অবিস্মরণীয় তাজউদ্দীন আহমদ 

আজ স্বাধীনতা সংগ্রামের অবিস্মরণীয় নেতা, স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদের জন্মদিন।
তাজউদ্দীন আহমদ।

আজ স্বাধীনতা সংগ্রামের অবিস্মরণীয় নেতা, স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম প্রধানমন্ত্রী ও জাতীয় নেতা তাজউদ্দীন আহমদের জন্মদিন। বাংলাদেশের ইতিহাসের অন্যতম শ্রেষ্ঠ এই রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব ছিলেন ছিলেন একাধারে দূরদর্শী নেতা এবং দক্ষ প্রশাসক।

মুক্তিযুদ্ধকালীন সময়ে প্রবাসী বাংলাদেশ সরকারের প্রধানমন্ত্রী হিসেবে নিজের দায়িত্ব যেমন অত্যন্ত সুচারুভাবে পালন করেছিলেন তিনি। তেমনি তার নেতৃত্বগুণেরও ছিল মোহনীয় ও জাদুকরী শক্তি। তার আদর্শের প্রভাব মুহূর্তেই বশ করে নিত দলীয় কর্মী, মুক্তিযোদ্ধা থেকে সাধারণ মানুষকে। আজীবন আদর্শের প্রতি এমন অটল থাকার উদাহরণ অতি বিরল। দেশের জনগণ আর জনগণের ভালোবাসাই ছিল তার মূল শক্তি। 

মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন এক ক্যাম্পে গিয়ে মুক্তিযোদ্ধাদের উদ্দেশ্যে তাজউদ্দীন আহমদ বলেছিলেন, 'মুছে যাক আমার নাম, তবু থাকুক বাংলাদেশ।'

বঙ্গতাজ তাজউদ্দীন আহমদের জন্মদিনে তার জীবনের তেমনই কিছু ঘটনা। 

মাতৃভূমি বাংলাদেশকে তাজউদ্দীন আহমদ এমনই ভালোবাসতেন যে, মুক্তিযুদ্ধের সময় ভারতে অবস্থানকালে বাংলাদেশের অন্যরা যখন ভারতীয় সময়ে চলতেন সেখানে তার ঘড়ি চলত বাংলাদেশি সময়ে তথা ভারতীয় সময় থেকে ৩০ মিনিট এগিয়ে। তিনি বলতেন, 'আমি তো দেশের প্রয়োজনেই এখানে এসেছি'। 
অস্থায়ী সরকার গঠন করার পর ব্যারিস্টার আমিরুল ইসলামকে সঙ্গে নিয়ে ভারতে যাবেন তাজউদ্দীন আহমদ। ভারতের সীমান্তে তিনি পৌঁছালেন কিন্তু ভারতে ঢোকেননি। সঙ্গীদের একজন বলে উঠল, 'আপনি যাবেন না?'

তিনি দৃঢ় গলায় বললেন, 'আমার দেশ স্বাধীন। আর স্বাধীন দেশের প্রধানমন্ত্রী হয়ে আমি বিনা প্রটোকল আর তাদের আমন্ত্রণ ছাড়া আমি তাদের দেশে যেতে পারি না। এটি আমার দেশের জন্য প্রচণ্ড অসম্মানজনক। আমাকে তো ভারত আমন্ত্রণ জানায়নি।' 
পরবর্তীতে ভারত সরকার তাকে গার্ড অব অনার প্রদান করে ভারতে নেয়। এমনই ছিলো তার আত্মসম্মান বোধ।

ভারতে যাওয়ার পর প্রথমবার যখন দিল্লিতে তাজউদ্দীন আহমদের সঙ্গে ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর দেখা হলো, ইন্দিরা গান্ধী মুক্তিযুদ্ধে ভারতের সাহায্যের কথা বলে বসলেন। এবং যেকোনো মুহূর্তে ভারত বাংলাদেশকে সাহায্য করতে প্রস্তুত‌ বললেন। তাজউদ্দীন আহমদ বিনয়ের সঙ্গে বলে উঠলেন 'এটা তো আমাদের যুদ্ধ। আমাদেরই করতে দিন!' (সূত্র: তাজউদ্দীন আহমদ: নেতা ও পিতা/ শারমিন আহমদ

সময়টা মুক্তিযুদ্ধের মে মাস। কলকাতার থিয়েটার রোডে একটি দুই তলা বাড়ি ভাড়া নেয়া হলো মুজিব নগর সরকারের পক্ষ থেকে। বাড়িটির দুতলার এক দিকের ছোট একটি স্যাঁতস্যাঁতে কামরায় থাকতেন তাজউদ্দিন আহমদ, বাকিটা অফিসের জন্য ছেড়ে দিলেন। বাড়িওয়ালা যেদিন জানলেন একটি দেশের প্রধানমন্ত্রী তার বাড়ির এই ময়লা কামরায় থাকেন তখন তিনি বলে উঠলেন, 'তোমরা পারোও! প্রধানমন্ত্রী হয়ে এই কামরায়! তোমরা স্বাধীন না হলে আর কে স্বাধীন হবে!''
(সূত্র: আমার একাত্তর/ ড. আনিসুজ্জামান)।
মুক্তিযুদ্ধের শেষের দিকের ঘটনা। একদিন কলকাতায় তার বরাদ্দকৃত বাড়িতে দুই ধরনের রান্নার আয়োজন করা হলো। মন্ত্রী, প্রধানমন্ত্রীর জন্য এক ধরনের রান্না, আর সাধারণ বাকিদের জন্য আরেক ধরনের রান্না। মন্ত্রী-প্রধানমন্ত্রীদের রান্নায় বেশ আয়োজনের ভাব। তাজউদ্দীন আহমদ খেতে বসেই খাবারের আয়োজন দেখে গর্জে উঠে সহকারীকে ডাকলেন। সহকারী হাজির হতেই তিনি উঠলেন, 'এগুলো কেন? সাধারণ খাবার কই?'
সহকারী বলে উঠলেন, 'এটা আপনার জন্যই স্পেশাল রান্না হয়েছে। সাধারণ খাবার কেবল ডাল, ছোট মাছ আর আলুর তরকারী।' তিনি এবার চেঁচিয়ে উঠে বললেন, 'দেশের মানুষ না খেয়ে আছে আর আমি এখানে পোলাও কোর্মা খাবো?' (সূত্র: আমার একাত্তর/ ড. আনিসুজ্জামান)।

অধ্যাপক ড. আনিসুজ্জামান তার স্মৃতিকথায় লিখেছিলেন, একদিন তিনি তাজউদ্দীন আহমদের বাসায় গেলেন। দেখলেন তার চোখ লাল, দেখে অসুস্থ মনে হচ্ছে। ড. আনিসুজ্জামান বললেন, 'স্যার আপনার শরীর খারাপ নাকি?' তাজউদ্দিন আহমদ বলে উঠলেন, 'গতকাল রাতে ঘুমাতে যাওয়ার পর, হঠাৎ ঝড়ে আমার ঘরের জানালার একটা অংশ খুলে গেল, তখন হঠাৎ মনে হলো, এই ঝড়ে আমার ছেলেরা না খেয়ে, না ঘুমিয়ে দেশের জন্য যুদ্ধ করছে, আর আমি এখানে ঘুমাচ্ছি! আর সারারাত ঘুমাতে পারিনি!'
ভারতে তখন প্রথম বাংলাদেশ সরকারের ব্যস্ত সময়। একদিন সকালবেলা অফিসে গিয়েছেন তাজউদ্দীন আহমদ। অফিসে পৌঁছে কোনো এক প্রয়োজনে পিয়নকে ডাকলেন। এদিকে দরকারি একটি কাগজ পাঠাতে হবে তাকে। একপর্যায়ে তিনি বুঝতে পারলেন আজ পিয়ন অফিসে আসেনি। ভাবলেন তার নিশ্চয়ই কোনো সমস্যা হয়েছে। কাউকে কোন ফরমায়েশ না দিয়েই তাজউদ্দীন আহমদ নিজেই বের হলেন পিয়নের থিয়েটার রোডের বাড়ির উদ্দেশ্যে। কিছুক্ষণ পর অফিসের আরেক কর্মচারী তাজউদ্দীন আহমদকে না দেখতে পেয়ে ভাবলেন তিনি হয়তো আজ অফিসেই আসেননি। তাই কোনো এক অজানা কারণে পিয়নের বাসায় গেলেন তিনি। পিয়নের বাসায় ঢুকেই তো তার চোখ ছানাবড়া হওয়ার জোগাড়। কারণ আর কেউ নয়, জ্বরাক্রান্ত পিয়নের মাথায় বদনা দিয়ে পানি ঢালছেন বাংলাদেশ সরকারের প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দিন আহমদ। (সূত্র: আমার একাত্তর/ ড. আনিসুজ্জামান)।

বঙ্গবন্ধুর শক্তির অন্যতম উৎস ছিলেন তাজউদ্দীন আহমদ। পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট জুলফিকার আলী ভুট্টো একবার এক ভাষণে বলেছিলেন, 'আলোচনা বৈঠকে মুজিবকে আমি ভয় পাই না। ইমোশনালি কায়দায় হয়তো মুজিবকে কাবু করা যায়, কিন্তু তাঁর পেছনে ফাইল বগলে চুপচাপ যে নটোরিয়াস লোকটি বসে থাকে তাঁকে কাবু করা ভীষণ শক্ত।' (সূত্র: তাজউদ্দীন আহমদ আলোকের অনন্তধারা/ সিমিন হোসেন রিমি)
 
সময়টা ১৯৭২ সাল। বিশ্বব্যাংকের প্রেসিডেন্ট রবার্ট ম্যাকনামারার সাথে মিটিং এ বসেছেন তাজউদ্দীন আহমদ। প্রাথমিক আলোচনার পর বিস্তারিত আলোচনার জন্য ম্যাকনামারা, তাজউদ্দীন আহমদ এবং সিরাজুদ্দিন যখন বসলেন, তখন ম্যাকনামারা জানতে চাইলেন বাংলাদেশের জন্য কোথায় কী ধরনের সাহায্য দরকার। তাজউদ্দীন আহমদ বললেন, 'আমাদের যা দরকার তা আপনি দিতে পারবেন কি-না আমার সন্দেহ আছে।' ম্যাকনামারা বললেন, 'মিস্টার মিনিস্টার, আপনি বলুন, আমরা চেষ্টা করব দিতে।' তখন তাজউদ্দীন আহমদ বললেন, 'মিস্টার ম্যাকনামারা, আমার গরু এবং দড়ি দরকার। যুদ্ধের সময় গরু সব হারিয়ে গেছে। এখানে-ওখানে চলে গেছে, মরে গেছে। পাকিস্তান যুদ্ধ চাপিয়ে দিয়েছে, চাষিরা এদিক-সেদিক পালিয়ে গেছে, তখন গরু হারিয়ে গেছে। এখন যুদ্ধ শেষ, চাষি ফিরেছে কিন্তু গরু নাই, তাই চাষ করবে কীভাবে? কাজেই আমাদের অগ্রাধিকার চাহিদা হলো গরু। ম্যাকনামারার চোখ-মুখ লাল হয়ে যাচ্ছে। তাজউদ্দীন আহমদ বললেন, 'আর আমাদের সমস্ত দড়ি তো পাকিস্তানিরা নষ্ট করে ফেলেছে, এখন গরু পেলে গরু বাঁধতে দড়ি প্রয়োজন। গরু এবং দড়ি প্রয়োজন খুব তাড়াতাড়ি, না হলে সামনে জমিতে চাষ হবে না।'

অস্বস্তিকর এই মিটিং শেষে যখন তাজউদ্দীন আহমদকে জিজ্ঞেস করা হলো, আপনি কেন এরকম করলেন। উনি বললেন, 'কেন, গরু ছাড়া কি চাষ হয়? মহা চটেছিলেন। বললেন, 'এই লোকটি তো আমেরিকার ডিফেন্স সেক্রেটারি ছিলেন, আমাদের মুক্তিযুদ্ধকে ধ্বংস করে দিতে চেয়েছে আমেরিকা। আমাদেরকে স্যাবোটাজ করেছে। শেষ পর্যন্ত সপ্তম নৌবহর পাঠিয়েছে আমাদেরকে ধ্বংস করে দিতে। আর তার কাছে সাহায্য চাবো আমি?' এমনই আত্মসম্মান বোধ ছিল তাজউদ্দীন আহমদের। (সূত্র: তাজউদ্দীন আহমদ: নেতা ও পিতা/ শারমিন আহমদ)

দেশের জন্য এই কিংবদন্তী প্রবাদপ্রতিম মানুষটির ত্যাগ কতখানি তা অবর্ণনীয়। ইতিহাসে বাংলাদেশ যতদিন থাকবে, বাংলাদেশের পরিচয় যতদিন থাকবে বঙ্গতাজ থাকবেন ততদিন। জন্মবার্ষিকীতে তাজউদ্দীন আহমদের প্রতি বিনম্র শ্রদ্ধা।
 

Comments