চট্টগ্রামে কবরস্থানে উচ্ছেদ অভিযান ঘিরে রেল কর্মচারীদের প্রশ্ন ও ক্ষোভ

বাংলাদেশ রেলওয়ে পূর্বাঞ্চলের হালিশহর চট্টগ্রাম গুডস পোর্ট ইয়ার্ড (সিজিপিওয়াই) কবরস্থানে রেলওয়ে বিভাগীয় ভূসম্পদ কর্মকর্তার উচ্ছেদ অভিযানকে কেন্দ্র করে প্রশ্ন তুলেছেন রেলওয়ে কর্মকর্তা কর্মচারীরা।
বৃহস্পতিবার দুপরে চট্টগ্রাম নগরীর বন্দর থানার রেলওয়ে ট্রেনিং একাডেমি পাশে সিজিপিওয়াই রেলওয়ে কবরস্থানে অভিযান পরিচালনা করেন রেলওয়ের বিভাগীয় ভূসম্পদ কর্মকর্তা দীপংকর তঞ্চগ্যা। অভিযানে কবরস্থানের ভেতরে থাকা গোরখোদকের পরিবার নিয়ে থাকার একমাত্র ঘর এবং কবরস্থানের সীমানার বাইরে রেলওয়ে কর্মচারীদের করা তিনটি গরুর খামারের টিনশেড ঘর উচ্ছেদ করা হয়।
রেলওয়ে কর্মচারীদের অভিযোগ, সিজিপিওয়াই এলাকায় এবং রেলওয়ে ট্রেনিং একাডেমি সংলগ্ন অনেক অবৈধ স্থাপনা ঘরে উঠলেও সেগুলো না ভেঙে শুধুমাত্র টার্গেট করে কবরস্থানে উচ্ছেদ করে একটি বিশেষ গোষ্ঠীকে সুবিধা দিয়েছেন রেলওয়ের বিভাগীয় ভূসম্পদ কর্মকর্তা দীপংকর। কবরস্থানে উচ্ছেদের সময় গোরখোদকের থাকার জায়গাটি বাঁচাতে রেলওয়ের কর্মকর্তা-কর্মচারীরা গেলেও জোর করে সেটি ভেঙে দেওয়া হয়। ফলে এই নিয়ে সিজিপিওয়াই রেলওয়ে কর্মকর্তা-কর্মচারীদের মনে ক্ষোভ বিরাজ করছে।
গোরখোদকের বাসস্থানটি বাঁচাতে রেলওয়ে পূর্বাঞ্চলের মহাব্যবস্থাপক মো. সুবক্তগীন একাধিকবার দীপংকরকে ফোন করলেও তিনি ধরেননি বলে অভিযোগ উঠেছে। রেল কর্মকর্তারা-কর্মচারী বলছেন, নাকের ডগায় শত কোটি টাকার জায়গায় দিনের পর দিন বেদখল থাকলেও তা নিয়ে কোনো অভিযান পরিচালনা না করলেও এভাবে কবরস্থানে উচ্ছেদ অভিযান নানান প্রশ্নের জন্ম দিয়েছে।
রেলওয়ে সিআরবি অফিস এবং রেলওয়ে কর্মকর্তা-কর্মচারীর জানান, সিজিপিওয়াই এলাকায় একটি ইনল্যান্ড কনটেইনার ডিপো (আইসিডি) নির্মাণের জন্য রেলওয়ে কর্তৃপক্ষ সাইফপাওয়ারটেক নামের বেসরকারি কোম্পানিকে ২১ দশমিক ২৯ একর জমি লিজ দিয়েছে। সাইফ লজিস্টিকস এলায়েন্স এবং কনটেইনার কোম্পানি বাংলাদেশ লিমিটেডের মধ্যে এই চুক্তি সই হয়েছে। সেই লিজের জমিটিতে ইতোমধ্যেই একটি রেলওয়ে কর্মকর্তা-কর্মচারীদের পুরাতন কবরস্থান এবং একটি মসজিদ আছে এবং লিজ দেওয়ার পর এই নিয়ে সংবাদ প্রকাশ হলে এবং কর্মচারীদের বিক্ষোভের মুখে কবরস্থানে কিছু হবে না বলে সিদ্ধান্ত থেকে ২০২২ সালে সরে আসে রেল কর্তৃপক্ষ। একইসঙ্গে সেটি রক্ষণাবেক্ষণ করা হবে বলে আশ্বাস দেওয়া হয়।
চুক্তির পর ২০২২ সালের ১৪ জানুয়ারি সিসিবিএল ওই জায়গাটি সাইফ লজিস্টিকস এলায়েন্সের কাছে হস্তান্তর করে। তবে ২০২৩ সালের জুলাইয়ে এনবিআর থেকে সাইফের লজিস্টিকসের অব ডক লাইসেন্স বাতিল করে দেয়।
রেল সূত্রে জানা গেছে, ২১ দশমিক ২৯ একর জমির মধ্যে কবরস্থানটি প্রায় দশমিক ৬২৫০ একর এবং মসজিদটি প্রায় দশমিক ৩৪২৫ একর জায়গাজুড়ে অবস্থিত। এছাড়াও, সেখানে একটি পুরাতন মাজার রয়েছে। 'বাংলাদেশ রেলওয়ে সিজিপিওয়াই কবরস্থান' নামে পরিচিত প্রায় ৩২ বছর পুরোনো এই কবরস্থানে প্রায় ৪৫০টির অধিক কবর রয়েছে। এসবের পাশাপাশি ওই জমিতে তিনটি বড় জলাশয়ও রয়েছে।
সিজিপিওয়াই ইয়ার্ড মাস্টার এবং কবরস্থান কমিটির প্রধান আব্দুল মালেক দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, 'আমরা আগেও বলেছি আমরা ডিপোর বিপক্ষে না। তবে সেটি কবরস্থান এবং আমাদের ভাইদের লাশের ওপরে হবে না। আমাদের দাবির পরিপ্রেক্ষিতে তখন জানানো হয়েছে কবরস্থান বাদ দিয়ে যা করার করা হবে। কিন্তু কোনো নোটিশ ছাড়া বিভাগীয় ভূসম্পদ কর্মকর্তা সেখানে গিয়ে উচ্ছেদ করেছেন এই রোজার মাসে।'
'গরুর খামার উচ্ছেদে আমাদের বলার কিছু নেই। সেটি করা উচিত। কিন্তু আমরা কবরস্থানের রক্ষণাবেক্ষণকারী ও গোরখোদকের থাকার জায়গাটি মানবিক কারণ বিবেচনায় তাকে ভাঙতে মানা করেছিলাম। কিন্তু তিনি কথা শুনেননি,' বলেন তিনি।
'গত ২৫ বছর ধরে গোরখোদক এই কবরস্থানটির রক্ষণাবেক্ষণ করে আসছেন। এখন তার বাসা ভেঙে ফেলায় সে চলে যাবে বলে জানিয়েছে আমাদের। এখন মানুষ মারা গেলে কবর খোড়ার লোক পাওয়া যাবে না,' অভিযোগ করেন আব্দুল মালেক।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে একাধিক এলএম (ট্রেনচালক) ডেইলি স্টারকে বলেন, 'সিজিপিওয়াই এলাকায় রেলের জায়গা দখল বিএনপির অফিস, আওয়ামী লীগের অফিস, দোকানপাট বসেছে। অভিযানে সেগুলোর কিছুই করা হয়নি। উল্টো শুধু কবরস্থানে গিয়ে উচ্ছেদ করা মানে বিশেষ এজেন্ডা বাস্তবায়ন করা।'
'দেশের বিভিন্ন এলাকায় কবর থেকে লাশ চুরি হচ্ছে। এখন যদি এই কবরস্থান থেকে কারো লাশ চুরির ঘটনা হয়ে এর দায় কার', প্রশ্ন রাখেন তারা।
গত শুক্রবার দুপুরে কবরস্থানে গিয়ে দেখা যায়, উচ্ছেদের পর মাল জিনিস সরিয়ে নিচ্ছেন গোরখোদক সুলতানের পরিবার। কবরস্থানে উচ্ছেদের খবর শুনে সেখানে অনেক রেলওয়ে কর্মচারীরা দেখতে এসে ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন।
সুলতান ডেইলি স্টারকে বলেন, 'আমি কবর খোড়ার কাজ করি আজকে ২৫ বছরের বেশি সময় ধরে। এখানে আমি পরিবার নিয়ে থাকি। কবরস্থানের বেড়া, পরিষ্কার এবং পরিচ্ছন্নতার কাজ করে আমার সংসার চলে। আমি স্যারকে অনেক অনুরোধ করেছি। কিন্তু তিনি কারো কথাই শুনেননি। আমাকে জিনিস বের করার সুযোগ দেননি।'
বেসরকারি চাকরিজীবী মো. মাসুম বলেন, 'এখানে আমার মায়ের কবর রয়েছে। চট্টগ্রামে রেলের একক কবরস্থান বলতে এই সিজিপিওয়াই কবরস্থানটি এখন অবশিষ্ট আছে। পেশির জোড় দেখিয়ে এই ধরনের কাজ আসলেই কাম্য নয়। এর প্রতিবাদ জানাচ্ছি।'
রেলওয়ে সিআরবি ও সিজিপিওয়াইয়ের অবসরপ্রাপ্ত ও বর্তমান কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, ১৯৯৫ সালের দিকে এক রেলওয়ে কর্মচারী মারা গেলে তাকে 'বহিরাগত' বলে চট্টগ্রাম বন্দর কবরস্থানে দাফনে অস্বীকৃতি জানায় বন্দর কর্তৃপক্ষ। এতে বাধ্য হয়ে রেলওয়ের কর্মচারীরা যেখানে বর্তমানে কবরস্থান সেখানে দাফন করেন। সে সময় এটি শুধুই একটি জঙ্গল ও পরিত্যক্ত জলাভূমি ছিল। পরবর্তীতে, রেলওয়ে কর্মচারীরা ধীরে ধীরে এটি একটি কবরস্থানে রূপান্তর করেন।
উচ্ছেদের বিষয়ে জানতে চাইলে ভূসম্পদ কর্মকর্তা দীপংকর বলেন, 'আমি শুধু ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের আদেশ মেনেছি'। পরে তিনি মহাব্যবস্থাপকের সঙ্গে কথা বলতে বলে কল কেটে দেন।
কবরস্থানে উচ্ছেদের বিষয়ে জানতে চাইলে রেলওয়ে পূর্বাঞ্চলের মহাব্যবস্থাপক মো. সুবক্তগীন ডেইলি স্টারকে বলেন, 'গোরখোদকের বাসস্থান উচ্ছেদের বিষয়টি দুঃখজনক। অভিযান চলার সময় আমাকে ওখান থেকে জানালে আমি মানবিক দিক বিবেচনায় তাকে ফোন করেছিলাম একাধিকবার। তবে তখন তিনি ফোন রিসিভ করেননি। আমরা বিষয়টি দেখছি।'
Comments