জামায়াত বা ২০ দলীয় জোট নয়, বিএনপির নজর ‘বৃহত্তর ঐক্যে’

২০ দলীয় জোটকে কার্যকর করার পরিবর্তে নির্দলীয় সরকারে অধীনে আগামী জাতীয় নির্বাচনের দাবি আদায়ে বিরোধী শক্তিগুলোর একটি ‘বৃহত্তর ঐক্য’ গড়ে তোলার পরিকল্পনা করেছে বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল (বিএনপি)।
বিএনপি

২০ দলীয় জোটকে কার্যকর করার পরিবর্তে নির্দলীয় সরকারে অধীনে আগামী জাতীয় নির্বাচনের দাবি আদায়ে বিরোধী শক্তিগুলোর একটি 'বৃহত্তর ঐক্য' গড়ে তোলার পরিকল্পনা করেছে বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল (বিএনপি)।

দলের অভ্যন্তরীণরা বলছেন, দেশে ও বিদেশে জোটের অন্যতম শরীক দল বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর যে অবস্থান সেটি মাথায় রেখে বিএনপি ২০ দলীয় জোটকে কার্যকর না করার কৌশল নিয়েছে।

কিন্তু বিতর্কিত এই ইসলামী দলটি আনুষ্ঠানিকভাবে তাদের মিত্র হিসেবে রয়ে গেছে। কারণ বিএনপির উচ্চ পর্যায়ের নেতারা এখনো তাদের সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্ন করার সিদ্ধান্ত নেননি।

বিএনপি সূত্র জানায়, গত বছরের আগস্টে জামায়াতের সঙ্গে বৈঠকে জোটকে অকার্যকর করার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয় এবং উভয় দলই তা গোপন রাখতে রাজি হয়।

জোটকে সক্রিয় করার কোনো ইচ্ছা বিএনপির নেই এবং একটি অকার্যকর জোট বছরের পর বছর চলতে পারে না— জামায়াতের আমির শফিকুর রহমানের এমন বক্তব্যের পর বিষয়টি সামনে আসে।

বিএনপির জ্যেষ্ঠ নেতা ও ২০ দলীয় জোটের সমন্বয়ক নজরুল ইসলাম খান গতকাল দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, 'আমরা জোটের শরিকদের সঙ্গে আলোচনা করেছি এবং সবাই একমত হয়েছি যে বৃহত্তর স্বার্থে আমরা সবাই একযোগে আন্দোলন করব। জামায়াতের সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্ন করার চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়নি।'

বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য নজরুল ইসলাম খান জানান, জামায়াতের আমিরও বলেছিলেন যে তারা জাতীয় স্বার্থে যুগপৎ আন্দোলন করার পক্ষে।

জোট সম্পর্কে তিনি বলেন, বিএনপি বা জামায়াত কেউই জোট ভেঙে দেওয়ার ঘোষণা দেয়নি।

তিনি বলেন, 'এই মুহূর্তে আমাদের প্রধান লক্ষ্য সব বিরোধী শক্তির মধ্যে বৃহত্তর ঐক্যের দিকে, যারা একযোগে আন্দোলন করবে। লক্ষ্য হবে সরকারকে উৎখাত করা এবং একটি নির্দলীয় অন্তর্বর্তী সরকারের অধীনে একটি অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন করা।'

এই কৌশলের অংশ হিসেবে বিএনপি ইতোমধ্যে জোটের বাইরে থাকা শরিক দল জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল (রব), নাগরিক ঐক্য, বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পার্টি ও গণসংহতি আন্দোলনসহ আরও কয়েকটি সংগঠনের সঙ্গে বৈঠক করেছে।

নাগরিক ঐক্যের আহ্বায়ক মাহমুদুর রহমান মান্না বলেন, 'বিএনপি বৃহত্তর ঐক্যের কথা বলছে এবং এ বিষয়ে আমরা আশাবাদী। এ বিষয়ে বিএনপির সঙ্গে আলোচনা হয়েছে।'

তিনি বলেন, 'একটি নতুন জোট গঠনের চেয়ে বিরোধী শক্তির একযোগে আন্দোলন করা একটি ভালো ধারণা বলে মনে হচ্ছে। এই কঠিন সময়ে, একটি যুগপৎ আন্দোলন অত্যন্ত প্রয়োজন।'

বিএনপি-জামায়াত সম্পর্কের বিষয়ে সাবেক এই ছাত্রনেতা বলেন, 'এটা ঠিক যে বিএনপি-জামায়াতের সম্পর্ক এখন নড়বড়ে। কিন্তু তারপরেও সবাই একযোগে আন্দোলনের কথা বলছে, যা ভালো।'

বিএনপি সারাদেশে নিজস্ব কর্মসূচি পালন করছে এবং তাদের নেতা-কর্মীদের ওপর হামলা হচ্ছে, এমনকি বিক্ষোভে তাদের ২ জন নিহত হয়েছেন।

ময়মনসিংহের ভালুকার ছাত্রদল কর্মী শরিফুল ইসলাম বলেন, 'বিএনপির শক্তি রয়েছে একাই আন্দোলন করার। তাহলে আমরা কেন অন্যের ওপর নির্ভর করে থাকব? জামায়াতের সঙ্গে থাকায় আমরা দীর্ঘদিন ধরে সমালোচিত হয়েছি। যত তাড়াতাড়ি এই সম্পর্ক ছিন্ন করব, ততই দলের জন্য মঙ্গল হবে।'

বিএনপি সূত্র জানায়, জামায়াতের সঙ্গে সম্পর্ক রাখায় দলটি দেশে ও আন্তর্জাতিকভাবে ব্যাপক সমালোচনার সম্মুখীন হয়।

২০১৩ সাল থেকে যুদ্ধাপরাধের জন্য জামায়াতের বেশ কয়েকজন শীর্ষ নেতাকে মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হয়েছিল এবং নির্বাচন কমিশনে দলটির নিবন্ধনও বাতিল হয়েছে।

তবে তারা বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামী নামে সাংগঠনিক কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছে।

জামায়াতের সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্ন করতে বিএনপির অভ্যন্তরীণ চাপ রয়েছে। এমনকি যখন বামপন্থীসহ অন্যান্য রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে বিএনপি জোট করতে চেয়েছিল, তখন বিএনপি-জামায়াত সম্পর্ক নিয়ে প্রশ্ন উঠেছিল।

তাই, দলের শীর্ষস্থানীয়রা নীতিগতভাবে সিদ্ধান্ত নিয়েছে যে জামায়াত যদি বিএনপির সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্ন করতে চায়, তবে তারা এই সিদ্ধান্তকে  স্বাগত জানাবে। তবে আনুষ্ঠানিক কোনো ঘোষণা দেবে না।

গত রোববার রাতে বিএনপির সর্বোচ্চ নীতিনির্ধারণী পরিষদ স্থায়ী কমিটির বৈঠকে জামায়াতের আমিরের বক্তব্য নিয়ে আলোচনা হয় এবং এতে অনেক নেতাই আনন্দ প্রকাশ করেন বলে বৈঠকের অভ্যন্তরীণ সূত্র জানিয়েছে।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক বিএনপির স্থায়ী কমিটির একজন সদস্য দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, '(জামায়াত আমিরের) এই বক্তব্য আমাদের অবস্থান পরিষ্কার করে। যখন একযোগে আন্দোলন শুরু হবে, তখন জোট স্বয়ংক্রিয়ভাবে ভেঙে যাবে।'

২০১৮ সাল থেকে ২০ দলীয় জোট কোনো কর্মসূচি পালন করেনি। তবে বিএনপি নিজেদের মতো করে বিক্ষোভ করেছে এবং জামায়াত ছাড়া বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের সঙ্গে ধারাবাহিক বৈঠক করেছে।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক বিএনপির আরেক জ্যেষ্ঠ নেতা বলেন, 'জোট দীর্ঘদিন নিষ্ক্রিয় ছিল, এখন আর সক্রিয় হবে না।'

গতকাল জোটের বিষয়ে জামায়াতের অবস্থান সম্পর্কে জানতে চাইলে দলটির প্রচার সম্পাদক মতিউর রহমান আকন্দ বলেন, 'বিষয়টি নিয়ে দলীয় বৈঠকে আলোচনা হয়েছে এবং আমির বলেননি যে আমরা জোট ছেড়েছি।'

আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল যুদ্ধাপরাধের বিচার শুরু করলে জামায়াতের সঙ্গে দূরত্ব বজায় রাখতে শুরু করে বিএনপি। ২০১৮ সালে যখন বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়াকে কারাগারে পাঠানো হয় এবং জামায়াতকে বিএনপির পক্ষ থেকে বিক্ষোভে পাওয়া না যায়, তখন দূরত্ব আরও বাড়ে।

গত সংসদ নির্বাচনের আগে বিএনপি ২০ দলীয় জোটকে কাটিয়ে জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট গঠন করলে তাদের সম্পর্ক সর্বকালের সর্বনিম্ন পর্যায়ে চলে যায়, যা জোটের অনেক অংশীদারকে ক্ষুব্ধ করে।

জামায়াতের সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্ন করেছে কি না এমন প্রশ্ন এড়িয়ে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য ইকবাল মাহমুদ টুকু বলেন, 'জামায়াতের আমির সব বলেছেন। আমরা জোটের ব্যানারে কোনো কর্মসূচি পালন করছি না।'

তিনি আরও বলেন, 'আমরা নিজেদের মতো করে কর্মসূচি পালন করছি এবং সবাই তা করবে।'

একই মত প্রকাশ করে বিএনপির অন্য কয়েকজন নেতা বলেছেন যে দলটি এখন বিরোধী শক্তির মধ্যে ঐক্যের দিকে বেশি মনোযোগ দিচ্ছে। তবে তারা বিশ্বাস করে যে জামায়াত ইস্যুটি এই লক্ষ্যে যেকোনো প্রচেষ্টায় বাধা।

গণসংহতি আন্দোলনের প্রধান সমন্বয়ক জোনায়েদ সাকি বলেন, 'বিএনপি বিষয়টি পরিষ্কার না করায় ওই যুগপৎ আন্দোলনের রূপ ও কৌশল নিয়ে কিছু প্রশ্ন রয়েছে।'

এক প্রশ্নের জবাবে সাকি বলেন, 'আমার পর্যবেক্ষণ হলো, বিএনপির একা চলার নীতি এবং জামায়াতের সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্ন করা হবে বাম দলগুলোর জন্য স্বস্তিদায়ক।'

জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের সরকার ও রাজনীতি বিভাগের অধ্যাপক আল মাসুদ হাসানুজ্জামান বলেন, 'বিএনপি একাই আন্দোলন করছে, কিন্তু সেই আন্দোলন এখনো গতি পায়নি।'

তিনি আরও বলেন, 'একটি যুগপৎ এবং সংগঠিত আন্দোলন চালাতে সঠিক নেতৃত্বের প্রয়োজন। সময়ই বলে দেবে, সেটা কীভাবে হবে।'

Comments