ঢাকা আজ সমাবেশের নগর
দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে রাজনৈতিক অঙ্গন উত্তপ্ত হয়ে ওঠার মধ্যে আজ শুক্রবার ঢাকায় মহাসমাবেশ ও সমাবেশ করতে যাচ্ছে বিএনপি এবং ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের ৩ সংগঠন।
এই মহাসমাবেশ ও সমাবেশ ঘিরে উত্তেজনা যাতে সংঘাতের দিকে না গড়ায়, সে কারণে পুলিশ ২ পক্ষকেই বেঁধে দিয়েছে ২৩টি শর্ত।
এর বাইরে আজ ঢাকায় মহাসমাবেশ করছে ১২ দলীয় জোটসহ অন্যান্য দল ও জোটও।
বিএনপি সমাবেশ করবে নয়াপল্টনে দলীয় কার্যালয়ের সামনে। সরকার পতনের দাবিতে দুপুর ২টা থেকে শুরু হওয়ার কথা এই মহাসমাবেশ।
অন্যদিকে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের ৩ সহযোগী সংগঠনের 'শান্তি' সমাবেশ হবে নয়াপল্টন থেকে দেড় কিলোমিটার দূরত্বের বায়তুল মোকাররম মসজিদের দক্ষিণ ফটকে। এই সমাবেশ শুরু হওয়ার কথা বিকেল ৩টা থেকে।
এর বাইরে একই সময়ে বিজয়নগরের পানির ট্যাংকির সামনে মহাসমাবেশ করার কথা আছে ১২ দলীয় জোটের। এ ছাড়া জাতীয়তাবাদী সমমনা জোট দুপুর ১১টায় আল রাজি কমপ্লেক্সের সামনে, গণফোরাম ও পিপলস পার্টি বিকেল ৩টায় নটরডেম কলেজের সামনে, গণতন্ত্র মঞ্চ বিকেল ৩টায় মৎস্য ভবনের সামনে ও গণঅধিকার পরিষদ বিকেল ৩টায় কালভার্ট রোড কেন্দ্রীয় কার্যালয়ের সামনে সমাবেশ করবে।
সেইসঙ্গে অলি আহমেদের নেতৃত্বাধীন এলডিপি বিকেল ৩টায় এফডিসির সামনে, গণ অধিকার পরিষদ (রেজা কিবরিয়া) বিকেল ৪টায় প্রেসক্লাবের সামনে, লেবার পার্টি বিকেল সাড়ে ৩টায় বিজয় নগর পানির ট্যাংকি এলাকায়, গণতান্ত্রিক বাম ঐক্য সকালে সাড়ে ১০টায় প্রেসক্লাবের সামনে, এনডিএম বিকেল ৩টায় মালিবাগ মোড় হোসাফ টাওয়ার সংলগ্ন এলাকায় এবং সমমনা পেশাজীবী গণতান্ত্রিক জোট প্রেসক্লাবের সামনে সকাল ১০টায় সমাবেশ করবে।
প্রেক্ষাপট ও নাটকীয়তা
বিএনপির মহাসমাবেশ হওয়ার কথা ছিল গতকাল বৃহস্পতিবার। সেজন্য নয়াপল্টন অথবা সোহরাওয়ার্দী উদ্যান চেয়েছিল দলটি। এর পাল্টা কর্মসূচি হিসেবে আওয়ামী লীগের ৩ সহযোগী সংগঠন যুবলীগ, স্বেচ্ছাসেবক লীগ ও ছাত্রলীগ বৃহস্পতিবার বায়তুল মোকাররমের দক্ষিণ গেটে 'শান্তি' সমাবেশ করার ঘোষণা দেয়।
তবে বৃহস্পতিবার কর্মদিবস হওয়ায় শুরুতে ঢাকা মহানগর পুলিশ কোনো দলকেই অনুমতি দেয়নি। বিএনপিকে সমাবেশের জন্য গোলাপবাগ মাঠ ব্যবহারের পরামর্শ দেওয়া হয় পুলিশের পক্ষ থেকে।
এমন পরিস্থিতে বুধবার রাতে বিএনপির স্থায়ী কমিটির বৈঠকে কর্মসূচি এক দিন পেছানোর সিদ্ধান্ত হয়। বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর ঘোষণা দেন, বৃহস্পতিবার নয়, তারা মহাসমাবেশ করবেন শুক্রবার দুপুর ২টায়। আর সেটা নয়াপল্টনে দলের কেন্দ্রীয় কার্যালয়ের সামনেই হবে।
তখন যুবলীগও জানায়, তাদের ৩ সংগঠনের 'শান্তি' সমাবেশ একদিন পিছিয়ে শুক্রবার বিকেল ৩টায় নেওয়া হয়েছে। সমাবেশের ভেন্যু হিসেবে শেরেবাংলা নগরে পুরাতন বাণিজ্য মেলা মাঠের কথা বলে তারা।
তবে বৃহস্পতিবার আবারও সেই সিদ্ধান্তে পরিবর্তন আনে যুবলীগ। জানানো হয় শুক্রবার বায়তুল মোকাররম মসজিদের দক্ষিণ ফটকে শান্তি সমাবেশ করার জন্য আবারও অনুমতি চেয়েছে তারা।
আর এদিন দুপুরে কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে সংবাদ সম্মেলন করে বিএনপির জ্যেষ্ঠ যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী জানান, শুক্রবার দুপুর ২টায় নয়াপল্টনে বিএনপির কেন্দ্রীয় কার্যালয়ের সামনেই মহাসমাবেশ করবেন তারা।
মহাসমাবেশের জন্য পুলিশের কাছ থেকে অনুমতি পাওয়া গেছে কি না—সংবাদ সম্মেলনে সাংবাদিকদের এমন প্রশ্নের জবাবে রিজভী তখন বলেন, 'আমরা পুলিশকে জানিয়েছি কাল সমাবেশ হবে। ঢাকা মহানগর নেতারা সমাবেশের প্রস্তুতি নেওয়া শুরু করেছেন।'
রিজভী ছাড়াও ওই সংবাদ সম্মেলনে উপস্থিত ছিলেন বিএনপি চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা কাউন্সিলের সদস্য আমান উল্লাহ আমান, কেন্দ্রীয় নেতা আবদুস সালাম আজাদ ও রফিকুল ইসলাম।
বিএনপির ৫ শতাধিক নেতাকর্মী গ্রেপ্তারের অভিযোগ
বিএনপির মহাসমাবেশ সামনে রেখে মঙ্গলবার থেকে ঢাকায় ৫ শতাধিক নেতাকর্মীকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে বলে ওই সংবাদ সম্মেলনে অভিযোগ করেন রুহুল কবির রিজভী।
তিনি বলেন, 'আমি আগেও বলেছি, যত বাধা দেবেন, যত গ্রেপ্তার করবেন, তত নেতাকর্মীদের মধ্যে ক্ষোভ তৈরি হবে। তারা আরও বেশি দলে দলে সমাবেশ সাফল্যমণ্ডিত করার চেষ্টা করবেন। গত ২৪ ঘণ্টায় আমাদের ৫ শতাধিক নেতাকর্মীকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। আমি গ্রেপ্তারকৃত সকল নেতৃবৃন্দের নিঃশর্ত মুক্তি দাবি করছি।'
বুধবার রাতে দলীয় কার্যালয়ের আশপাশের হোটেলগুলোতে পুলিশের তল্লাশি ও সেখান থেকে অনেককে গ্রেপ্তারের খবর জানিয়ে রিজভী আরও বলেন, 'এটা কি কোনো গণতান্ত্রিক আচরণ হলো? এটা কি কোনো সভ্য আচরণ হতে পারে?'
তিনি দাবি করেন, ওই রাতেই লালমাটিয়ার বাসা থেকে বিএনপিসহ সাংগঠনিক সম্পাদক কুদ্দুসুর রহমান আকন, ধানমন্ডির একটি বাসা থেকে ত্রাণ ও পুনর্বাসন বিষয়ক সম্পাদক শফিকুল ইসলাম মিলন, রাজশাহী যুবদলের আহ্বায়ক আনোয়ার হোসেন উজ্জ্বল, তানোর পৌরসভার সাবেক মেয়র মিজানুর রহমানসহ ৯ জন, ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের ২৬ নম্বর ওয়ার্ডের সাবেক কমিশনার মীর আশরাফ আলী আজম ও তার ছেলে ব্যারিস্টার মুরতার আলীকে বাসা থেকে 'পিটিয়ে বাড়িঘর ভাঙচুর করে' গ্রেপ্তার করা হয়েছে।
অবশ্য এই 'গণগ্রেপ্তারের' বিষয়ে জানতে চাইলে ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) কমিশনার খন্দকার গোলাম ফারুক দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, পুলিশ গণগ্রেপ্তার করছে না। যাদের বিরুদ্ধে মামলা আছে, কেবল তাদেরকেই গ্রেপ্তার করা হচ্ছে।
এদিকে বৃহস্পতিবার দুপুরে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল সচিবালয়ে সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে জানান, কাউকেই এখনো ঢাকায় সমাবেশ করতে অনুমতি দেওয়া হয়নি। অনুমতি দেওয়া হবে কি না সেই সিদ্ধান্ত নেবে ঢাকা মহানগর পুলিশ। আর অনুমতি দেওয়া হলে ২ দলের ক্ষেত্রেই একই শর্ত প্রযোজ্য হবে।
শান্তিপূর্ণ কর্মসূচি পালনে কোনো রাজনৈতিক দলের বাধা নেই মন্তব্য করে মন্ত্রী বলেন, 'সমাবেশ থেকে সহিংসতা হলে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী ব্যবস্থা নেবে।'
অবশেষে ২৩ শর্তে অনুমতি ২ পক্ষকেই
শেষ পর্যন্ত বৃহস্পতিবার বিকেল ৪টায় ঢাকার পুলিশ কমিশনার খন্দকার গোলাম ফারুক ডিএমপি মিডিয়া সেন্টারে এক সংবাদ সম্মেলনে এসে জানান, বিএনপি ও আওয়ামী লীগের ৩ সংগঠনকে একই দিনে তাদের পছন্দের জায়গায় সমাবেশ করার অনুমতি দেওয়া হয়েছে।
সংবাদ সম্মেলনে ডিএমপি কমিশনার বলেন, 'বিএনপি কাকরাইলের নাইটিঙ্গেল মোড় থেকে রাজারবাগ মোড় পর্যন্ত সমাবেশ করতে পারবে। আর আওয়ামী লীগের সহযোগী সংগঠনগুলো বায়তুল মোকাররমের দক্ষিণ গেট থেকে মহানগর নাট্যমঞ্চ পর্যন্ত সমাবেশ করবে। এই সীমানার মধ্যেই মাইক স্থাপন করতে পারবে তারা।'
সমাবেশ আয়োজনে ২ পক্ষকেই ২৩টি শর্ত বেঁধে দেওয়ার কথাও জানান তিনি সংবাদ সম্মেলনে।
এই শর্তগুলো হলো-
- মহাসমাবেশ/সমাবেশের জায়গা ব্যবহারের জন্য অবশ্যই সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের কাছ থেকে অনুমোদন নিতে হবে।
- অনুমোদিত জায়গাতেই সমাবেশ/মহাসমাবেশের যাবতীয় কার্যক্রম সীমাবদ্ধ রাখতে হবে।
- কোনো অবস্থাতেই অনুমোদিত জায়গার বাইরে কোনো ধরনের জনসমাগম করা যাবে না।
- নিরাপত্তার জন্য নিজস্ব ব্যবস্থাপনায় পর্যাপ্ত সংখ্যক স্বেচ্ছাসেবক (দৃশ্যমান আইডি কার্ডসহ) নিয়োগ করতে হবে।
- স্থানীয় পুলিশ প্রশাসনের নির্দেশনা অনুযায়ী নিজস্ব ব্যবস্থাপনায় সমাবেশ/মহাসমাবেশস্থলের চারদিকে উন্নত রেজ্যুলেশনযুক্ত সিসি ক্যামেরা স্থাপন করতে হবে।
- নিজস্ব ব্যবস্থাপনায় সমাবেশ/মহাসমাবেশে আগতদের হ্যান্ড হেন্ড মেটাল ডিটেক্টরের মাধ্যমে (ভদ্রোচিতভাবে) চেকিংয়ের ব্যবস্থা করতে হবে।
- নিজস্ব ব্যবস্থাপনায় অগ্নি নির্বাপণ ব্যবস্থা রাখতে হবে।
- শব্দদূষণ প্রতিরোধে সীমিত আকারে মাইক/শব্দযন্ত্র ব্যবহার করতে হবে, কোনোক্রমেই অনুমোদিত স্থানের বাইরে মাইক/শব্দযন্ত্র ব্যবহার করা যাবে না।
- অনুমোদিত জায়গার বাইরে প্রজেক্টর স্থাপন করা যাবে না।
- আযান, নামাজ ও অন্যান্য ধর্মীয় সংবেদনশীল সময় মাইক/শব্দযন্ত্র ব্যবহার করা যাবে না।
- ধর্মীয় অনুভূতির ওপর আঘাত আসতে পারে এমন কোনো বিষয়ে ব্যঙ্গচিত্র প্রদর্শন, বক্তব্য প্রদান বা প্রচার করা যাবে না।
- সমাবেশ/মহাসমাবেশের কার্যক্রম ছাড়া মঞ্চকে অন্য কোনো কাজে ব্যবহার করা যাবে না।
- সমাবেশ/মহাসমাবেশ শুরুর ২ ঘণ্টা আগে লোকজন সমবেত হওয়ার জন্য আসতে পারবে।
- অনুমোদিত সময়ের মধ্যে সমাবেশ/মহাসমাবেশের সার্বিক কার্যক্রম শেষ করতে হবে।
- কোনো অবস্থাতেই মূল সড়কে যানবাহন চলাচলে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করা যাবে না।
- আইন-শৃঙ্খলা পরিপন্থী ও জননিরাপত্তা বিঘ্নিত হয় এমন কার্যকলাপ করা যাবে না।
- রাষ্ট্রবিরোধী কোনো কার্যকলাপ ও বক্তব্য প্রদান করা যাবে না।
- উসকানিমূলক কোনো বক্তব্য প্রদান বা প্রচারপত্র বিলি করা যাবে না।
- কোনো ধরণের লাঠি-সোটা, ব্যানার-ফেস্টুন বহনের আড়ালে লাঠি, রড ব্যবহার করা যাবে না।
- আইন-শৃঙ্খলার অবনতি ও কোনো বিরূপ পরিস্থিতির সৃষ্টি হলে আয়োজনকারী কর্তৃপক্ষ দায়ী থাকবে।
- উল্লিখিত শর্তগুলো যথাযতভাবে পালন না করলে তাৎক্ষণিকভাবে এই অনুমতির আদেশ বাতিল বলে গণ্য হবে।
- জনস্বার্থে কর্তৃপক্ষ কোনো কারণ দর্শানো ব্যতিরেকে এই অনুমতি আদেশ বাতিল করতে পারবে।
Comments