অবিস্মরণীয় যোদ্ধা ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরী

১৯৭১ সালে বিলেতে তার জীবনযাপনের ধরন ছিল বিলাসবহুল। প্রাইভেট জেট চালানোর ও পানির নিচে সাঁতারের প্রশিক্ষকের লাইসেন্সও ছিল তার। ছিল দুনিয়ার সবচেয়ে বিলাসবহুল গাড়ি কেনার বাতিক। সেই সময়েই তিনি বিলাসবহুল বিশেষ মডেলের মার্সিডিজ বেঞ্জ ব্যবহার করতেন। তাও আবার বিশেষ টায়ারের অ্যারো ডায়নামিক সিটের প্রথম গাড়ি। প্রিন্স চার্লস যে দর্জি থেকে স্যুট বানাতেন, তিনিও একই দর্জি দিয়ে নিজের স্যুট বানাতেন। এমনই ছিল তার বিলাসবহুল জীবনের নমুনা।
তখন লিডসের ইয়র্ক হাসপাতালে ভাসকুলার সার্জারিতে এফআরসিএস দ্বিতীয় পর্বে প্রশিক্ষণরত ছিলেন ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরী। ২৪ মার্চ হোটেল ইন্টারকন্টিনেন্টালে বিদেশি সাংবাদিকদের সাক্ষাৎকার দিয়েছিলেন বঙ্গবন্ধু। সেই সাক্ষাৎকার আইটিএন নিউজের মাধ্যমে বিলেতে বসেই দেখলেন জাফরুল্লাহ চৌধুরী। সাক্ষাৎকারের একপর্যায়ে এক বিদেশি সাংবাদিক বঙ্গবন্ধুকে প্রশ্ন করলেন, 'তোমরা কি ভয় পাচ্ছ না যে পাকিস্তানিরা তোমাদের হত্যা করতে পারে?'। জবাবে বঙ্গবন্ধু বললেন, '৭৭ মিলিয়ন বাংলাদেশিকে হত্যার জন্য কি তাদের কাছে যথেষ্ট বুলেট আছে?'
বঙ্গবন্ধুর মুখে পূর্ব পাকিস্তানের বদলে বাংলাদেশি শুনতে পেয়ে জাফরুল্লাহ চৌধুরী বুঝলেন, খুব শিগগিরই সংগ্রাম আসন্ন। তিনি ব্রিটেনে কর্মরত সব পরিচিত বাঙালি চিকিৎসকদের টেলিফোন করে বললেন, 'এটি এখন প্রমাণিত যে পাকিস্তান দেশ এখন মৃত। আমরা এখন সবাই বাংলাদেশি।' এরপরই বাঙালি চিকিৎসকদের নিয়ে তিনি গঠন করলেন 'বাংলাদেশে মেডিকেল অ্যাসোসিয়েশন ইউকে'। বলে রাখা ভালো, এই সংগঠনটি ছিল 'বাংলাদেশ' নাম দিয়ে গঠিত প্রথম সংগঠন।
বাংলাদেশে মেডিকেল অ্যাসোসিয়েশন ইউকে'র কমিটিতে সাধারণ সম্পাদক ছিলেন ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরী। সভাপতি ও সহ-সভাপতি ছিলেন যথাক্রমে ডা. আবু হেনা সাইদুর রহমান ও ডা. হাকিম। কমিটিতে আরও ছিলেন ডা. আলতাফুর রহমান খান এবং স্কটল্যান্ডে জেনারেল ও কার্ডিয়াক সার্জারিতে এফআরসিএস দ্বিতীয় পর্বে প্রশিক্ষণরত ডা. এম এ মবিন। বলে রাখা ভালো তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের একমাত্র কার্ডিয়াক সার্জন ছিলেন ডা. মবিন।
ব্রিটেনে তখন সাড়ে চারশ বাংলাদেশি চিকিৎসক ছিলেন। সিদ্ধান্ত হলো প্রত্যেক সদস্য বাংলাদেশে সহায়তার জন্য প্রতি মাসে ১০ পাউন্ড করে চাঁদা দেবেন। কিন্তু ব্রিটেনে তখন বাংলাদেশিদের মধ্যে নানান মতপার্থক্য থাকায় জাফরুল্লাহ চৌধুরী ঐক্যবদ্ধ আন্দোলন গড়ে তোলার জন্য বিচারপতি আবু সাঈদ চৌধুরীর শরণাপন্ন হয়ে তাকে নেতৃত্বদানের অনুরোধ জানান।
মুক্তিযুদ্ধের শুরু থেকেই ব্রিটেনের বিভিন্ন স্থানে প্রবাসী বাংলাদেশিদের মাধ্যমে প্রতিবাদ সমাবেশ অনুষ্ঠিত হচ্ছিল। এপ্রিলে লন্ডনের হাইড পার্কে তেমনই এক পাকিস্তান-বিরোধী প্রতিবাদ সমাবেশে ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরী ও ডা. এম এ মবিন প্রকাশ্যে সাংবাদিকদের সামনে নিজেদের পাকিস্তানি পাসপোর্ট পুড়িয়ে ফেলে বললেন, 'আমরা নিজেদের আর পূর্ব পাকিস্তানের নাগরিক হিসেবে মনে করি না।' এরপরই তারা দুজনেই মুক্তিযুদ্ধে যোগ দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেন। তখন জাফরুল্লাহ চৌধুরী মওলানা ভাসানীর সঙ্গে চিঠিতে যোগাযোগ করলেন।
১৯৭১ সালের মে মাসের শুরুতে ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরী ও ডা. মবিন উড়োজাহাজে করে দিল্লি হয়ে কলকাতা যাওয়ার পরিকল্পনা করলেন। যখন তারা ভারতীয় দূতাবাসে ভিসার আবেদন করলেন, তখন তাদের পাসপোর্ট চাওয়া হয়। জাফরুল্লাহ চৌধুরী বললেন, 'আমরা তো আমাদের পাসপোর্ট পুড়িয়ে ফেলেছি।' তখন ভারতীয় দূতাবাস তাদের বিকল্প জোগাড়ের পরামর্শ দেয়। জাফরুল্লাহ চৌধুরী বললেন, 'আমরা এখন রাষ্ট্রহীন নাগরিক।' তখন তাদের স্টেটলেস সনদ বের করার পরামর্শ দেওয়া হয়। সেই সনদ জমা দিলে তবেই দিল্লির ভিসা পান তারা। এরপর দামেস্ক হয়ে দিল্লি যাওয়ার জন্য সিরিয়া এয়ারলাইনসের ফ্লাইটের টিকিট কাটলেন ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরী। ভারতীয় দূতাবাস জানাল, তাদের নিরাপত্তাঝুঁকি তৈরি হয়ে গেছে। পাকিস্তানি গোয়েন্দারা ইতোমধ্যেই তাদের বিষয়ে সমস্ত খবরা-খবর সংগ্রহ করেছে।
মুক্তিযুদ্ধ শুরুর পর বাংলাদেশ থেকে যাওয়া সামরিক ও বেসামরিক নেতাদের যাচাই-বাছাই করছিল ভারতীয় গোয়েন্দারা। বাংলাদেশ থেকে ভারতে আশ্রয় নেওয়া স্বাভাবিক হলেও তারা ঘুণাক্ষরেও ভাবতে পারেননি ব্রিটেন থেকে দুজন প্রতিষ্ঠিত চিকিৎসক স্বাধীনতা যুদ্ধে যোগ দেওয়ার জন্য ভারতে আসতে পারেন।
যাত্রাপথে সিরিয়ান এয়ারলাইনসের লন্ডন থেকে দিল্লিগামী ফ্লাইটটি সিরিয়ার দামেস্কে জ্বালানি নেওয়ার জন্য যাত্রাবিরতি নিয়েছিল। জ্বালানি নেওয়ার সময় সব যাত্রীকেই যেহেতু উড়োজাহাজ থেকে নামতে হয়, সেহেতু সিরিয়ার সঙ্গে সুসম্পর্ককে কাজে লাগিয়ে সিরিয়ায় পাকিস্তানি দূতাবাস ও গোয়েন্দারা ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরী ও ডা. মবিনকে আটক করার জন্য প্রস্তুত ছিল। বিষয়টি টের পেয়ে উড়োজাহাজ থেকেই নামেননি তারা দুজন।
সেসময় পাকিস্তানি দূতাবাসে কর্মরত কর্নেল পদমর্যাদার এক কর্মকর্তা পাইলটকে তাদের দুজনকে নামানোর জন্য চাপ দিচ্ছিলেন। কিন্তু পাইলট ছিলেন অটল। পাকিস্তানিদের যুক্তি এরা দুজন পলাতক পাকিস্তানি, সুতরাং আমরা তাদের আটক করতে পারি। অন্যদিকে পাইলটের যুক্তি, যেহেতু বিমান এখন রানওয়েতে, সুতরাং তাদের জন্য কোনো দেশের আইনই প্রযোজ্য হবে না। দুইপক্ষের মধ্যে টানা ৫ ঘণ্টা কথা-কাটাকাটির পরও পাইলটের দৃঢ় মনোবলের কারণে দামেস্ক বিমানবন্দর শেষপর্যন্ত বিমানটিকে ছাড়পত্র দেয়।
পরদিন ভোরে দিল্লি পৌঁছানোর পর তাদের স্বাগত জানালেন অল ইন্ডিয়া রিলিফ কমিটির চেয়ারপারসন পদ্মজা নাইড়ু। তিনি জাফরুল্লাহ চৌধুরীকে বললেন, 'প্রচুর শরণার্থী এখন ভারতে আশ্রয় নিচ্ছে। তাদের আশ্রয়, চিকিৎসার ব্যবস্থা করতে সরকার হিমশিম খাচ্ছে। আপনাদের দুজনের এখন উচিত শরণার্থীদের জন্য খাদ্য, আশ্রয় ও চিকিৎসাসামগ্রী জোগাড়ে আত্মনিয়োগ করা।'
এর পরপরই ভারত সরকার জাফরুল্লাহ চৌধুরীকে জানিয়ে দিলো, সন্ধ্যার ফ্লাইটেই তাদের লন্ডন ফিরে যেতে হবে।

বিষয়টি জানতে পেরে সেদিন দুপুরেই তারা দুজনে ভারতীয় গোয়েন্দাদের চোখ এড়িয়ে হোটেল থেকে বেরিয়ে দিল্লির কনট প্লেস থেকে দিল্লি-কলকাতার টিকিট কেটে নিয়ে সেদিন বিকেলের ফ্লাইট ধরে কলকাতা চলে যান।
কলকাতায় সাংবাদিক সাদেক খানসহ বেশ কয়েকজন নেতার সঙ্গে দেখা হলো জাফরুল্লাহ চৌধুরীর। তারা তাকে আগরতলা চলে যাওয়ার পরামর্শ দেন। সাদেক খান নিজে দুই নম্বর সেক্টরের কমান্ডার মেজর খালেদ মোশাররফ বরাবর একটি চিঠি লিখলেন। সেই চিঠি নিয়ে আগরতলায় যান ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরী ও ডা. মবিন।
আগরতলা টিচার্স ট্রেনিং কলেজে ক্যাপ্টেন ডা. আখতার আহমেদের সঙ্গে দেখা হয় জাফরুল্লাহ চৌধুরীদের। ডা. আখতার ও ডা. নাজিমুদ্দিন ততদিনে মেলাঘরের দারোগা বাগিচায় অস্থায়ীভাবে বাংলাদেশ ফিল্ড হাসপাতাল গড়ে তুলেছেন। এরপর ডা. জাফরুল্লাহ ও ডা. মবিনকে মেলাঘরে নিয়ে যাওয়া হয়।
ডা. জাফরুল্লাহরা যখন মেলাঘরে এসেছিলেন, তখন যুদ্ধে হতাহতদের সংখ্যা আশঙ্কাজনক হারে বাড়তে থাকায় ফিল্ড হাসপাতালের সম্প্রসারণের পরিকল্পনা চলছিল।
পরিকল্পনা অনুযায়ী ডা. আখতার ও ডা. নাজিম পাঁচ হাজার টাকার একটি বাজেট মেজর খালেদ মোশাররফের কাছে উপস্থাপন করলেন। তখন বাংলাদেশ হাসপাতালের সঙ্গে পুরোদমে যুক্ত হয়ে পড়লেন ডা. জাফরুল্লাহ ও ডা. মবিন। ডা. জাফরুল্লাহ হাসপাতাল নির্মাণের জন্য বাংলাদেশ মেডিকেল অ্যাসোসিয়েশন ইউকে শাখাকেও সংযুক্ত করলেন। ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরী দেখলেন পাঁচ হাজার টাকায় তেমন কিছু করা সম্ভব হবে না। তাই তিনি প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমেদ ও কর্নেল ওসমানীর সঙ্গে অনানুষ্ঠানিকভাবে দেখা করে ৫০ হাজার টাকার বাজেট পাস করাতে সক্ষম হলেন।
তখন বহু খোঁজাখুঁজির পর বিশ্রামগঞ্জে হাবুল ব্যানার্জির লিচু বাগানকে লিচুগাছ না কাটার শর্তে হাসপাতাল নির্মাণের জন্য নির্বাচিত করা হয়।
এই হাসপাতালে দুটি ওয়ার্ড রাখা হয়েছিল—সার্জিকেল ও মেডিকেল। এছাড়া ছিল ক্যাজুয়ালটি, ইমার্জেন্সি, প্যাথলজি, অপারেশন থিয়েটার, পোস্ট অপারেটিভ ওয়ার্ড, রিক্রিয়েশন এরিয়া, ইনফেকশাস ওয়ার্ডসহ বিভিন্ন কক্ষ।
২৬ আগস্ট মেলাঘরের দারোগা বাগিচা থেকে বিশ্রামগঞ্জে স্থানান্তরিত হয় বাংলাদেশ হাসপাতাল। এরপরই শুরু হয় বাংলাদেশ হাসপাতালের সবচেয়ে সফলতম অধ্যায়।
সেসময় চিকিৎসক, নার্স, স্বেচ্ছাসেবীরা বাংলাদেশ হাসপাতালে পুরোদমে চিকিৎসাসেবা দিতে শুরু করেন। বাংলাদেশ হাসপাতালে ঠিক কত অসুস্থ ও আহত মুক্তিযোদ্ধাদের চিকিৎসা দেওয়া হয়েছে, সে পরিসংখ্যান পাওয়া যায় না। তবে অক্টোবরের একটি রিপোর্ট অনুযায়ী জানা যায়, তখন ছয়জন চিকিৎসক, চারজন মেডিকেলের শেষবর্ষের ছাত্র, ১৮ জন স্বেচ্ছাসেবী ও নার্স বাংলাদেশ হাসপাতালে কর্মরত ছিলেন।
যখনই হাসপাতালে চিকিৎসা সরঞ্জামাদি ও কোনো জিনিসের প্রয়োজন হতো, তখনই ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরী ছিলেন সদা প্রস্তুত। তিনি বাংলাদেশ মেডিকেল অ্যাসোসিয়েশন ইউকেতে চিঠি পাঠাতেন। কেবল তাই নয়, মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন তিনি নিজে একাধিকবার ব্রিটেনে গিয়ে হাসপাতালের জন্য চিকিৎসা সরঞ্জামাদি ও ওষুধের ব্যবস্থা করেছিলেন।
বাংলাদেশ হাসপাতালের সঙ্গে সর্বক্ষণ জড়িত থাকলেও সেখানে বেশিদিন থাকতে পারেননি ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরী। কারণ পুরো যুদ্ধকালীন তাকে সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন মহলের মাধ্যমে অর্থ, ত্রাণ ও মেডিকেল সরঞ্জামাদি জোগাড়, পরিকল্পনা ও তথ্য প্রদানের কাজে নিয়োজিত থাকতে হয়েছিল। যে কারণে তাকে নিয়মিতই কলকাতা এবং ব্রিটেনে ছুটতে হতো। এছাড়া তাজউদ্দীন আহমেদ ও কর্নেল ওসমানীর সঙ্গে প্রায়ই বৈঠক করতে হতো।
জুলাইয়ে একবার জীবনের ঝুঁকি নিয়ে কিছু তথ্য সংগ্রহের জন্য আগরতলা থেকে ঢাকায় এসেছিলেন জাফরুল্লাহ চৌধুরী। কাজের ফাঁকে এক পরিচিত জাহাজ মালিকের কাছে তেলের ট্যাংকারের যাতায়াতের বিষয়ে খোঁজ নেন। পরবর্তীতে তার দেওয়া তথ্যের ভিত্তিতেই একটি তেলের ট্যাংকার ডুবিয়ে দিয়েছিল মুক্তিবাহিনী।
মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন জাফরুল্লাহ চৌধুরীকে আইরিশ রিপাবলিকান আর্মির সঙ্গে যোগাযোগ করতে বললেন মেজর খালেদ মোশাররফ। ডা. জাফরুল্লাহ ব্রিটেনে গিয়ে আইরিশ রিপাবলিকান আর্মির সঙ্গে যোগাযোগ করে অস্ত্র সহায়তা চান। জবাবে তারা এই মর্মে প্রতিশ্রুতি দেয়, যদি যুদ্ধ দীর্ঘায়িত হয়, তবে তারা মুক্তিযোদ্ধাদের অস্ত্র তৈরির প্রশিক্ষণ দেবে।
মুক্তিযুদ্ধে সব চিকিৎসক, নার্স ও স্বেচ্ছাসেবকেরা বাংলাদেশ সরকার থেকে বেতন নিলেও ব্যতিক্রম ছিলেন ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরী এবং ডা. মবিন। তারা স্বেচ্ছায় কোনো ধরনের বেতন গ্রহণ না করে বরং নিজেদের অর্থেই ব্যয় মিটিয়েছেন।
১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর জেনারেল ওসমানীর সঙ্গে কুমিল্লা ক্যান্টনমেন্টে ছিলেন ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরীও। সেই সময়ে তিনি সাক্ষ্য হয়েছেন এক অনন্য ঘটনার। যার মাধ্যমে সমাধান মিলে ১৬ ডিসেম্বর বিকেলে রেসকোর্সে জেনারেল ওসমানীর না থাকার বিষয়টিরও।
১৬ ডিসেম্বর রেসকোর্সে পাকিস্তানি বাহিনীর আত্মসমর্পণ অনুষ্ঠানে থাকবেন কি না, সে বিষয়ে জানার জন্য বাংলাদেশ সরকারের নির্দেশের অপেক্ষায় ছিলেন জেনারেল ওসমানী। কিন্তু কোনো নির্দেশ না আসায় বাবা-মায়ের কবর জিয়ারতের উদ্দেশ্যে একটি ছোট এমএইট উড়োজাহাজে করে সিলেটের উদ্দেশে রওনা দিলেন জেনারেল ওসমানী। তার সঙ্গে ছিলেন এডিসি শেখ কামাল, সেকেন্ড-ইন-কমান্ড কর্নেল আবদুর রব, ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরী, ভারতীয় ব্রিগেডিয়ার উজ্জ্বল গুপ্তা ও একজন সাংবাদিক।
যাত্রার আগে ব্রিগেডিয়ার গুপ্তা বললেন, আকাশপথ সম্পূর্ণ মুক্ত। পথিমধ্যে উড্ডয়ন অবস্থাতেই একটি প্লেন থেকে তাদের উড়োজাহাজে গুলিবর্ষণ করা হয়। গুলিতে বিমানের তেলের ট্যাংকার ফুটো হয়ে যায়। তখন ভারতীয় পাইলট ব্রিগেডিয়ার গুপ্তার উদ্দেশে বললেন, 'স্যার আমার হাতে মাত্র ১০ মিনিট সময় বাকি আছে। আমি কোথায় অবতরণ করব।' বিষয়টি বুঝতে পেরে জেনারেল ওসমানী ও জাফরুল্লাহ চৌধুরী নিজেদের জ্যাকেট খুলে হেলিকপ্টারের তেলের ট্যাংকারের চারপাশ মুড়িয়ে দিলেন যেন গুলি না লাগে। এমন সময়েই একটি গুলি এসে লাগলো কর্নেল রবের পায়ে। ভীষণ রক্তপাত হচ্ছিল।

জাফরুল্লাহ চৌধুরী দ্রুত কর্নেল রবকে শুইয়ে দিয়ে মাউথ টু মাউথ ব্রিদিং ও কার্ডিয়াক ম্যাসেজ দিতে লাগলেন। সেই সময় শেখ কামালের হাতেও গুলি লাগে। যদিও শেষপর্যন্ত পাইলট উড়োজাহাজটিকে বিচক্ষণতার সঙ্গে অবতরণ করাতে সক্ষম হয়েছিল। তারা উড়োজাহাজ থেকে লাফ দিয়ে নামার কিছুক্ষণের মধ্যেই সেটি পুরোপুরি পুড়ে যায়।
১৬ ডিসেম্বর মুক্তিযুদ্ধ আনুষ্ঠানিকভাবে সমাপ্ত হলেও শেষ হয়নি ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরীর চিকিৎসাযুদ্ধ। কারণ কেবল মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়েই থেমে যাননি ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরী। বরং মুক্তিযুদ্ধ-পরবর্তী সময়ে তিনি শামিল হয়েছেন নতুন এক মহান চিকিৎসা যুদ্ধে। যে যুদ্ধে তিনি গড়ে তুলেছিলেন গণমানুষের চিকিৎসার চিরকালীন স্বাস্থ্য ঠিকানা 'গণস্বাস্থ্য কেন্দ্র'।
বলা বাহুল্য বাংলাদেশ ফিল্ড হাসপাতালের অভিজ্ঞতাকে সঞ্চয় করেই গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রের ভিত্তি স্থাপন করেছিলেন জাফরুল্লাহ চৌধুরী। গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রের নামটিও দিয়েছিলেন বঙ্গবন্ধুর মতামতকে প্রাধান্য করে।
১৯৭২ সালে জাফরুল্লাহ চৌধুরী যখন নতুন হাসপাতালের উদ্যোগ নিয়েছিলেন, তখন হাসপাতালের নাম বাংলাদেশ হাসপাতাল করতে চেয়েছিলেন। কিন্তু এতে সরকারের পক্ষ থেকে আপত্তি উঠে আসে। বিষয়টি নিয়ে জাফরুল্লাহ চৌধুরী বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে সাক্ষাৎ করে বিষয়টি তুলে ধরেন। 'বাংলাদেশ হাসপাতাল' নামটি সরকারি ধাঁচের মনে হয়, মন্তব্য করে জাফরুল্লাহ চৌধুরীকে তিনটি নাম নির্ধারণ করতে বলেন বঙ্গবন্ধু। পরবর্তীতে জাফরুল্লাহ চৌধুরী তিনটি নাম নির্বাচন করলে সেখান থেকে গণস্বাস্থ্য কেন্দ্র নামটি নির্ধারণের পরামর্শ দেন বঙ্গবন্ধু। বঙ্গবন্ধুর মন্তব্য ছিল নতুন হাসপাতালের নাম গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রই রাখা হোক। তবে এটি যেন শুধু চিকিৎসার মধ্যে সীমাবদ্ধ না থাকে। দেশকে গড়ে তোলার জন্য গণস্বাস্থ্য কেন্দ্র যেন স্বাস্থ্যের পাশাপাশি কৃষি ও শিক্ষার দিকেও মনযোগী হয়।
বঙ্গবন্ধুর সেই নির্দেশ কাজের মধ্য দিয়ে অক্ষরে অক্ষরে পালন করেছিলেন ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরী।
বঙ্গবন্ধুর নির্দেশে অধিগ্রহণ করা ২৩ একর জমি ও জোহরা বেগম, এম এ রব, ডা. লুৎফর রহমানদের পারিবারিক সম্পত্তি থেকে দান করা পাঁচ একর জমিসহ মোট ২৮ একর জমিতে ১৯৭২ সালে যাত্রা শুরু করে গণস্বাস্থ্য কেন্দ্র।
সেদিনের সেই ছোট পরিসরে যাত্রা শুরু করে গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রের বর্তমানে সারাদেশে ৪০টি মেডিকেল সেন্টার রয়েছে। গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রের অধীনে আছে সাতটি হাসপাতাল, ডেন্টাল কলেজ, গণ-বিশ্ববিদ্যালয়, প্রিন্টিং অ্যান্ড পাবলিকেশন্স, মাসিক গণস্বাস্থ্য ম্যাগাজিন, বেসিক কেমিক্যাল কারখানা (দেশের সবচেয়ে বড় প্যারাসিটামল কাঁচামাল উৎপাদক প্রতিষ্ঠান), গণস্বাস্থ্য ফার্মাসিউটিক্যালস ও অ্যান্টিবায়োটিকের কাঁচামালের ফ্যাক্টরি।
দেশের মানুষের আর্থসামাজিক অবস্থার কথা চিন্তা করে জাফরুল্লাহ চৌধুরীর নেতৃত্বে গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রে গড়ে তোলা হয়েছে দেশের সর্ববৃহৎ কিডনি ডায়ালাইসিস সেন্টার। সেখানে দরিদ্র মানুষেরাও সবচেয়ে কম খরচে কিডনির চিকিৎসা করাতে পারেন।
স্বাস্থ্যখাতে জাফরুল্লাহ চৌধুরীর অন্যতম বড় ভূমিকা ছিল আশির দশকে জাতীয় ওষুধ নীতি প্রবর্তন। এ নীতির আগে দেশের ওষুধ উৎপাদন খাত ছিল পুরোপুরি বিদেশিদের হাতে। জাফরুল্লাহ চৌধুরীর হাত ধরে ওষুধ নীতির মাধ্যমে দেশের ওষুধ শিল্পের এক বিপ্লব ঘটে। যেখানে আগে দেশের ওষুধ খাত প্রায় পুরোপুরিই বিদেশিদের হাতেই সীমাবদ্ধ ছিল, সেখানে এখন দেশীয় উৎপাদকেরাই দেশের ৯৫ শতাংশ ওষুধ উৎপাদন করেন। বর্তমানে বাংলাদেশে উৎপাদিত ওষুধ শতাধিক দেশে রপ্তানিও করেন দেশীয় উৎপাদকেরা।
সদ্যস্বাধীন দেশের অজস্র প্রতিকূলতাকে সামলে নিয়ে ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরী যেভাবে দেশের স্বাস্থ্যখাত বিনির্মাণের দায়িত্ব নিয়েছিলেন, তা অবিস্মরণীয়। চিকিৎসাসেবাকে সাধারণ মানুষের দোরগোড়ায় পৌঁছে দেওয়ার এই মূল কারিগর আমাদের ছেড়ে চলে গিয়েছিলেন দুই বছর আগে আজকের দিনে।
শারীরিকভাবে তিনি চলে গেলেও রেখে গেছেন অবিস্মরণীয় এক চিকিৎসা কর্মযজ্ঞের ক্ষেত্র, যা তাকে বাঁচিয়ে রাখবে অনন্তকাল। প্রয়াণ দিবসে অবিস্মরণীয় চিকিৎসাযোদ্ধা ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরীর প্রতি বিনম্র শ্রদ্ধা।
Comments