অন্তর্বর্তী সরকারের ১ বছর

‘হারানো মনোবল’ ফিরে পেতে হিমশিম খাচ্ছে পুলিশ

আওয়ামী লীগ সরকার পতনের এক বছর পরও টালমাটাল পুলিশ বাহিনী—তাদের মনোবল ভেঙে পড়েছে, চেইন অব কমান্ড ছিন্নভিন্ন।

গত বছরের ৮ আগস্ট নতুন সরকার গঠিত হওয়ার পর প্রথম দিকের কয়েক সপ্তাহে এই কথাগুলো ছিল বহুল আলোচিত। কিছু সময়ের জন্য সেগুলো যথার্থও মনে হয়েছিল।

আন্দোলন দমনে নির্বিচারে গুলি ও অতিরিক্ত বলপ্রয়োগসহ সহিংস অবস্থানের কারণে তীব্র জনরোষের মুখে পড়ে পুলিশ। জুলাই গণঅভ্যুত্থানের সময় হত্যার অভিযোগে এই বাহিনীর কর্মকর্তাদের গ্রেপ্তারের ঘটনায় সদস্যদের মধ্যে তীব্র ভয়ের সঞ্চার হয়।

ক্ষমতা গ্রহণের পর অন্তর্বর্তীকালীন সরকার বাহিনীর মনোবল ফেরাতে একগুচ্ছ উদ্যোগ নেয়। আনা হয় নতুন নেতৃত্ব, বাড়ানো হয় ঝুঁকি ভাতা এবং দেওয়া হয় পদোন্নতি।

কিন্তু তাতে পরিস্থিতির তেমন উন্নতি হয়নি। বরং তারা 'মনোবল হারানোর' ফলে অপরাধের হার বাড়ছে। প্রতিশোধের ভয়, অভিজ্ঞ কর্মকর্তার অভাব ও জনগণের আস্থা হারানোর কারণে অনেক পুলিশ সদস্য কর্মস্পৃহা দেখাতে দ্বিধাগ্রস্ত। একের পর এক সহিংস ঘটনার কারণ হিসেবেও এটাকেই দেখানো হচ্ছে।

এমনকি পুলিশপ্রধান বাহারুল আলমও সম্প্রতি স্বীকার করেছেন, তার নেতৃত্বে থাকা বাহিনীটি এখনো প্রত্যাশিত কার্যকারিতা দেখাতে পারছে না।

দ্য ডেইলি স্টারকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে কয়েকজন পুলিশ কর্মকর্তা বলেন, সহিংস ঘটনা মোকাবিলা করতে তারা অনীহা প্রকাশ করেন এই আশঙ্কা থেকে যে, বড় আকারে বিপদে পড়লে তারা কোনো সহযোগিতা পাবেন না।

তারা উল্লেখ করেন, গত বছরের আগস্ট থেকে মানুষ পুলিশের নির্দেশনা অমান্য করে চলেছে।

কিছু কর্মকর্তা ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, এই আন্দোলনের সময় অন্তত ৪৪ পুলিশ সদস্য নিহত হলেও তাদের হত্যার বিচার নিশ্চিতে দৃশ্যমান কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি।

অনেক কর্মকর্তা জানান, তাদের পরিবারের সদস্যরা সবসময় ভয়ে থাকেন এবং কোনো ঝুঁকিপূর্ণ কাজে যেন না যান, সে ব্যাপারে অনুরোধ করতে থাকে।

তারা বলেন, তাদের মনোবল ভেঙে পড়ার মূল কারণ ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের অনুপস্থিতি—যারা হয় বরখাস্ত হয়েছেন, অথবা পলাতক।

তাদের ভাষ্য, বর্তমান কর্মকর্তাদের অনেকের নেতৃত্বের অভিজ্ঞতা নেই। ফলে, তারা কার্যকরভাবে দিকনির্দেশনা দিতে হিমশিম খাচ্ছেন।

নাম প্রকাশ না করার শর্তে রাজধানীর এক থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) বলেন, 'কনস্টেবলদের ঘটনাস্থলে যেতে বললে অনেকেই যেতে চান না। কারণ, পুলিশ সদস্যরা মাঝে মাঝেই স্থানীয়দের হামলার শিকার হতে হচ্ছে, আর গালিগালাজের শিকার হওয়া তো নিত্যনৈমিত্যিক ব্যাপার।'

ঢাকায় কর্মরত এক সহকারী উপ-পরিদর্শক (এএসআই) বলেন, 'রাজনৈতিক সরকারের সময়ে পুলিশ সহযোগিতা পেত প্রশাসনের। কিন্তু এখন আর সেই অবস্থা নেই। তাই কর্মকর্তারা যেকোনো সিদ্ধান্ত নেওয়ার আগে দুবার ভাবেন।'

একই সুর ভেসে আসে আরেক এএসআইয়ের কণ্ঠে। তিনি বলেন, 'অনেক কর্মকর্তা মনে করেন, এখন সংঘাত এড়িয়ে চলাই বুদ্ধিমানের কাজ। কারণ, আমরা বিপদে পড়লে রক্ষা করার কেউ নেই।'

পুলিশের নিষ্ক্রিয়তা

গত কয়েক মাসে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর উপস্থিতিতে অপরাধীদের অপরাধ সংঘটনের কয়েকটি ভিডিও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ভাইরাল হয়েছে। সেখানে দেখা গেছে, পুলিশ সদস্যরা দর্শকের ভূমিকা পালন করছেন, আর অপরাধীরা নির্বিঘ্নে অপরাধ করে চলে যাচ্ছেন।

গত ৬ আগস্ট গাজীপুরে অটোরিকশা চালকদের কাছ থেকে চাঁদাবাজির অভিযোগ অনুসন্ধানকালে দিনের আলোয় এক সাংবাদিককে চাঁদাবাজরা পুলিশের সামনেই মারধর করে। পুলিশ সদস্যদের কোনো ব্যবস্থা নিতে দেখা যায়নি।

এ ঘটনার ভিডিও ফুটেজ ছড়িয়ে পড়লে ব্যাপক ক্ষোভের সৃষ্টি হয়।

এর আগে গত ১৮ জুলাই সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে চাপাতি হাতে এক ব্যক্তির ভিডিও ভাইরাল হয়। তাকে ধানমন্ডি ৩২ নম্বর সড়কের কাছে একজনকে ছিনতাই করার পর দায়িত্বে থাকা এক ট্রাফিক পুলিশের পাশ দিয়ে হেঁটে যেতে দেখা যায়।

৭ জুন মালিবাগ রেলগেটে আরেকটি ছিনতাইয়ের ঘটনা ঘটে—যেখানে মাত্র ৩০ থেকে ৪০ গজ দূরে পুলিশের একটি টহল গাড়ি দাঁড়িয়ে ছিল। তারপরও ভুক্তভোগীর চিৎকারে কোনো পুলিশ সাড়া দেয়নি। সিসিটিভি ফুটেজে ছিনতাই ও শাহজাহানপুর থানার ওই গাড়ির উপস্থিতি দুটোই দেখা যায়।

সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে আরেকটি ভিডিও ঘুরে বেড়াচ্ছে। যেখানে দেখা যায়, ২২ জুন উত্তরায় নিজের বাসার সামনে পুলিশের উপস্থিতিতেই সাবেক প্রধান নির্বাচন কমিশনার কে এম নুরুল হুদার ওপর হামলা হয়েছে।

একাধিকবার নিম্ন আদালত প্রাঙ্গণে আটক ব্যক্তিদের—বেশিরভাগই আওয়ামী লীগ নেতা—মারধরের শিকার হতে হয়েছে। অথচ, তারা শক্তিশালী পুলিশি প্রহরায় ছিল।

পুলিশের নিষ্ক্রিয়তা নিয়ে প্রশ্ন করা হলে পুলিশ সদর দপ্তরের সহকারী মহাপরিদর্শক (এআইজি) এএইচএম শাহাদত হোসেন বলেন, 'পুলিশ পেশাদারিত্বের সঙ্গে দায়িত্ব পালন করছে। বাহিনীর সবস্তরের সদস্যরা আইনশৃঙ্খলা বজায় রাখতে নিরলসভাবে কাজ করছেন।'

দ্য ডেইলি স্টারকে তিনি বলেন, 'যদি কোনো পুলিশ সদস্য ঠিকভাবে পালন না করেন, তার বিরুদ্ধে বিভাগীয় ব্যবস্থা নেওয়া হয়। দায়িত্ব পালনে গাফিলতির কোনো সুযোগ নেই।'

আইনশৃঙ্খলা নিয়ে উদ্বেগ

অন্তর্বর্তী সরকারের এক বছর মূল্যায়নে আইন ও সালিশ কেন্দ্র (আসক) সম্প্রতি বলেছে, আইনশৃঙ্খলার অবনতি হওয়ার পাশাপাশি বাংলাদেশে মানবাধিকার লঙ্ঘন অব্যাহত রয়েছে।

৭ আগস্টের এক বিবৃতিতে মানবাধিকার সংগঠনটি বলেছে, ইচ্ছাকৃত গ্রেপ্তার অব্যাহত রয়েছে, সঙ্গে হেফাজতে মৃত্যু ও বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডও চলছে। আইনশৃঙ্খলার অবনতিতে নাগরিকরা নিরাপত্তা নিয়ে উদ্বিগ্ন হয়ে উঠেছেন।

পুলিশের সদর দপ্তরের ডেটাবেসও অপরাধ বৃদ্ধির প্রবণতাই দেখাচ্ছে।

পুলিশ সদর দপ্তরের পরিসংখ্যান অনুযায়ী, গত বছরের আগস্ট থেকে এ বছরের জুন পর্যন্ত ১১ মাসে ৪ হাজার ১৮০টি হত্যা মামলা হয়েছে। এর অনেকগুলো গত বছরের আগস্ট থেকে ডিসেম্বরের মধ্যে গণঅভ্যুত্থানের সময়ের হত্যাকাণ্ড সংক্রান্ত।

এই ৪ হাজার ১৮০টি মামলার মধ্যে এ বছরের জানুয়ারি থেকে জুন পর্যন্ত অন্তত ১ হাজার ৯৩৩টি মামলা হয়েছে—গড়ে প্রতিদিন ১১টি করে। গত বছরের একই সময়ে হত্যা মামলা ছিল ১ হাজার ৫৩৩টি—অর্থাৎ প্রতিদিন আটটি করে।

গত ১৯ জুলাই এক সংবাদ সম্মেলনে আইজিপি বাহারুল আলম বলেন, পুলিশ বাহিনী এখনো পুরোপুরি কার্যকারিতা ফিরে পায়নি।

তিনি বলেন, আমাদের প্রধান চ্যালেঞ্জ হলো, গত বছরের মতো এমন আঘাতের অভিজ্ঞতার পর বাহিনীকে শতভাগ কার্যকর করা। বলা যায়, আমরা শতভাগ সফল হইনি, হয়তো অর্ধেকও না। পরিস্থিতির ব্যাপকতা বিবেচনায় আমাদের পথ খুঁজে নিতে হবে।

আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর ২৫ বছর চাকরির বয়স হয়েছে, এমন অন্তত ৫০ জন কর্মকর্তাকে বাধ্যতামূলক অবসরে পাঠানো হয়েছে। এএসপি ও তার ঊর্ধ্বতন পদমর্যাদার আরও অন্তত ২৩ জন কর্মকর্তাকে গণঅভ্যুত্থান-সংশ্লিষ্ট মামলায় গ্রেপ্তার করা হয়েছে। অন্তত ৫৭ জন কর্মকর্তা—এএসপি থেকে অতিরিক্ত ডিআইজি পর্যন্ত—কর্মস্থলেই আসেননি।

এ ছাড়া, ডিআইজি, অতিরিক্ত ডিআইজি ও এসপিসহ ১১৯ জন উচ্চ ও মধ্যম পর্যায়ের কর্মকর্তাকে বিভিন্ন ইউনিটে কোনো নির্দিষ্ট দায়িত্ব ছাড়াই সংযুক্ত করে রাখা হয়েছে। অর্থাৎ, তাদের মূল দায়িত্ব কেবল অফিসে উপস্থিত হওয়া ও কাগজপত্র সামলানো।

২ লাখ ১৩ হাজার সদস্যের পুলিশ বাহিনীর তুলনায় এই সংখ্যা বেশ ক্ষুদ্র।

কঠোর ব্যবস্থা জরুরি

আইনশৃঙ্খলা উন্নয়নে কঠোর নির্দেশনার প্রয়োজনীয়তার ওপর জোর দিয়ে সাবেক আইজিপি নুরুল হুদা বলেন, যারা নিজের হাতে আইন তুলে নিচ্ছে, তাদের অবিলম্বে বিচারের আওতায় আনা উচিত।

তিনি উল্লেখ করেন, আন্দোলনের পর প্রতিশোধমূলক হামলা ও পাল্টা সহিংসতা বেড়ে যাওয়ার আশঙ্কা ছিল। সেটা হয়নি।

'শেষ পর্যন্ত প্রতিশোধমূলক হত্যাকাণ্ড বন্ধ হয়েছে। মানুষ পাল্টা সহিংসতায় যায়নি। এ কারণেই আমি বলব, পরিস্থিতি তুলনামূলকভাবে ভালো,' যোগ করেন তিনি।

Comments

The Daily Star  | English
LDC graduation

LDC graduation: Govt prepares for transition amid calls for delay

The government is pressing ahead with Bangladesh's planned graduation from the UN's Least Developed Countries category in November 2026

13h ago