এখন মাত্র কয়েকটি ঘর থেকে তাঁতের শব্দ শোনা যায়

রাজবাড়ীর পাংশা উপজেলার বাহলডাঙ্গা কারিগরপাড়ার আহমেদ শেখ (৬৫) একসময় নিজের বাড়ির আঙিনায় তিনটি তাঁতে লুঙ্গি ও গামছা বুনে সংসার চালাতেন। পেশাটি পেয়েছিলেন তার প্রয়াত বাবা সিফাতউল্লাহ শেখের কাছ থেকে। আয় বেশি না হলেও স্ত্রী ও দুই ছেলেকে নিয়ে আহমেদের জীবন চলতো মোটামুটি।
কিন্তু সময়ের সঙ্গে সঙ্গে লুঙ্গির চাহিদার পাশাপাশি মুনাফা কমে যাওয়ায় তাঁতের কাজ ছেড়ে দিতে বাধ্য হন তিনি। তার ছেলেরাও অন্য পেশায় চলে গেছেন।
এখন আহমেদ শেখ বসেন নিজের উঠানে পাটকাঠি ও পলিথিন দিয়ে তৈরি অস্থায়ী চায়ের দোকানে। মাটির চুলায় কেটলি বসিয়ে পানি গরম করেন, গ্রামীণ পরিবেশে চা বিক্রি করেই চলে তার দিন।
'এই পেশায় (তাঁত) আর লাভ নেই। বাধ্য হয়েই ছেড়ে দিতে হয়েছে। ছেলেরা অন্য কাজ করছে,' দ্য ডেইলি স্টারকে বললেন আহমেদ শেখ।
শুধু আহমেদ নন, বাহলডাঙ্গা গ্রামে আরও অন্তত ২০০ পরিবার পূর্বপুরুষের পেশা ছেড়ে দিয়েছে। পাংশা সদর থেকে প্রায় আট কিলোমিটার দক্ষিণপশ্চিমে এ গ্রামটি 'কারিগরপাড়া' নামে পরিচিত। শত শত বছর ধরে এখানকার মানুষ তাঁতের কাজ করে আসছেন।
এখন গ্রামের মাত্র কয়েকটি ঘর থেকে তাঁতের শব্দ শোনা যায়। রাস্তার পাশে বাঁশের খুঁটির ওপর শুকাতে দেওয়া সুতো নজরে পড়ে। এক বাড়ির উঠানে টিন ও বাঁশ দিয়ে তৈরি ছোট চালাঘরে বসানো হয়েছে দুটি হাতে চালানো তাঁত। সেখানে ৭০ বছরের জালাল উদ্দিন শেখ গামছা বুনছেন। পাশে বারান্দায় তার ২১ বছরের পুত্রবধূ জুঁথি খাতুন চরকা ঘুরিয়ে সুতো কাটছেন।
'এক সময় প্রতিটি ঘরেই তাঁত ছিল,' উল্লেখ করে জালাল উদ্দিন বললেন, 'এখন আট–দশটি হাত-তাঁত চালু আছে। আমি শুধু এই কাজটাই জানি, তাই ধরে আছি। সারাদিন পরিশ্রম করেও খরচ বাদ দিয়ে ২০০ টাকা হাতে থাকে না।'
জুঁথি ডেইলি স্টারকে জানান, তিনি কুষ্টিয়ার কুমারখালী থেকে বিয়ের পর এই পরিবারে এসে তাঁতের কাজ শিখেছেন। বলেন, 'স্বামী তাঁতের কাজ করতেন। কিন্তু এখানে আয় কম, তাই পাবনায় তাঁত কারখানায় চলে গেছেন।'
জালাল উদ্দিনের বাড়ি থেকে সামান্য দূরে এক ঘরে চলছে বিদ্যুৎচালিত পাওয়ারলুম।
গৃহবধূ নাজমা খাতুন (৪২) ডেইলি স্টারকে বললেন, 'এই তাঁত বসাতে পাঁচ লাখ টাকা লেগেছে। বেশিরভাগ টাকাই এনজিও থেকে ঋণ নিতে হয়েছে। এখন কিস্তি শোধ করাই কঠিন।'
তার স্বামী ইউনুস শেখ (৪৫) ডেইলি স্টারকে বলেন, 'আমাদের তিন সন্তান। বড় মেয়ে পাংশা সরকারি কলেজে অনার্সে ভর্তি হয়েছে। দ্বিতীয় মেয়ে এসএসসি পাস করেছে। ছেলে চতুর্থ শ্রেণিতে পড়ে। সকাল ৭টা থেকে রাত ৯টা পর্যন্ত আমি আর স্ত্রী এক সঙ্গে কাজ করি, তবুও সব খরচ বাদ দিয়ে দিনে ৫০০ টাকার বেশি থাকে না।'
'আমি চাই না সন্তানরা এই পেশায় আসুক। যত কষ্টই হোক, তাদের পড়ালেখা চালিয়ে যাচ্ছি। মানুষজন তাঁতের পেশা ছেড়ে দিচ্ছে। এভাবে চললে আগামীতে গ্রামে তাঁতির সংখ্যা আরও অনেক কমে যাবে।'
স্থানীয় বাসিন্দা ৫৯ বছর বয়সী শুকুর আলী ডেইলি স্টারকে বলেন, 'এখানকার প্রায় সবাই ঋণগ্রস্ত। সরকার থেকে সাহায্য পাই না। আমার বাবা ৩৫ বছর আগে একবার ১৩ হাজার টাকার সরকারি ঋণ পেয়েছিলেন। এরপর আর কিছু পাইনি।'
তিনি আরও বলেন, 'অনেকেই এখন পাওয়ারলুমে কাজ করছেন। তবে বেশিরভাগ যন্ত্রই পুরনো। সুতা কিনতে স্থানীয় মহাজনদের কাছ থেকে উচ্চ সুদে ঋণ নিতে হয়। কারণ, আমরা তো এই কাজ ছাড়া আর কিছু জানি না।'
বাহলডাঙ্গার তাঁতি মান্নান শেখ (৪৫) ডেইলি স্টারকে বলেন, 'ছোটবেলায় দেখতাম সবাই লুঙ্গি পরতো। এখন তরুণেরা প্যান্ট পরে। তাই লুঙ্গির চাহিদা কমে গেছে। আমাদের পণ্যের বাজারও ধসে পড়েছে।'
সরিষা ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান মো. আজমল আল বাহার ডেইলি স্টারকে বলেন, 'বাহলডাঙ্গার তাঁতশিল্পের ইতিহাস ২০০ বছরের বেশি পুরনো। এক সময় প্রতি ঘরে তাঁত ছিল। সরকারি সহযোগিতা না থাকায় অনেকেই পেশা ছেড়ে দিয়েছেন। অনেকবার উপজেলা সভায় বিষয়টি তুলেছি। কিন্তু, কোনো অগ্রগতি হয়নি। এখনই যদি ব্যবস্থা না নেওয়া হয়, তাহলে এই ঐতিহ্য হারিয়ে যাবে।"
পাংশা উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা এসএম আবু দারাদ ডেইলি স্টারকে বলেন, 'তাঁত বোর্ডের কয়েকজন কর্মকর্তা এসেছিলেন। তাদের জানিয়েছি, এখানে তাঁতিদের ঋণ সহায়তা দরকার। তবে পরে তারা কোনো উদ্যোগ নিয়েছিলেন কিনা, তা জানি না।'
দেশের তাঁতশিল্পের এই সংকট শুধু বাহলডাঙ্গায় সীমাবদ্ধ নয়। পরিসংখ্যান ব্যুরোর তথ্য মতে, ১৯৯০ সালে দেশে মোট তাঁত ছিল দুই লাখ ১২ হাজার ৪২১টি। ২০১৮ সালে তা কমে হয় এক লাখ ১৬ হাজার ছয়টি। গত ২৮ বছরে প্রায় ৪৫ শতাংশ তাঁত হারিয়ে গেছে।
ভাঙ্গা তাঁত বোর্ডের বেসিক সেন্টারের লিয়াজোঁ কর্মকর্তা মামুনুর রশিদ ডেইলি স্টারকে বলেন, 'রাজবাড়ী, ফরিদপুর, গোপালগঞ্জ, মাদারীপুর ও শরীয়তপুরে তাঁতির সংখ্যা কমেছে। সুতার দাম বেড়ে যাওয়া ও দক্ষ শ্রমিক সংকটের কারণে অনেক তাঁত বন্ধ হয়ে যাচ্ছে।'
ফরিদপুর সদর উপজেলার কানাইপুরের ৫২ বছর বয়সী তাঁতি মফিজুল ইসলামের বাবা তিনটি তাঁত চালাতেন। মফিজুল ডেইলি স্টারকে বলেন, 'এখন আমি একটি তাঁত কোনোমতে চালাই। সুতার দাম কয়েক বছরে দ্বিগুণ হয়েছে। আবার শ্রমিকও পাওয়া যায় না।'
মাদারীপুরের কালকিনি উপজেলার তাঁতি রাশিদা বেগম (৪৮) ডেইলি স্টারকে বলেন, 'বিয়ের পর গামছা বোনা শুরু করি। এখন পুরো সময় কাজ করি না, কাপড় বিক্রিই হয় না। সবাই এখন কম দামে মেশিনে তৈরি কাপড় চায়। আমরা পেরে উঠি না।'
তিনি আরও বলেন, 'এক সময় গ্রামের নারীরা এক সঙ্গে বসে সুতা কাটতেন। এখন সেই দৃশ্য নেই। এমনকি পাওয়ারলুমগুলোও বন্ধ হয়ে যাচ্ছে—বিদ্যুতের খরচ বেশি আবার মুনাফাও কম।'
বাংলাদেশ তাঁত বোর্ডের উপ-মহাব্যবস্থাপক (এসসিআর ও মার্কেটিং) ও 'তাঁতিদের কর্মসংস্থান উন্নয়নে পুঁজি সরবরাহ ও তাঁত আধুনিকায়ন' প্রকল্প পরিচালক রতন চন্দ্র সাহা ডেইলি স্টারকে বলেন, 'দেশের বিভিন্ন এলাকায় সহজ শর্তে ঋণ দিয়ে তাঁতিদের জীবনমান উন্নয়নের চেষ্টা করছি। বাহলডাঙ্গার তাঁত সম্পর্কে পরিষ্কার ধারণা নেই। তবে কেনো তাঁতিরা ঋণ পাচ্ছেন না—তা খতিয়ে দেখে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়া হবে।'
Comments