গায়েবি মামলা কী এবং কেন

'মরে গিয়েও রেহাই নেই' শিরোনামে ২০১৮ সালের ১৩ অক্টোবর দ্য ডেইলি স্টারে একটি প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়। তাতে বলা হয়, জাহাঙ্গীর আলম মারা গেছেন দেড় বছর আগে, এক বছর আগে মনসুর আলী এবং তার ৬ মাস পর জিল্লুর রহমান। কিন্তু তারপরও তাদের বিরুদ্ধে যানবাহন ভাঙচুর এবং রাষ্ট্রবিরোধী ষড়যন্ত্রের মামলা দিয়েছে পুলিশ।

প্রতিবেদনে বলা হয়, ওই ৩ জন ছাড়াও গত কয়েক মাসে রাজধানীর চকবাজার, কেরানীগঞ্জ ও যশোরে একজন করে এবং হবিগঞ্জে ২ জনসহ মোট ৫ জনের বিরুদ্ধে একই ধরনের মামলা দেওয়া হয়, যারা বহু আগেই মারা গেছেন বলে বিভিন্ন গণমাধ্যমে সংবাদ প্রকাশিত হয়েছে।

ডয়চে ভেলে 'গায়েবি, মিথ্যা ও অজ্ঞাত পরিচয় মামলা' শিরোনামে ২০১৯ সালের ১ এপ্রিল একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করে।

প্রতিবেদনে বলা হয়, ২০১৮ সালের ২৩ সেপ্টেম্বর বাংলাদেশ বার কাউন্সিলের সাবেক ভাইস চেয়ারম্যান খন্দকার মাহবুব হোসেন, সাবেক মন্ত্রী নিতাই রায় চৌধুরী ও বিএনপির আইন বিষয়ক সম্পাদক সানাউল্লাহ মিয়া হাইকোর্ট বিভাগে একটি রিট করেন৷ রিট আবেদনে বলা হয়, ২০১৮ সালের ১ থেকে ২০ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত দেশের বিভিন্ন থানায় বিএনপিসহ বিরোধী রাজনৈতিক নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধে ৩ হাজার ৭৩৬টি গায়েবি মামলা দায়ের করেছে আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী৷ এসব মামলায় আসামি করা হয়েছে ৩ লাখ ১৩ হাজার ১৩০ জনকে৷ আর অজ্ঞাতনামা আসামি করা হয়েছে কয়েক হাজার৷

শুনানির সময় আদালতে আইনজীবীরা বলেন, ১০ বছর আগে মারা গেছেন এমন মানুষকেও এসব মামলায় আসামি করা হয়েছে৷ ২০০৭ সালে মারা গেছেন এমন ব্যক্তিও আছেন আসামি তালিকায়৷ কয়েকটি মামলার এজাহার পর্যবেক্ষণ করে হাইকোর্ট বলেন, 'এ ধরনের মামলায় (গায়েবি) পুলিশের ভাবমূর্তি ও বিশ্বাসযোগ্যতা নষ্ট হয়৷'

বিচারপতি মইনুল ইসলাম চৌধুরী ও বিচারপতি মো. আশরাফুল কামালের বেঞ্চ ওই রিটের ওপর বিভক্ত আদেশ দেন৷ পরবর্তীতে তৃতীয় বেঞ্চে রিটটি খারিজ হয়ে যায়।

আইনজীবীরা বলছেন, সাধারণত নির্বাচনের আগে এসব গায়েবি মামলা বেড়ে যায়। মূলত রাজনৈতিক প্রতিপক্ষকে দমন-নিপীড়নের জন্য এসব মামলা করা হয় এবং দিন দিন এসব মামলার সংখ্যা বাড়ছে।

সুপ্রিম কোর্টের জ্যেষ্ঠ আইনজীবী আহসানুল করিম দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, 'গায়েবি মামলাগুলো মূলত উদ্দেশ্য প্রণোদিতভাবে করা হয়। এই মামলাগুলো আগে কম ছিল এক-এগারোর সময় থেকে এই মামলাগুলো বাড়তে শুরু করেছে। দিনে দিনে আরও বাড়ছে। মানুষের সহনশীলতা কমে যাচ্ছে। ব্যক্তিগতভাবে হোক বা রাজনৈতিকভাবে হোক মানুষের হিংসা বাড়ছে। বৈষম্য বাড়ছে। মিথ্যা মামলা অতীত কাল থেকেই ছিল। তবে আধুনিক বিশ্বে এই মামলাগুলো কাম্য নয়।'

এই আইনজীবী আরও বলেন, 'রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে নির্বাচন যত ঘনিয়ে আসে এই ধরনের মামলা বেড়ে যায়। মামলাগুলো হয়রানি করার জন্য করা হয়। এই হয়রানির মাধ্যমে রাজনৈতিক সুবিধা পাওয়া যায়। প্রতিপক্ষকে ঘায়েল করার সবচেয়ে সুবিধা হচ্ছে এই মিথ্যা মামলা। মামলার উদ্দেশ্য হলো প্রতিপক্ষকে মোকাবিলা থেকে বিরত রাখা। মামলার কারণে প্রতিপক্ষ পালিয়ে থাকেন বা জেলে থাকেন এই সময়টিতে রাজনৈতিক নানা সুবিধা হাসিল করা যায়।'

তার ভাষ্য, 'সময় যত যাচ্ছে আমরা মন্দ কিছু শিখছি। ২০০৮ সালের নির্বাচনের সময়ের তুলনায় ২০১৪ সালে এসব মামলা বেশি হয়েছে এবং ২০১৮ সালে মামলার সংখ্যা আরও বেড়ে গেছে। এখনো এসব মামলা হচ্ছে।'    

অধিকাংশ গায়েবি মামলার বাদী কারা হয় জানতে চাইলে আহসানুল করিম বলেন, 'রাজনৈতিক প্রতিপক্ষরা অধিকাংশ মামলার বাদী হয়। যাদের অবস্থানকে ভীতির কারণ মনে হয়, তাদের বিরুদ্ধে এই মামলাগুলো দেওয়া হয়। রাজনৈতিক বিরোধী শক্তিকে সহজে মোকাবিলা করার জন্য এই মামলাগুলো হয়। পুলিশও অধিকাংশ মামলার বাদী হয়।'

'এই মামলাগুলোর ফলে সামাজিক ও অর্থনৈতিক ক্ষতি হয়। এই মামলা মোকাবিলা করতে গিয়ে রাষ্ট্রের সময় নষ্ট হয়। কোর্টের সময় নষ্ট হয়। উকিল নিয়োগ করতে হয়। এতে রাষ্ট্রের অর্থনৈতিক ক্ষতি হয়। ব্যক্তির সবচেয়ে বেশি ক্ষতি হয়। ব্যক্তির অর্থনৈতিক ক্ষতি হয়। এসব গায়েবি মামলার কারণে সামাজিক ভারসাম্য, নৈতিকতা নষ্ট হয়। এসব মামলার কারণে জাতির স্বচ্ছতা, ভাবমূর্তি, চেতনা ক্ষুণ্ণ হয়,' বলেন তিনি।

সুশাসনের জন্য নাগরিকের (সুজন) সম্পাদক বদিউল আলম মজুমদার ডেইলি স্টারকে বলেন, 'গায়েবি মামলাগুলো করা হয় রাজনৈতিকভাবে হয়রানির জন্য, দমন নিপীড়নের জন্য। নির্বাচনের সময় এসব মামলা বেড়ে যায়। রাজনৈতিক প্রতিপক্ষকে ঘায়েল করার জন্য এসব মামলা দেওয়া হয়।'

'এসব মামলার ফলে মানুষের গণতান্ত্রিক অধিকার ক্ষুণ্ণ হয়। এই মামলাগুলো মানুষের অধিকার হরণের জন্য করা হয়। গায়েবি মামলার কারণে সংবিধানে যেসব মৌলিক অধিকার আছে সেগুলো ক্ষুণ্ণ হয়,' যোগ করেন তিনি।

Comments

The Daily Star  | English

Banks see sluggish deposit growth as high inflation weighs on savers

Banks have registered sluggish growth in deposits throughout the current fiscal year as elevated inflation and an economic slowdown have squeezed the scope for many to save, even though the interest rate has risen.

15h ago