেক উপজেলায় ৫০ শতকে একবিঘা গণনা করা হয়ে থাকে। তবে কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর মূল ৩৩ শতকে এক বিঘা গণনা করে থাকে।
জমির বিঘার তারতম্যে অনুযায়ী বিভিন্ন জেলায় উৎপাদন খরচ ও বিভিন্ন হয়ে থাকে। যেমন জয়পুরহাটের কালাই উপজেলায় ১ বিঘা সমান ৪০ শতক ধরা হয়। এই উপজেলার কৃষকদের মতে, এ বছর যারা নিজেদের জমি আবাদ করেছেন তাদের এক বিঘা জমিতে বোরো ধান আবাদের খরচ হয়েছে ১৮-১৯ হাজার টাকা। বিঘা প্রতি ধানের ফলন হয়েছে গড়ে ৩০ মণ। প্রতি মণ ধান ৮৫০ টাকা দরে বিক্রি করলে ৩০ মণ ধানের দাম হচ্ছে ২৫ হাজার ৫০০ টাকা। এভাবে বিঘা প্রতি লাভ হয়েছে ৬ হাজার ৫০০ টাকা।
অন্যদিকে, যারা জমি পত্তন বা লিজ নিয়ে আবাদ করেছেন তাদের প্রতি বিঘা ক্ষতি হয়েছে ৩৫০০ থেকে ৪০০০ টাকা। কারণ এই এলাকায় প্রতি শতক জমি এক বছরের জন্য লিজ নিতে ৫০০ থেকে ৬০০ টাকা দিতে হয়। সেই হিসেবে মূল খরচের সাথে যোগ হবে অতিরিক্ত আরও ১০ থেকে ১২ হাজার টাকা।
কালাই উপজেলার বানদীঘি গ্রামের এমনই একজন কৃষক মো. জুয়েল আহমেদ।
জুয়েল বলেন, 'এ বছর তিনি সাড়ে চার একর জমিতে বোরো ধানের চাষ করেছেন। এর মধ্যে প্রায় চার একর জমিই লিজ নিয়ে আবাদ করেছেন। তিনি কাটারি ধান বিক্রি করেছেন ১১০০ টাকা মণ এবং বাড়ি-২৯ বিক্রি করেছেন ৮৫০ টাকা মণ। এতে লিজ নেওয়া চার একরে তার লস হয়েছে প্রায় ৫০ হাজার টাকা। গত বছর কাটারি প্রতি মণ ১৩৫০ টাকা এবং ব্রি -২৯ ধান ১০০০ টাকায় বিক্রি করেছেন বলে জানিয়েছেন এই কৃষক।'
তিনি আরও বলেন, 'এ বছর আলুতে ভালো লাভ হওয়ার কারণে ধান আবাদের এই ক্ষতি কাটিয়ে ওঠা সম্ভব হয়েছে। তাছাড়া অনেক সমস্যা হতো।
জয়পুরহাট জেলার কৃষকের মতে এ বছর ১ বিঘা জমিতে বোরো ধান আবাদে বিভিন্ন খাতে ব্যয় হয়েছে প্রায় ১৯ হাজার টাকা।
যেমন ১ বিঘা জমিতে বীজ লেগেছে ৫০০ টাকার, চাষ করতে খরচ হয়েছে ১২০০ টাকা, রোপন করতে ১৬০০ টাকা। সার লেগেছে ৪০৮০ টাকা। নিড়ানীতে খরচ ১৫০০ টাকা। কীটনাশক লেগেছে ১৬০০ টাকা। ধান কাঁটার শ্রমিক খরচ লেগেছে ৭০০০ থেকে ৭২০০ টাকা। মাড়াই লেগেছে ১২০০ টাকা। জমি পত্তন প্রতি বিঘা ১০ থেকে ১২ হাজার টাকা। মোট এক বিঘায় খরচ ২৮ হাজার ৮৮০ থেকে ৩০ হাজার টাকা।
গত বছর বিঘা প্রতি খরচ এক থেকে দেড় হাজার টাকা কম ছিল বলে জানিয়েছে কৃষক।
জমি পত্তন নিয়ে ধান আবাদ করে যে কৃষক ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন তার প্রমাণ মিলেছে সরকারি হিসেবেও।
বগুড়া কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের দেওয়া তথ্যমতে, এ বছর প্রতি কেজি বোরো ধানের উৎপাদন খরচ (জমির ভাড়াসহ) ৩১ দশমিক ৯৩ টাকা। অথচ সরকার প্রতি কেজি ধান কিনছে মাত্র ৩২ টাকায় অর্থাৎ যে খরচ সেই দাম। নিজেরা যে শ্রম দিয়েছেন তার কোনো মূল্যই পাচ্ছেন না কৃষক।
অন্যদিকে সরকার প্রতি মণ ধান কৃষকের কাছ থেকে ১২৮০ টাকায় ক্রয় করলেও তা খুবই সামান্য। তাছাড়া গত পাঁচ বছর ধরে সরকার ধান কেনার পরিমাণ ও কমিয়ে দিয়েছে।
বগুড়া খাদ্য নিয়ন্ত্রক কর্মকর্তা কার্যালয় থেকে দেওয়া তথ্যমতে, ২০২০ সালে বগুড়া থেকে সরকারের বোরো ধান কিনার লক্ষ্যমাত্রা ছিল ৩৪৮৬৬ মেট্রিক টন। ২০২১ সালে ছিল ২৫১৮৬ মেট্রিক টন। ২০২২ সালে ছিল ২৫৩৪১ মেট্রিক টন। ২০২৩ সালে সেটা কমে হয়েছে ১৪১২৮ মেট্রিক টন। এ বছর বগুড়া থেকে বোরো মৌসুমে ধান সংগ্রহের লক্ষ্য দেওয়া হয়েছে মাত্র ১১৬৫২ মেট্রিক টন। অর্থাৎ গত ৫ বছরের লক্ষ্যমাত্রা প্রায় দ্বিগুণ নিচে নেমে এসেছে।
কৃষকদের অভিযোগ, যে সময় কৃষকের হাতে ধান থাকে সেই সময় ধানের দাম সবচেয়ে কম থাকে। একবার কৃষকের হাত থেকে ধান ব্যবসায়ীদের হাতে চলে গেলে ধান-চালের দাম শুধু বাড়তেই থাকে।
Comments