বাবার কবরের পাশে দাঁড়িয়ে থাকে আয়াত

‘বাবা এখানে শুয়ে আছে।’
বাবার কবরের পাশে দাঁড়িয়ে থাকে আয়াত
মানিকগঞ্জের সিঙ্গাইর উপজেলার ইসলামপুর পশ্চিমপাড়া গ্রামের কবরস্থানে বাবার কবরের পাশে দাঁড়িয়ে আছে ছোট্ট আয়াত | ছবি: জাহাঙ্গীর শাহ/স্টার

তিন বছর বয়সী আয়াত এখনো বোঝে না তার বাবা আর কোনো দিন ফিরবে না। সে জানে তার বাবা কবরে শুয়ে আছে, কাউকে সঙ্গে পেলেই বাবার কবরের পাশে গিয়ে দাঁড়িয়ে থাকে।

কোটা সংস্কার আন্দোলন চলাকালে নারায়ণগঞ্জের চিটাগাং রোডে সংঘর্ষে গুলিবিদ্ধ হওয়ার তিন দিন পর গত ২৩ জুলাই মারা যান তুহিন আহমেদ। আয়াত আহমেদ তার একমাত্র ছেলে।

তুহিন রাজমিস্ত্রি ছিলেন। গত ২০ জুলাই একটি বাড়িতে কাজ শেষে হেঁটে বাসায় ফেরার সময় সংঘর্ষের মধ্যে পড়ে যান।

তার শ্বশুর বুদ্ধু শেখ মানিকগঞ্জের সিঙ্গাইর উপজেলার ইসলামপুর পশ্চিমপাড়া গ্রামের বাসিন্দা। কিছু দিন আগে তার স্ত্রী রিয়া শেখ (২২) বাবার বাড়িতে গিয়েছিলেন। দূরপাল্লার বাস চলাচল বন্ধ ও কারফিউ শুরু হওয়ায় ফিরতে পারেননি।

গুলিবিদ্ধ হওয়ার পরে প্রাথমিক চিকিৎসা শেষে তুহিনকে অ্যাম্বুলেন্সে মানিকগঞ্জে নেওয়া হয়। একটি বেসরকারি হাসপাতালের নিবিড় পরিচর্যা কেন্দ্রে (আইসিইউ) চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা গেলে পশ্চিমপাড়া গ্রামে তার দাফন সম্পন্ন হয়।

মঙ্গলবার বুদ্ধু শেখের বাড়িতে গিয়ে দেখা যায় রিয়া শয্যাশায়ী। বারবার তিনি অচেতন হয়ে পড়ছেন। পাশে বসে আয়াত মায়ের মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছে।

বাবার কবরের পাশে দাঁড়িয়ে থাকে আয়াত
রিয়া খান | ছবি: জাহাঙ্গীর শাহ/স্টার

রিয়া একটি কথাই বারবার বলছেন, 'আমার স্বামী একজন রাজমিস্ত্রি। সে তো রাজনীতি করতো না। তাহলে কেন তাকে গুলি করা হলো?'

তুহিনের বাড়ি ব্রাহ্মণবাড়িয়ার বাঞ্ছারামপুর উপজেলায়। গত সাত বছর যাবত তিনি বাবা-মাকে নিয়ে নারায়ণগঞ্জের সিদ্ধিরগঞ্জ উপজেলার পাইনাদী ছিয়াখোলা এলাকায় একটি ভাড়া বাসায় বসবাস করছিলেন।

পাঁচ বছর আগে রিয়ার সঙ্গে তার বিয়ে হয়। তখন থেকে রিয়াও নারায়ণগঞ্জেই থাকছেন।

দ্য ডেইলি স্টারের এই প্রতিবেদককে দেখেও রিয়া প্রশ্ন করেন, কেন তুহিনকে গুলি করা হলো?

'একমাত্র ছোট ভাইয়ের ভিটামাটি বন্ধক রেখে চিকিৎসা করিয়েও তাকে বাঁচাতে পারলাম না। আমি স্বামীহারা হলাম। আমার তিন বছরের ছেলে বাবা হারাল। এর দায় কে নিবে,' বলছিলেন রিয়া।

'২০ জুলাই রাত পৌনে ৮টায় আমার ফোনে অপরিচিত একটি নম্বর থেকে কল আসে। রিসিভ করার পরে জানতে চাইলো তুহিন আহমেদ আমার স্বামী কি না? আমি হ্যাঁ বলতেই ওপাশ থেকে বললো, "আপনার স্বামীর তলপেটে গুলি লেগেছে।" ওই ফোন থেকেই আমি আমার স্বামীর সঙ্গে কথা বললাম। অনুরোধ করলাম আমার স্বামীকে হাসপাতালে নিতে।'

বাবার কবরের পাশে দাঁড়িয়ে থাকে আয়াত
তুহিন আহমেদ, রিয়া খান ও বাবার কোলে আয়াত | ছবি: সংগৃহীত

রিয়া জানান, তুহিনকে প্রথমে নারায়ণগঞ্জের সুবর্ণা হাসপাতালে নেওয়া হয়েছিল। সেখান থেকে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নেওয়া হয়।

'গাড়ি চলাচলে বিধিনিষেধ থাকায় আমি শত চেষ্টা করেও যেতে পারলাম না' বলতে বলতে কান্নায় ভেঙে পড়েন রিয়া।

পর দিন ২১ জুলাই ভোরে একটি অ্যাম্বুলেন্সে তুহিন মানিকগঞ্জে পৌঁছান।

রিয়া বলেন, 'ভোর সাড়ে ৫টার দিকে আমার স্বামীকে ধরে ঘরে নেওয়ার সময় দেখি শরীরে অনেক রক্ত। অ্যাম্বুলেন্সেও রক্ত পড়ে আছে। বিছানায় শোয়ার পরে খেতে চাইলো। আমি ডিম সেদ্ধ করে দিলাম কিন্তু খেতে পারলো না।

'রক্ত বন্ধ না হওয়ায় আমি দ্রুত সিঙ্গাইরের একটি ক্লিনিকে নিয়ে গেলাম। সেখান থেকে বেসরকারি ক্লিনিকে নেওয়ার পরামর্শ দিলো। সেখান থেকে গেলাম সাভার সেবা ক্লিনিকে, সেখানেও রাখলো না। সাড়ে ১১টায় সাভারের এনাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করালাম। সেখানে অপারেশন শেষে আইসিইউতে নিলো। ১৩ ব্যাগ রক্ত দেওয়া হলো কিন্তু তাকে বাঁচানো গেল না,' বলেন তিনি।

তুহিনকে বাঁচানোর চেষ্টায় তার কমপক্ষে পৌনে চার লাখ টাকা ব্যয় হয়েছে। এই ঋণের অর্থ কীভাবে শোধ করবেন জানেন না রিয়া। তিনি বলেন, 'আমার স্বামীই ছিল পরিবারের একমাত্র উপার্জনক্ষম ব্যক্তি।'

রিয়ার বাবার বাড়ি থেকে গ্রামের কবরস্থান পর্যন্ত হেঁটে যেতে সময় লাগে প্রায় ১০ মিনিট। কাউকে সঙ্গে পেলেই আয়াত বায়না ধরে বাবার কাছে যাবে সে।

এই প্রতিবেদকের সঙ্গেই সে কবরস্থানে গিয়েছিল। তুহিনের কবরের পাশে দাঁড়িয়ে আয়াত বলে, 'বাবা এখানে শুয়ে আছে।'

Comments

The Daily Star  | English
DHL Daily Star Bangladesh Business Awards 2023

DHL, Daily Star honour five business luminaries for outstanding achievements

The theme of this year's event is "Bangladesh on the rebound".

8h ago