বিছানায় পাশ ফিরলেই অন্য দেশ

এই শহরের ঘরবাড়ি, রেস্তোরাঁ-ক্যাফে, জাদুঘর এমনকি গ্যালারির মাঝখানেও আছে দুই দেশ বিভক্তকারী সীমানারেখা।
এই শহরের ঘরবাড়ি, রেস্তোরাঁ-ক্যাফে, জাদুঘর এমনকি গ্যালারির মাঝখানেও আছে দুই দেশ বিভক্তকারী সীমানারেখা। ছবি: স্টার অনলাইন গ্রাফিক্স/আনোয়ার সোহেল

বাড়ি একটাই, অথচ রান্নাঘর এক দেশে আর শোবার ঘর পড়েছে অন্য দেশের সীমান্তে। এমনই বিচিত্র পরিস্থিতি দেখা যায়, বেলজিয়াম ও নেদারল্যান্ডসের সীমান্ত শহর বার্লেতে।

লাল ইটের ঘর, বড় বড় শস্যাগার, পরিপাটি রাস্তা—প্রথম দেখায় বেলজিয়াম ও নেদারল্যান্ডসের অন্য কোনো শহর থেকে বার্লেকে আলাদা মনে হবে না। তবে এই শহরের ঘরবাড়ি, রেস্তোরাঁ-ক্যাফে, জাদুঘর এমনকি গ্যালারির মাঝখানেও আছে দুই দেশ বিভক্তকারী সীমানারেখা। সঠিক অবস্থান বুঝতে শহরজুড়ে সাদা ক্রস দিয়ে চিহ্নিত করা হয়েছে, যাকে বলে বার্লে শহরের ট্রেডমার্ক।

ধরুন, আপনি ড্রয়িং রুমে বসে টিভি দেখছেন। হঠাৎ জানতে পারলেন আপনি যে চেয়ারে বসে আছেন সেটির অবস্থান এক দেশে আর টেলিভিশন সেটের অবস্থান আরেক দেশে। একই বিছানায় পাশ ফিরলে অন্য দেশের সীমান্তের ভেতরে এসে পড়া কিংবা বাড়ি থেকে বের না হয়ে এক দেশে রান্না করে অন্য দেশে খেতে পারা শুধু এই শহরেই সম্ভব।

ছবি: সংগৃহীত

কেন এই জটিল সীমানা?

একটি স্থানীয় ট্যুরিস্ট অফিসের প্রধান উইলেম ভ্যান গুল জানান, ১১৯৮ সালে ব্রাবান্টের প্রথম ডিউক হেন্ড্রিক বার্ল অঞ্চলের জমি ইজারা দিয়েছিলেন ব্রেডার লর্ডের কাছে। কিন্তু তাকে কেবল সেই জমিগুলো নেওয়ার অনুমতি দেওয়া হয়েছিল যা কৃষিকাজের জন্য তখনো ব্যবহার করা হয়নি। ডিউক নিজের মালিকানায় সেসব জমি রেখে দিয়েছিলেন যা আগে থেকেই চাষ করা হয়েছিল। ফলে জমির মালিকানা চলে যায় দুজনের অধীনে।

১৮৩০ সালে বেলজিয়াম স্বাধীনতা ঘোষণা করার পর নেদারল্যান্ডসের সঙ্গে সীমানা স্থাপনের প্রয়োজন হয়। সেসময় বিশ্লেষকরা উত্তর সাগরের উপকূল থেকে জার্মান রাজ্যগুলোর সীমানা পর্যন্ত ধাপে ধাপে কাজ করেছেন। কিন্তু তারা বার্লে শহরের সীমানা নির্ধারণ করেননি।

জটিলতার মধ্যেই কেটে যায় ১৬৫ বছর। সমাধান আসে ১৯৯৫ সালে। সিদ্ধান্ত হয় এই শহরে দুটি পৌরসভা প্রতিষ্ঠিত হবে। বেলজিয়ামের পৌরসভার নাম হবে বার্লে হারতগ এবং নেদারল্যান্ডসের পৌরসভার নাম হবে বার্লে নাসাউ।

এই শহরে মোট ৩০টি ছিটমহল রয়েছে। এর মধ্যে নেদারল্যান্ডসের ভেতরে ২২টি বেলজিয়ান ছিটমহল, আবার সেই ২২টি বেলজিয়ান অংশের ভেতরে আছে ৭টি ডাচ ছিটমহল এবং বেলজিয়াম সীমান্তের ভেতরে আছে ১টি ডাচ ছিটমহল।

ছবি: সংগৃহীত

জাতীয়তা নির্ধারিত হয় কীভাবে? 

ছিটমহল নির্ধারণ করেও এই শহরের সমস্যা সমাধান করা যায়নি। বার্লের অনেক রাস্তা, পার্ক, পার্কিং স্পট, দোকান, গ্যালারি এমনকি বাসাবাড়িও আছে যার অর্ধেকটা বেলজিয়ামের অংশ এবং অর্ধেকটা নেদারল্যান্ডসের  অংশ হয়ে গেছে।

যেসব বাড়ি দুই দেশের সীমান্তেই পড়েছে সেসব বাড়ির বাসিন্দাদের জাতীয়তা নির্ধারণ হবে কীভাবে?

এর অভিনব সমাধান খুঁজে বের করেছেন শহরের কর্তৃপক্ষ।

তারা বলছেন, সদর দরজা যে দেশের সীমানার মধ্যে পড়বে ভবনের বাসিন্দারাও সে দেশের নাগরিক হিসেবে বিবেচিত হবে।

এমন সিদ্ধান্তের পর ১৯৯৫ সালে একদিন হঠাৎ করেই ডাচ কর্মকর্তারা এক বেলজিয়ান নারীর বাড়ির দরজায় কড়া নাড়লেন। ৬৮ বছর বয়সী ওই নারী বেলজিয়ামের নাগরিক হিসেবেই বার্লে শহরে বসবাস করছিলেন।

তারা বললেন, 'আপনার বাড়ির সদর দরজা নেদারল্যান্ডসে , তাই এখন থেকে আপনি ডাচ নাগরিক। নতুন পরিচয়পত্র ও পাসপোর্ট সংগ্রহ করে নিন।'

তবে বুদ্ধি খাটিয়ে এই সমস্যার সমাধান করলেন তিনি। বাড়ির নকশা পরিবর্তন করে একটি জানালাকে দরজা বানিয়ে ফেললেন। এতে করে সদর দরজা বেলজিয়াম সীমান্তের মধ্যেই থাকল, তাকেও আর নেদারল্যান্ডসের নাগরিকত্ব গ্রহণ করতে হলো না।

ছবি: সংগৃহীত

এক শহরের দুই আইন, ভিন্ন ভিন্ন বিধিনিষেধ 

বার্লে শহরের সবকিছুই দুটো করে আছে। শহরের দুটো নাম, দুজন মেয়র, দুই পৌর প্রশাসন, দুটি পোস্ট অফিস— তবে একটি একক কমিটি আছে যা শহর পরিচালনায় কাজ করে।

কোন রাস্তা মেরামতের প্রয়োজন, কে কোন লনের দেখাশোনা করবে বা বর্জ্য ব্যবস্থাপনা কে করবে, আর এসবের জন্য কে অর্থ দেবে এই সমস্ত সমস্যার জন্য প্রায়ই দুই শহরের প্রশাসনকে বিশেষ সমাধান খুঁজতে হয়।

বার্লে শহরের কোনো রাস্তার যেটুকু অংশ নেদারল্যান্ডসের সীমান্তে পড়েছে সেটুকু অংশে ডাচ আইন অনুসরণ করতে হবে। একইভাবে বেলজিয়ামের অঞ্চলে মানতে হবে বেলজিয়ান আইন।

ডাচ আইন অনুযায়ী, একসময় একটি নির্দিষ্ট সময় পর রেস্তোরাঁ বন্ধ করার নিয়ম ছিল। কিছু রেস্তোরাঁ তখন দোকান খোলা রাখার জন্য বেলজিয়ামের দিকে টেবিল সরিয়ে নিত। আবার, আতশবাজি বিক্রির বিষয়ে ডাচ আইন বেলজিয়ামের চেয়ে বেশি কঠোর। তাই বিধিনিষেধ এড়াতে নেদারল্যান্ডসের নাগরিকরা বার্লে-হারতগ অর্থাৎ ডাচ অংশে এসে আতশবাজি কেনেন।

দুই দেশই ইউরোপীয় ইউনিয়নের অন্তর্ভূক্ত হওয়ায় একই মুদ্রা (ইউরো) দুই অঞ্চলেই ব্যবহার করা যায়। ফলে সীমান্তের কোন দিকের দোকানে পেট্রল সস্তা, কোন দোকানে খাবারের দাম কম এসব বিষয়ে সেখানকার বাসিন্দারা নিয়মিত খোঁজ রাখেন।

সবচেয়ে জটিল পরিস্থিতি তৈরি হয়েছিল কোভিড মহামারির সময়। মহামারি মোকাবিলায় বেলজিয়াম ও নেদারল্যান্ডস ভিন্ন ভিন্ন সময় ও নিয়মে লকডাইন চালু করে।

বেলজিয়াম যখন প্রায় সবকিছুই বন্ধ ঘোষণা করে লকডাউন দেয় তখন নেদারল্যান্ডসে বিধিনিষেধ ছিল বেশ শিথিল, তারা সেসময় এমনকি ক্যাফে-রেস্তোরাঁও খোলা রেখেছিল। বিপাকে পড়তে হয় সেসব দোকান মালিকদের যাদের দোকানের অংশ দুই দেশেই রয়েছে।

সেসময় মালিকরা নিজ নিজ প্রতিষ্ঠানের ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নেন। কেউ কেউ দোকান সম্পূর্ণ দোকান বন্ধ রাখেন। কেউ আবার দোকানের বেলজিয়ান অংশ ও ডাচ অংশকে লাল টেপ দিয়ে আলাদা করে ডাচ অংশ খোলা রাখেন। ফলে দেখা গেল, ডাচ নাগরিকরা সেই দোকানে গিয়ে নতুন টি-শার্ট কিনতে পারলেও অন্য কিছু কিনতে পারছেন না কারণ ওই সেলফগুলো বেলজিয়ান অংশে পড়েছে আর বেলজিয়ামে তখন লকডাউন চলছে।

সেসময়কার স্মৃতিচারণ করে মেয়র ডি বন্ট বলেন, 'প্রথমে বেলজিয়াম কঠোর বিধিনিষেধ দেয়। তারপরে নেদারল্যান্ডস। শহরবাসীরা সেসময় বিভ্রান্ত হয়ে যায়। নিয়মিতভাবে আমাদের কাছে ফোন আসত, লোকজন বিরক্তি প্রকাশ করতেন। এরকম গুরুত্বপূর্ণ সময়ে ধীরস্থিরভাবে লোকজনকে বোঝাতে হয়েছে।'

সমাধানের বিষয়ে বার্লের বেলজিয়ান মেয়র ফ্রান্স ডি বন্ট বলেন, 'আলোচনা, ধৈর্য এবং সর্বোপরি প্রথমে কথা শোনার জন্য প্রস্তুতি থাকতে হয়। আমরা আলোচনায় বসি এবং সমাধান খুঁজে বের করি। সমস্যায় যারা ভুগছেন, যারা প্রভাবিত হতে পারে তাদের সঙ্গে কথা বলে, যুক্তি দিয়ে চিন্তা করে এবং বন্ধুত্বপূর্ণ উপায়ে আপনি অনেক কিছু অর্জন করতে পারেন।'

তথ্যসূত্র: ডয়েচে ভেলে, ডাচনিউজ, গুগলআর্থ, ট্রাভেলবাইএক্সামপল

 

Comments

The Daily Star  | English

Horrors inside the Gaza genocide: Through a survivor’s eyes

This is an eye-witness account, the story of a Palestinian in Gaza, a human being, a 24-year-old medical student, his real human life of love and loss, and a human testimony of war crimes perpetrated by the Israeli government and the military in the deadliest campaign of bombings and mass killings in recent history.

9h ago