বাধা সত্ত্বেও খুলনার গণসমাবেশ সফল করতে প্রত্যয়ী বিএনপি নেতাকর্মীরা

শনিবার খুলনায় অনুষ্ঠেয় বিএনপির গণসমাবেশের একদিন আগেই এই অঞ্চলের ১৮টি রুটে বাস চলাচল বন্ধ রাখার ঘোষণা এসেছে। এর বাইরে বাড়ি বাড়ি তল্লাশি, নেতা-কর্মীদের আটক করা, প্রচারে বাধা দেওয়া ও মাইক ভাঙচুরসহ বিভিন্ন অভিযোগ আসছে বিএনপি নেতাকর্মীদের পক্ষ থেকে।
গত বুধবার নগরীর ডাকবাংলা এলাকায় সোনালী ব্যাংক চত্বরে সমাবেশস্থল পরিদর্শনে যাচ্ছেন বিএনপির কেন্দ্রীয় ও স্থানীয় নেতারা। ছবি: সংগৃহীত

শনিবার খুলনায় অনুষ্ঠেয় বিএনপির গণসমাবেশের একদিন আগেই এই অঞ্চলের ১৮টি রুটে বাস চলাচল বন্ধ রাখার ঘোষণা এসেছে। এর বাইরে বাড়ি বাড়ি তল্লাশি, নেতা-কর্মীদের আটক করা, প্রচারে বাধা দেওয়া ও মাইক ভাঙচুরসহ বিভিন্ন অভিযোগ আসছে বিএনপি নেতাকর্মীদের পক্ষ থেকে।

একইসঙ্গে বিএনপি নেতাদের পূর্বানুমানকে বাস্তব করে 'জনসমাগম ঠেকাতে' আজ শুক্রবার ভোর থেকে রোববার ভোর পর্যন্ত ৪৮ ঘণ্টার কর্মবিরতির ঘোষণা দিয়েছে বাংলাদেশ লঞ্চ লেবার অ্যাসোসিয়েশনের খুলনা শাখা।

কিন্তু সব বাধাবিপত্তি পেরিয়ে যেকোনো উপায়ে এই গণসমাবেশ সফল করার ব্যাপারে প্রত্যয় ব্যক্ত করেছেন বিএনপির কেন্দ্রীয় ও জেলা পর্যায়ের শীর্ষ নেতারা।

আগামীকাল দুপুরে নগরীর সোনালী ব্যাংক চত্বরে এই গণসমাবেশ অনুষ্ঠিত হওয়ার কথা আছে। সেখানে প্রধান অতিথির বক্তব্য দেবেন বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর। মহানগর বিএনপির আহ্বায়ক শফিকুল আলম মনার সভাপতিত্বে জাতীয় স্থায়ী কমিটির সদস্য গয়েশ্বর চন্দ্র রায়সহ অন্য কেন্দ্রীয় নেতারাও উপস্থিত থাকবেন।

এই গণসমাবেশ সফল করতে সব ধরনের বাধা সত্ত্বেও দিনরাত প্রচার-প্রচারণা, প্রস্তুতিসভা, লিফলেট বিতরণ ও প্রচার মিছিলে ব্যস্ত সময় পার করছেন দলের সর্বস্তরের নেতাকর্মী। ফলে খুলনায় বিএনপির রাজনীতিতে দীর্ঘদিন পর চাঙ্গাভাব ফিরে এসেছে।

আজ শুক্রবার সকাল থেকে খুলনার ১৮টি রুটে বাস চলাচল বন্ধ আছে। নগরের সোনাডাঙ্গা বাসস্ট্যান্ডের চিত্র। ছবি: হাবিবুর রহমান/স্টার

দলে ঐক্যের সুর

এরমধ্যে গতকাল বৃহস্পতিবার সংবাদ সম্মেলন করে প্রায় ১১ মাস পর দলের কর্মসূচিতে যোগ দেওয়ার ঘোষণা দেন খুলনা মহানগর বিএনপির সাবেক সভাপতি নজরুল ইসলাম মঞ্জু, সাবেক সাধারণ সম্পাদক ও সাবেক সিটি মেয়র মনিরুজ্জামান মনিসহ ৫ থানা ও নগর বিএনপির সাবেক নেতারা। পরে গণসমাবেশ সফল করতে নগরীতে লিফলেট বিতরণ করেন তারা।

এর আগে ২০২১ সালের ৯ ডিসেম্বর খুলনা মহানগর বিএনপির ৩ সদস্যের আহ্বায়ক কমিটি ঘোষণা হলে বাদ পড়েন মঞ্জু ও তার অনুসারীরা। দলের এই সিদ্ধান্ত পুনর্বিবেচনার দাবি জানিয়ে সংবাদ সম্মেলন করেন তিনি। এর পরিপ্রেক্ষিতে ২৫ ডিসেম্বর তাকে বিভাগীয় সাংগঠনিক সম্পাদকের পদ থেকে অব্যাহতি দেওয়া হয়। এই সিদ্ধান্তের প্রতিবাদে খুলনা মহানগর বিএনপির সহসভাপতি, যুগ্মসম্পাদক, ৫ থানার সভাপতি-সাধারণ সম্পাদক এবং ওয়ার্ড কমিটির প্রায় ৫ শতাধিক নেতা পদত্যাগ করেন।

গতকালের সংবাদ সম্মেলনে নজরুল ইসলাম মঞ্জু বলেন, 'বিএনপির জাতীয় কর্মসূচি ঘোষণা করা হয়েছে। দলের মহাসচিব পার্টির কর্মসূচি সফল করার জন্য আহ্বান জানিয়েছেন। দলের নেতাকর্মী ও জনগণকে নিয়ে যেন এই কর্মসূচি সফল হয় তার জন্য কাজ করতে বলেছেন। মহাসচিবের এই আহ্বানে সাড়া দিয়ে আমরা ২ দিন বৈঠক করেছি। বৈঠকগুলো থেকে আসা প্রস্তাবনা আমরা মহাসচিবকে জানিয়েছি।'

সমাবেশ সফল করতে কাজ করছে ১৮টি উপকমিটি

এদিকে আগামীকালের গণসমাবেশ সফল করতে কাজ করছে ১৮টি উপকমিটি। সমাবেশে ব্যাপক জনসমাগমের লক্ষ্যে গত কয়েক দিন ধরে নগরের বিভিন্ন ওয়ার্ড ও উপজেলায় প্রস্তুতি সভা, প্রচার-প্রচারণা, লিফলেট বিতরণ ও প্রচার মিছিল করা হয়েছে।

খুলনার এই গণসমাবেশের সমন্বয়কের দায়িত্ব পালন করছেন বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য গয়েশ্বর চন্দ্র রায়। দ্য ডেইলি স্টারকে তিনি বলেন, 'যেকোনো মূল্যে খুলনা বিভাগীয় গণসমাবেশ শতভাগ শান্তিপূর্ণভাবে অনুষ্ঠিত হবে। পরিবহন বন্ধ করে শহীদ জিয়ার সৈনিকদের দমিয়ে রাখা যায় না, যাবে না। এটা হবে গণমানুষের সমাবেশ, যা পরিণত হবে বিশাল জনসমুদ্রে।'

খুলনা জেলা বিএনপির সদস্য সচিব এস এম মনিরুল হাসান বাপ্পী দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, 'খুলনার ৯টি উপজেলা ও ২টি পৌরসভায় প্রস্তুতি সভা ও লিফলেট বিতরণ করতে গিয়ে অভূতপূর্ব সাড়া পেয়েছি আমরা। আওয়ামী সরকারের পতন আন্দোলনের ১ দফা দাবিতে রাজপথে নামতে সবাই প্রস্তুত। শুধু দলীয় নেতাকর্মীরা নয়, সাধারণ মানুষও মুখিয়ে আছে খুলনা বিভাগীয় গণসমাবেশে অংশ নেওয়ার জন্য।'

মহানগর বিএনপির আহ্বায়ক শফিকুল আলম মনার দাবি, সমাবেশকে কেন্দ্র করে বৃহস্পতিবার রাতে অভিযান চালিয়ে ৩৮ জনকে আটক করেছে পুলিশ। তিনি বলেন, 'আমাদের অনেক নেতাকর্মী ইতোমধ্যে খুলনায় এসে পৌঁছেছেন। বাস চলাচল বন্ধ থাকা সত্ত্বেও অনেকে বিভিন্ন উপায়ে খুলনায় আসার চেষ্টা করছেন।'

খুলনা থেকে কোনো বাস ছাড়েনি, বন্ধ লঞ্চ চলাচল

এর আগে চট্টগ্রামে বিএনপির প্রথম সমাবেশে যেতে বিক্ষিপ্ত হামলা ও বাধা দেওয়া হয়েছিল। এরপর ময়মনসিংহে হামলা ও বাধার সঙ্গে পূর্ব ঘোষণা ছাড়াই সড়কপথে সব ধরনের যানবাহন চলাচল বন্ধ করে দেওয়া হয়েছিল। এবার খুলনায় সমাবেশের ২ দিন আগেই বাস চলাচল বন্ধ রাখার ঘোষণা আসে।

বাস চলাচল বন্ধ থাকায় বিপাকে সাধারণ যাত্রীরা। ছবি: হাবিবুর রহমান/স্টার

এক্ষেত্রে অভিনব কৌশল নেয় 'খুলনা জেলা বাস, মিনিবাস, কোচ, মাইক্রোবাস মালিক সমিতি'। বুধবার দুপুরে সংগঠনটি এক বিজ্ঞপ্তিতে জানায়, 'সড়ক ও মহাসড়কে অবৈধভাবে নছিমন, করিমন, মাহেন্দ্র, ইজিবাইক ও বিআরটিসির গাড়ি চলাচল করছে। আগামী ২০ অক্টোবরের মধ্যে প্রশাসন যদি সড়কে ওই অবৈধ যান চলাচল ও কাউন্টার বন্ধ না করে, তাহলে পরবর্তী দুই দিন ২১ ও ২২ অক্টোবর মালিক সমিতির সব রুটের গাড়ি বন্ধ থাকবে।'

তবে নাম প্রকাশ না করার শর্তে বাস মালিক সমিতির একাধিক নেতা দ্য ডেইলি স্টারকে জানান, সব রুটের গাড়ি চলাচল বন্ধ রাখার সিদ্ধান্তে মালিক সমিতির সবাই একমত না হলেও কার্যত 'রাজনৈতিক চাপে' তারা বাস চলাচল বন্ধ রাখার ঘোষণা দিতে বাধ্য হয়েছেন।

মহানগর বিএনপির আহ্বায়ক শফিকুল আলম মনার ভাষ্য, 'আওয়ামী লীগ নেতাদের নির্দেশেই বাস চলাচল বন্ধ করে খুলনাকে সারাদেশ থেকে বিচ্ছিন্ন করা হয়েছে।' একইসঙ্গে সমাবেশে লোকসমাগম ঠেকাতে লঞ্চ চলাচল বন্ধ করার আশঙ্কাও ব্যক্ত করেন তিনি।

তার এ আশঙ্কাকে সত্য করে সকাল ১১টায় এই প্রতিবেদন লেখার সময়েই খুলনা থেকে সব ধরনের লঞ্চ চলাচল বন্ধের খবর আসে।

বেলা ১২টায় খুলনার বিআইডব্লিউটিএ ঘাট থেকে এই প্রতিবেদক জানান, সকালের পর ঘাট থেকে কোনো লঞ্চ ছেড়ে যায়নি।

লঞ্চ চলাচলও বন্ধ। ছবি: স্টার

এ বিষয়ে বাংলাদেশ নৌযান শ্রমিক ফেডারেশনের বিভাগীয় সহ-সভাপতি ও বাংলাদেশ লঞ্চ লেবার অ্যাসোসিয়েশন খুলনা জেলা শাখার সাংগঠনিক সম্পাদক মোহাম্মদ দেলোয়ার হোসেন ডেইলি স্টারকে বলেন, 'আমরা শ্রমিকরা মালিকদেরকে বিভিন্ন সময়ে আমাদের সমস্যা নিয়ে দাবি-দাওয়া উত্থাপন করেছি। কিন্তু, তারা কর্ণপাত করেনি। তাই ১০ দফা দাবিতে ৪৮ ঘণ্টার কর্মবিরতি ডাকতে বাধ্য হয়েছি।'

তবে, বিএনপির সমাবেশের সঙ্গে তাদের কর্মবিরতির কোনো সম্পৃক্ততা নেই বলে দাবি করেন মোহাম্মদ দেলোয়ার হোসেন।

এ ছাড়া বাস মালিক সমিতির পূর্বঘোষণা অনুসারে সমাবেশের আগের দিন আজ শুক্রবার সকালে শহর থেকে কোনো বাসও ছেড়ে যায়নি। আশপাশের জেলাগুলো থেকেও কোনো যাত্রীবাহী বাস আসতে দেখা যায়নি। এতে বিপাকে পড়েছেন সাধারণ যাত্রীরাও।

সকালে নগরীর ফুলবাড়ী গেট, দৌলতপুর, নতুন রাস্তার মোড়, শিববাড়ি মোড়, ফেরিঘাট, রয়েল চত্বর, গল্লামারী ও সোনাডাঙ্গা বাস স্ট্যান্ড ঘুরে কোথাও কোনো বাস চলাচল করতে দেখা যায়নি। কাউন্টারগুলোও বন্ধ আছে।

সোনাডাঙ্গা বাসস্ট্যান্ড থেকে স্বল্প ও দূরপাল্লার ১৮ রুটে বাস চলাচল করে। দেখা যায়, বাসস্ট্যান্ডের ভেতর কয়েক শ গাড়ি দাঁড়িয়ে আছে। শ্রমিকরা অলস সময় কাটাচ্ছেন। কেউ কেউ ক্রিকেট খেলা ও বাস মেরামতের কাজে ব্যস্ত।

সোনাডাঙ্গা বাসস্ট্যান্ডে ক্রিকেট খেলে সময় পার করছেন পরিবহন শ্রমিকরা। ছবি: স্টার

এই বাসস্ট্যান্ড এলাকার খুলনা-ঢাকা রুটে চলাচলকারী সেবা গ্রিন লাইন পরিবহনের কর্মী ইমরান শেখ মুন্না দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, 'আজ এবং আগামীকাল আমাদের কোনো বাস খুলনা ছেড়ে যাবে না এবং আসবেও না। আগামীকাল (শুক্রবার) বিকেল ৫টার পর হয়তো আবার সব চালু হবে।'

কথা হয় খুলনার বটিয়াঘাটা থেকে আসা ঠাকুর প্রসাদ রায় নামের এক মৎস্যচাষির সঙ্গে। যশোরের দড়াটানা এলাকায় মাছের পোনা কিনতে যাওয়ার কথা ছিল তার। তিনি বলেন, 'স্ট্যান্ডে এসে দেখি বাস বন্ধ। বটিয়াঘাটা থেকে ইজিবাইকে এসেছি। এখন দেখি ট্রেনে যাওয়া যায় কি না।'

বিপাকে চাকরির পরীক্ষার্থীরা

আজ শুক্রবার সকাল ১০টা থেকে ১১টা পর্যন্ত সমাজসেবা অধিদপ্তরের ইউনিয়ন সমাজকর্মী পদে পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হয়েছে। এই পরীক্ষায় খুলনা থেকে আবেদন করেন ১৩ হাজার ৩৭৬ জন প্রার্থী। খুলনা শহরের ১৩টি কেন্দ্রে তাদের পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হয়েছে।

কিন্তু বাস চলাচল বন্ধ থাকায় আশপাশের উপজেলা থেকে খুলনায় আসার ক্ষেত্রে বিপাকে পড়েন এসব আবেদনকারীরা।

এ কারণে অনিমেষ বাইন নামের একজন আবেদনকারী পরীক্ষায় অংশ নেওয়ার সুযোগও পাননি। মোবাইলে ডেইলি স্টারকে তিনি বলেন, 'আমার বাড়ি থেকে খুলনা শহরের দূরত্ব প্রায় ১০০ কিলোমিটার। ভেবেছিলাম পরীক্ষার দিন সকালে চলে আসব। কিন্তু বাস বন্ধ থাকায় আসতে পারিনি। রাজনৈতিক পরিস্থিতি বিবেচনায় মটরসাইকেলে আসার সাহসও পাইনি।'

 

Comments