চব্বিশের ১৮ জুলাই যেভাবে রণক্ষেত্রে পরিণত হয় বগুড়া শহর

স্টার ফাইল ফটো

২০২৪ সালের জুলাইয়ের ঠিক মাঝামাঝি সময় থেকে আন্দোলন তীব্র হতে থাকে বগুড়ায়। ১৮ জুলাই রণক্ষেত্রে পরিণত হয় বগুড়া শহরের সাতমাথা থেকে শুরু করে প্রতিটি অলিগলি। বগুড়ায় কীভাবে আন্দোলন ছড়িয়ে পড়েছিল এবং এরপর কীভাবে তা সহিংসতায় রূপ নিয়েছিল, তার সংক্ষিপ্ত ঘটনাপ্রবাহ পাঠকদের জন্য তুলে ধরা হলো।

১৫ জুলাই

২০২৪ সালের ১৫ জুলাই প্রথম কোটাবিরোধী আন্দোলন শুরু করেন বগুড়া শহীদ জিয়াউর রহমান মেডিকেল কলেজের (শজিমেক) শিক্ষার্থীরা।

সেদিন রাত ১০টায় শজিমেক শিক্ষার্থীরা প্রথম বিক্ষোভ মিছিল করে। শজিমেক ক্যাম্পাসে প্রায় ৩০০ সাধারণ শিক্ষার্থী ঘণ্টাব্যাপী বিক্ষোভ মিছিল করে আন্দোলনের সঙ্গে সংহতি প্রকাশ করে এবং ঢাকায় আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদের ওপর হামলার নিন্দা জানায়।

স্টার ফাইল ফটো

১৬ জুলাই

এদিন সকাল ১১টায় আবারও শজিমেকের শিক্ষার্থীরা বিক্ষোভ মিছিল বের করে এবং মেডিকেলের সামনের ঢাকা-রংপুর মহাসড়কের এক পাশের সড়ক এক ঘণ্টারও বেশি অবরোধ করে রাখে। পরে কলেজের অধ্যক্ষ তাদের ক্যাম্পাসে ফিরিয়ে নিয়ে আসেন।

এর আগে সকাল ১০টা ৪০ মিনিট থেকে বগুড়া সরকারি আজিজুল হক কলেজের ৫০-৬০ শিক্ষার্থী কলেজের সামনে সাতমাথা, তিনমাথা রেলগেট সড়ক ২০ মিনিটের জন্য অবরোধ করে বিক্ষোভ মিছিল করে। শিক্ষার্থীরা বিক্ষোভ শেষ করে ক্যাম্পাসে ফিরে এলে একটি ককটেল নিক্ষেপ করা হয়। এতে আহত হন ওই কলেজের বিভিন্ন বিভাগের তৃতীয় বর্ষের চার শিক্ষার্থী। হাসপাতালে তাদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, ছাত্রলীগ তাদের ওপর এই হামলা চালায়। পরে জেলা ছাত্রলীগের সভাপতির কাছে জানতে চাইলে বিষয়টি তিনি অস্বীকার করেন।

দুপুর ১টার পরে বগুড়া পলিটেকনিক ইনস্টিটিউটের শিক্ষার্থীরা বিক্ষোভ মিছিল নিয়ে নিজ প্রতিষ্ঠান থেকে বনানী মোড়ের দিকে রওনা হলে পথে বগুড়া শাহ সুলতান কলেজের সামনে ছাত্রলীগের সঙ্গে তাদের সংঘর্ষ হয়। এতে পলিটেকনিকের দুই শিক্ষার্থী আহত হয়। পরে শত শত শিক্ষার্থী আন্দোলনে যোগ দিলে শাহ সুলতান কলেজের ছাত্রলীগ পিছু হটে এবং নিজ কলেজে অবরুদ্ধ হয়।

স্টার ফাইল ফটো

বিকেল ৩টায় পলিটেকনিকের ৭০০-৮০০ শিক্ষার্থী বনানী মোড়ের রংপুর-ঢাকা মহাসড়ক প্রায় এক ঘণ্টা অবরোধ করে রাখে। এরপরে তারা নিজ ক্যাম্পাসের সামনের রাস্তা সন্ধ্যা পর্যন্ত অবরোধ করে বিক্ষোভ করতে থাকে।

বিকেল সাড়ে ৩টার পরে শহরের বিভিন্ন গলিতে শত শত শিক্ষার্থীকে মিছিল নিয়ে সাতমাথা এলাকায় জড়ো হতে দেখা যায়। সাড়ে ৪টার দিকে বগুড়া সাতমাথায় দেখা যায়, প্রায় ৭-৮ হাজার ছাত্র-জনতা বগুড়া শহরের প্রাণকেন্দ্র সাতমাথা দখলে নিয়েছে। সেখানে শিশু থেকে শুরু করে সব বয়সী লোকজন দেখা যায়। এর আগে শিক্ষার্থীরা সাতমাথায় গেলে ছাত্রলীগের সঙ্গে তাদের সংঘর্ষ হয়। আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদের ওপর ককটেল নিক্ষেপ করে ছাত্রলীগ। পরে ছাত্রদের ধাওয়া খেয়ে সেখান থেকে পালিয়ে যায় ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা।

এই সময়ের মধ্যে বগুড়া আওয়ামী লীগের প্রার্থী অফিস, মুক্তিযোদ্ধা কমপ্লেক্স, মুজিব মঞ্চ, জেলা ডাকঘরসহ আরও স্থাপনায় ভাঙচুর ও অগ্নিসংযোগ করে আন্দোলনকারী ছাত্র-জনতা।

সন্ধ্যা ৬টার পরে পুলিশ আন্দোলনকারীদের ওপর চড়াও হয় এবং শুধু টিয়ারশেল দিয়ে আন্দোলনকারীদের সাতমাথা থেকে সরিয়ে দেয়। তবে এদিন হতাহতের কোনো ঘটনা ঘটেনি।

স্টার ফাইল ফটো

১৭ জুলাই

সেদিন বগুড়া শহরে তেমন কোনো সংঘর্ষের ঘটনা না ঘটলেও শেরপুরে সকালে আন্দোলনকারীরা বগুড়া-রংপুর মহাসড়ক অবরোধ করলে পুলিশের সঙ্গে তাদের সংঘর্ষ হয়। পুলিশ সেখানে ৯০ রাউন্ড রাবার বুলেট ও ১০টি টিয়ারশেল নিক্ষেপ করে। এতে কিছু শিক্ষার্থী আহত হন।

১৮ জুলাই: রণক্ষেত্রে পরিণত হয় বগুড়া

ওইদিন সকাল থেকেই বগুড়া সাতমাথা দখলে রেখে চারদিকে শত শত টিয়ারশেল ও রাবার বুলেট ছোড়ে পুলিশ। তাদের সঙ্গে যোগ দেয় বিজিবি ও র‌্যাব। সকাল ১১টার পর থেকে আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সঙ্গে ছাত্র-জনতার সংঘর্ষ শুরু হয়। বগুড়ার সাতমাথা প্রবেশের প্রতিটি রাস্তা বাইরে থেকে অবরোধ করেন শিক্ষার্থী-জনতা। এতে রণক্ষেত্রে পরিণত হয় বগুড়া শহর।

সকাল থেকে বিকেল ৫টা পর্যন্ত একটানা সংঘর্ষ চলে। সারাদিনে পুলিশ শটগানের হাজারো গুলি ও টিয়ারশেল নিক্ষেপ করে। পুলিশের গুলিতে এদিন শিক্ষার্থীসহ শতাধিক মানুষ আহত হন। ওইদিন শহরে কাজে আসা অনেক মানুষ আটকা পড়েন। অচল হয়ে পরে পুরো বগুড়া শহর।

১৮ জুলাই সকাল থেকে পুলিশ ইয়াকুবিয়া বালিকা বিদ্যালয় এলাকায় অবস্থান নেয়। এর পশ্চিম পাশে অবস্থিত বিচারকদের সরকারি বাসভবন। সেখানে শেরপুর রোড, গোহাইল রোড ও জলেশ্বরীতলা এলাকায় অবস্থান নেয় আন্দোলনকারীরা। পুলিশের সঙ্গে এখানে সকাল ১১টা থেকে আন্দোলনকারীদের সংঘর্ষ বাধে। এক সময় পুলিশের কাছে থাকা রাবার বুলেট শেষ হয়ে যায়। এই খবর পেয়ে আন্দোলনকারীরা অপর পাশ থেকে পুলিশকে ধাওয়া করলে আশ্রয়ের জন্য ট্রাফিক পুলিশের একজন সার্জেন্ট, এপিবিএন পুলিশের কয়েকজন সদস্যসহ প্রায় ১৪-১৫ জন পুলিশ সদস্য জাজেজ কোয়ার্টারে ঢুকে পড়েন দুপুর ১২টার পর।

জাজেজ কোয়ার্টারে সেই সময় অবস্থান করছিলেন জেলা ও দায়রা জজ (প্রশাসনিক ট্রাইব্যুনাল) শরমিন আক্তারের গাড়ি চালক মাকসুদার রহমান।

স্টার ফাইল ফটো

মাকসুদার দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, পুলিশের সঙ্গে সকাল থেকে এখানে সংঘর্ষ চলে। এক সময় পুলিশ উভয় পাশ থেকে আন্দোলনকারীদের লক্ষ্য করে রাবার বুলেট ছোড়ে। পরবর্তীতে জাজেজ কোয়ার্টারে আশ্রয় নেওয়া ১৪-১৫ জন পুলিশ কয়েকবার বের হয়ে গুলি ছোড়ে।

দুপুর ১২টার পরে হঠাৎ করে আন্দোলনকারীরা কোয়ার্টারে ঢুকে পরে। তারা একজন পুলিশ সদস্যকে ধাওয়া করে তার হাতে গাছের ডাল দিয়ে একটা বাড়ি মারে। পুলিশ সদস্য একটি গাছের নিচে আশ্রয় নেয়। সেখানেও তাকে ধাওয়া করলে তিনি হাতে থাকা রাইফেল (চাইনিজ রাইফেল) দিয়ে দুবার চার রাউন্ড গুলি করে। সেই গুলি বিচারক শরমিন আক্তারের বাসভবনের বারান্দার ও জানালার লোহার খাঁচায় লাগে।

জাজেজ কোয়ার্টারে সেই সময় উপস্থিত একাধিক ব্যক্তির সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, পুলিশকে কোয়ার্টারের মধ্যে থেকে গুলি করতে নিষেধ করলেও তারা শোনেনি। পরে আন্দোলনকারীরা মেইন গেট ভেঙে কোয়াটারে প্রবেশ করে পুলিশের ওপর চড়াও হয়। সেই সময় দুজন বিচারকের বাসভবনে প্রবেশ করে তাদের আসবাবপত্র ভাঙচুর করা হয়। ওইদিন ট্রাফিক পুলিশের সার্জেন্ট আবু আব্দুল্লাহ আল মো. জিয়াউল ইসলামসহ তিন পুলিশ সদস্য আহত হন।

সন্ধ্যায় বগুড়া শহীদ জিয়াউর রহমান মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে গিয়ে দেখা যায়, আন্দোলনকারী শিক্ষার্থী-জনতার প্রায় ৫০ জন সেখানে আহত হয়ে ভর্তি হয়েছেন। বেশিরভাগই পুলিশের টিয়ারগ্যাস ও শটগানের গুলিতে আহত হয়েছিলেন।

এই সময় অলিখিতভাবে পুলিশ হাসপাতাল ও ক্লিনিকগুলোকে আহতদের চিকিৎসা দিতে নিষেধ করে। আহতদের চিকিৎসা দেওয়া একাধিক ক্লিনিক থেকেও বিষয়টি জানানো হয়। পুলিশের পক্ষ থেকে সেই ক্লিনিকগুলোতে চিকিৎসা দিতে নিষেধ করা হয়। চিকিৎসা দিলে মামলার ভয় দেখানো হয় অভিযোগ পাওয়া যায়।

Comments