যুদ্ধদিনের প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ: জন্মশতবার্ষিকীতে শ্রদ্ধাঞ্জলি

মুক্তিযুদ্ধকালীন ও মুক্তিযুদ্ধোত্তর বাংলাদেশের প্রথম প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ (১৯২৫-১৯৭৫)। জন্মেছিলেন ১৯২৫ সালের ২৩ জুলাই, ঢাকার অদূরে অধুনা গাজীপুর জেলার কাপাসিয়া উপজেলার দরদরিয়া গ্রামে। আজ তার জন্মশতবার্ষিকী।
তাজউদ্দীন আহমদ ৪৬ বছর বয়সে বাংলাদেশের স্বাধীনতার সশস্ত্র সংগ্রামে জড়িয়ে পড়েন। বলা চলে নিয়তির অমোঘ টানে তাকে এই লড়াইয়ে সামনের কাতারে দাঁড়িয়েই কাজ করতে হয়। আবার স্বাধীন দেশে প্রথম অর্থমন্ত্রী হিসেবেও গুরুদায়িত্ব পালন করেন তিনি। ইতিহাসের পীড়ন হচ্ছে, একসময় নিজ দল ও দলের সরকারেও তাকে ব্রাত্য হতে হয়। মন্ত্রিসভা থেকে সরে দাঁড়াতেও হয়। তারপর নিয়তিই তাকে টেনে নিয়ে যায় মৃত্যুঘাতে। মাত্র ৫০ বছর বয়সে জেলখানায় সতীর্থ আর তিনজন রাজনৈতিক সহযোদ্ধার সঙ্গে নির্মম হত্যার শিকার হন।
রাজনীতিতে, রাষ্ট্রাচারে এক অনুকরণীয় সততা, নিষ্ঠা, মেধা, প্রজ্ঞা, চিন্তাশীলতার কর্মজীবন হাজির রেখেছিলেন তাজউদ্দীন আহমদ। একবার নিউজ ম্যাগাজিন সাপ্তাহিক-এর পক্ষ থেকে বাংলাদেশ সরকারের সাবেক আমলা ড. সা'দত হুসাইনকে জিজ্ঞাসা করেছিলাম, মুক্তিযুদ্ধকালীন সরকারে গিয়ে বাংলাদেশের প্রথম প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদের সবচেয়ে কাছাকাছি হওয়ার সুযোগ পান। তার ব্যাপারে আপনার মূল্যায়ন কী?
সা'দত হুসাইন অত্যন্ত শ্রদ্ধাভরে উত্তর দিলেন, 'তাজউদ্দীন আহমদ এক অসাধারণ ব্যক্তিত্ব। যারা মুক্তিযুদ্ধে রাজনীতিবিদদের অবদান, আত্মত্যাগ, মেধা ও দক্ষতাকে খাটো করে দেখার প্রয়াস পান, তারা তাজউদ্দীন আহমদকে দেখেননি। এ রকম একজন ক্ষণজন্মা ব্যক্তিকে কাছে থেকে দেখতে পাওয়া এক দুর্লভ সৌভাগ্যের ব্যাপার। আমি এদিক থেকে সৌভাগ্যবান, তাকে খুব কাছ থেকে দেখার সুযোগ আমার হয়েছিল। চরম প্রতিকূল অবস্থার মধ্যে তিনি যে দক্ষতা, প্রজ্ঞা, কৌশল নিয়ে মুক্তিযুদ্ধ পরিচালনা করেছেন, তার তুলনা বিশ্ব ইতিহাসে বিরল। তার পরিবার কলকাতাতে অবস্থান করলেও জনাব তাজউদ্দীন আহমদ মুক্তিযুদ্ধের পুরো সময় পরিবার থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে থিয়েটার রোডে ক্যাম্প-জীবনযাপন করেছেন। প্রখর মেধাসম্পন্ন এই নেতা নীতি-নিষ্ঠার এক উজ্জ্বলতম দৃষ্টান্ত স্থাপন করে ধীরে ধীরে মুক্তিযুদ্ধের সুদৃঢ় সাংগঠনিক ভিত রচনা করেছিলেন।'
'তার অতি সুন্দর হাতের লেখা, সাবলীল বক্তব্য উপস্থাপন, যৌক্তিক বিশ্লেষণ এবং প্রখর নীতিবোধ তাকে উচ্চতার এমন এক চূড়ায় প্রতিষ্ঠিত করেছে যে, তাকে ভালোভাবে দেখতে হলে বা বুঝতে হলে দর্শককেও অনুশীলনের মাধ্যমে সমতল থেকে কিছু উঁচুতে অবস্থান গ্রহণ করতে হবে। সাধারণ মানুষের জন্য তার মন কাঁদলেও, সাধারণ মানুষের জন্য পরিপূর্ণভাবে নিবেদিতপ্রাণ হওয়া সত্ত্বেও সাধারণ দৃষ্টিতে দেখে তাজউদ্দীন আহমদকে মূল্যায়ন করা সম্ভব নয়। নিজের দৃষ্টিকে একই সঙ্গে প্রসারিত এবং তীক্ষ্ণ করতে পারলে তবেই তার প্রকৃত রূপ দেখা সম্ভব হবে। সে রূপ নিরাভরণ, নিখাদ, বিদ্যুৎ প্রবাহে সৃষ্ট চুম্বক প্রকৃতির।' (আত্মজৈবনিক সাক্ষাৎকার; 'নীলিমার রৌদ্রে'; ড. সা'দত হুসাইন; সাপ্তাহিক, ১ আগস্ট ২০১৩, বর্ষ ৬ সংখ্যা ১২)
২.
আজকের পৃথিবীখ্যাত বৃহত্তম বেসরকারি প্রতিষ্ঠান ব্র্যাকের প্রতিষ্ঠাতা ফজলে হোসেন আবেদ তখন লন্ডনে পড়াশোনা করছেন। ছাত্রাবস্থাতেই তিনি জড়িয়ে পড়েন মুক্তিযুদ্ধে। তার সেসময়ের এক স্মৃতিচারণে উঠে এসেছে যুদ্ধদিনের প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদের কথা। তিনি বলেছেন, 'লন্ডনে আমাদের সঙ্গে একটা গ্রুপের পরিচয় হলো। তারা ভিয়েতনামের পক্ষে ভাড়াটে যোদ্ধা হিসেবে কাজ করেছেন। পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে এরকম গ্রুপ আছে, যারা চরম প্রতিকূল অবস্থাতেও খুবই সাহসী ও দক্ষ হয়। নির্ভুল নিশানায় অব্যর্থ আঘাত হানতে পারে তারা। ভিয়েতনামের পক্ষে যুদ্ধ করা গ্রুপটির সঙ্গে আমাদের আলোচনা চলতে থাকল।'
'এদের দুজন ইংরেজ এবং একজন অস্ট্রেলিয়ান। আমাদের পক্ষ হয়ে নাশকতামূলক তৎপরতা চালাবেন তারা। তাদেরকে বললাম, পাকিস্তানের সমুদ্রবন্দরে বা অন্য কোনো জাহাজে যদি বোমা বিস্ফোরণ ঘটানো যায় তাহলে একটা বড় কাজ হয়।'
'এই তিনজন একদিন আমার বাসায় এলেন। আমি এবং ভিকারুল ইসলাম চৌধুরী তাদের সঙ্গে আলাপ করলাম। তারা বললেন, "আমরা গুজরাট উপকূল থেকে মাছধরা ট্রলার নিয়ে করাচি সমুদ্রবন্দরে যাব। সেখানে জাহাজে বোমা পেতে বিস্ফোরণ ঘটাবো। এজন্য আমাদের অর্থ দিতে হবে।" এ কাজটি সম্পন্ন করতে তাদের সঙ্গে ১৬ হাজার ৮০০ পাউন্ডে রফা হলো।'
'কিন্তু এই কাজে এত টাকা খরচ করব কিনা, তা নিয়েও ভাবতে থাকলাম। সন্দেহ নেই এরকম একটি নাশকতামূলক কাজ করতে পারলে সেটা বেশ চাঞ্চল্যকর ব্যাপার হবে। বিশ্ব প্রচারমাধ্যমে উঠে আসবে বাংলাদেশ। মুক্তিযোদ্ধাদের শক্তি ও সাহসিকতার প্রমাণ হবে। কিন্তু এ ধরনের একটি ব্যয়বহুল কাজ করব কিনা, সেই সিদ্ধান্ত নিতে পারছিলাম না।'
'সেপ্টেম্বর মাসে আমি এবং ভিকারুল ইসলাম চৌধুরী কলকাতা গেলাম। প্রবাসী সরকারের প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদের সঙ্গে দেখা করার জন্য। কলকাতার থিয়েটার রোডে তার অফিসে গেলাম। সন্ধ্যা সাতটার দিকে আমরা তার কক্ষে ঢুকলাম। তিনি একটি চেয়ারে বসে আছেন। পরনে লুঙ্গি-পাঞ্জাবি। তাকে আমাদের পরিকল্পনার কথা অবহিত করলাম। বললাম, এর জন্য প্রয়োজনীয় ১৬ হাজার ৮০০ পাউন্ড সংগ্রহ করেছি। শত্রু ঘাঁটিতে নাশকতামূলক এই কাজটি করে আমরা বিশ্বকে চমকে দিতে চাই।'
'মুজিবনগর সরকারের পক্ষে প্রায় সব কাজই তখন করছিলেন প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ। তিনি বিষয়টিকে কীভাবে দেখেন বা তার অন্য কোনো পরামর্শ বা পরিকল্পনা আছে কিনা, তা আমরা জানতে চাইছিলাম। এত বড় একটি কাজ প্রবাসী সরকারের প্রধানমন্ত্রীকে না জানিয়ে আমরা করতে চাইনি। আর এই কাজটি যে মুক্তিযোদ্ধারা করছে সেটা জানিয়ে রাখাও একটি উদ্দেশ্য ছিল।'
'আমাদের সব কথা শুনে তাজউদ্দীন আহমদ বললেন, দেখুন, এ ধরনের অভিযান সফল হতে পারে আবার নাও হতে পারে। তাই একাজে এত টাকা ব্যয় করা ঠিক হবে না। আমরা খুবই আর্থিক সঙ্কটের মধ্যে আছি। একেবারেই চলতে পারছি না। ভারত সরকারের উপর পুরোপুরি নির্ভরশীল আমরা। তারা আমাদের অনেক কিছু দিচ্ছেন, আবার অনেক কিছুই দিচ্ছেন না। আপনাদের সংগৃহীত অর্থটা পেলে আমাদের যুদ্ধ আমরা নিজেরাই করতে পারব। ভাড়াটে লোকের প্রয়োজন হবে না।'
'তাজউদ্দীন আহমদকে সেদিন একজন নিরহঙ্কার, অমায়িক এবং আদর্শবান রাজনৈতিক নেতা হিসেবে মনে হয়েছিল। মুক্তিযুদ্ধের প্রাণপুরুষ শেখ মুজিবুর রহমানের অনুপস্থিতিতে তিনি আমাদের সকলের পক্ষে মুক্তিযুদ্ধের প্রধান সংগঠকের দায়িত্ব পালন করেছিলেন।' (ফজলে হাসান আবেদ ও ব্র্যাক; লেখক: গোলাম মোর্তোজা, পৃষ্ঠা: ৩৩-৩৪)
৩.
১৯৭২-৭৪ সালে বাংলাদেশের অর্থমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদের একান্ত সচিব ছিলেন সরকারি কর্মকর্তা আবু সাইদ চৌধুরি। তার তাজউদ্দীন আহমদ অবলোকনের একটি বয়ান হচ্ছে, 'তাজউদ্দীন সাহেব সাধারণত আমাকে তার বাসায় যেতে বলতেন না। খুব বিশেষ কোন কাজ থাকলে যেতে বলতেন। এ ছাড়া আমি যদি যেতাম সেটা আমার ইচ্ছা। সেই সময় রবিবারে ছুটি থাকত। এক শনিবারে আমরা কাজ সেরে রাত ১০টার পর যখন সচিবালয় থেকে ফিরছি সেই মুহূর্তে তাজউদ্দীন সাহেব বললেন, "চৌধুরী সাহেব, কাল আমরা কিছু অফিশিয়াল কাজ করব। আমি পিএ-কে বলে দিয়েছি ফাইলগুলো বেঁধে গাড়িতে দিতে।"'
'আমি আপত্তি জানিয়ে বললাম, "স্যার, পুরো সপ্তাহ ধরে রাত ৯টা-১০টা পর্যন্ত কাজ করছি। আগামীকাল ছুটির দিন, স্যার, আমার তো একটা সংসার আছে।"'
'তিনি বললেন, "চৌধুরী সাহেব, কালকের দিনটা একটু কষ্ট করতে হবে, কারণ কাল আমি কিছু জরুরী ফাইল ছাড়ব। আপনি তো জানেন ফাইলগুলো আমার টেবিলে আছে।"'
'পরদিন সকালে আমি তার হেয়ার রোডের বাসায় গেলাম। আমি যাবার আগেই তিনি দোতলার বারান্দায় বসে ফাইল দেখা শুরু করেছেন। আমি তার পাশে রাখা চেয়ারে বসলাম। তিনি খুব মনোযোগ দিয়ে একটি ফাইলে লিখছিলেন। প্রায় দুই পৃষ্ঠা মত লিখে সেটা একবার পড়ে সই করে "লিলি, লিলি" (বেগম জোহরা তাজউদ্দীন) বলে ডাকতে লাগলেন। বেগম তাজউদ্দীন রুম থেকে বের হয়ে আসতেই তিনি বললেন, "ওই প্রমোশন কেসটা আমি অনুমোদন দিয়ে দিলাম।" বেগম তাজউদ্দীন বললেন, "তুমি বাংলাদেশের অর্থমন্ত্রী, তুমি তোমার মন্ত্রণালয়ের কাকে প্রমোশন দেবে না দেবে সেটা তোমার ব্যাপার, এর মধ্যে আমার তো বলবার কিছু নেই।" তাজউদ্দীন সাহেব হাসতে হাসতে বললেন, "লিলি, তুমি ঠিকই বলেছ, কিন্তু এই কেসটার সাথে তোমার একটা সম্পর্ক আছে, তাই তোমাকে জানিয়ে রাখলাম।" আমি তাজউদ্দীন সাহেবের কথা শুনে ভাবছিলাম ব্যাপারটা কী। ঠিক ওই সময় মুখে প্রশান্তির হাসি নিয়ে তিনি আমার দিকে সেই ফাইলটা এগিয়ে দিলেন।'
'আমি আগাগোড়া ফাইলটি পড়লাম। একজন কর কর্মকর্তার পদোন্নতির ফাইল। নিচ থেকে নোটিং হয়ে উপরে এসেছে এবং পদোন্নতির জন্য সুপারিশ করা হয়েছে। তবে লেখা হয়েছে, স্বাধীনতা যুদ্ধে তার বিতর্কিত ভূমিকার বিষয়টি বিবেচ্য। তাজউদ্দীন সাহেব রেফারেন্স দিয়ে দিয়ে লিখেছেন এবং যার সারমর্ম হচ্ছে—আমি তার এসিআরগুলো দেখলাম। চাকুরি জীবনের রেকর্ড অনুযায়ী তার পদোন্নতি পাওয়া উচিত। আর মুক্তিযুদ্ধের সময় তার বিতর্কিত ভূমিকা ছিল বলে উল্লেখ করা হয়েছে, কিন্তু বিষয়টি সম্পর্কে স্পষ্ট করে কিছু বলা হয়নি। কারো প্রতি সন্দেহবশত কোন সিদ্ধান্ত চাপিয়ে দেয়া ঠিক হবে বলে আমি মনে করি না। যদি তার বিরুদ্ধে নির্দিষ্ট কোন অভিযোগ থাকে তবে তা আলাদাভাবে উত্থাপন করা যেতে পারে। যেহেতু নির্দিষ্ট কোন অভিযোগ এখানে দেখানো হয়নি বা কোন প্রমাণও নেই, তাই আমি বিষয়টিকে বিবেচনার মধ্যে না এনে তার এই পদোন্নতি অনুমোদন করলাম। পড়া শেষ করে বললাম, "স্যার, এখনও বুঝিনি ব্যাপারটা যে কী, আর ভাবীকেই বা আপনি ওই কথা বললেন কেন!"'
'এবার তাজউদ্দীন সাহেব বললেন, "২৫ মার্চ ১৯৭১ রাতে ঢাকায় পাকিস্তানি বাহিনীর ধ্বংসযজ্ঞ শুরুর মুহূর্ত কয়েক আগে আমি বাড়ি ছেড়ে চলে যাই। কিন্তু লিলি যেতে পারেনি, ভাড়াটে সেজে কপালগুণে আর্মির হাত থেকে ছোট দুটো বাচ্চাসহ রক্ষা পায়। তারপর একটু নিরাপদ আশ্রয়ের জন্য ঘুরতে ঘুরতে ধানমন্ডি ১৩ নম্বর রোডের লেকের পাশে পরিচিত এক ভদ্রলোকের বাড়িতে গিয়ে ওঠে পাঁচ বছরের মিমি আর এক বছরের সোহেলকে নিয়ে। সে সময় ভদ্রলোক বাসায় ছিলেন না। ফিরে এসে লিলির উপস্থিতি পছন্দ করলেন না। রাতে কারফিউয়ের মধ্যেই সেই ভদ্রলোক বললেন, আমার বাড়িটা তো একদম বড় রাস্তার পাশে, যদি আর্মি এখানে এসে পড়ে তবে সবার অসুবিধা হবে। তাই আপনি আমার সাথে আসুন, আমি আপনাকে দুটো বাড়ি পরে রেখে আসি। লিলি সেই রাতে বাচ্চা দুটোকে নিয়ে ভদ্রলোকের সাথে বের হল। বাসার গেটের বাইরে গিয়ে তিনি বললেন, আপনি একটু দাঁড়ান, আমি একটা জরুরী জিনিস নাকি চাবি ফেলে এসেছি, এক মিনিটে নিয়ে আসছি। ভদ্রলোক ভেতরে ঢুকে কাঠের দরজাটা বন্ধ করে দিলেন। অনেকক্ষণ দাঁড়িয়ে থেকে লিলি আবার ভেতরে ঢুকে দরজায় কড়া নাড়ল, বেল বাজাল, কিন্তু ভেতর থেকে কেউ আর দরজা খুলল না। তখন আর কোন উপায় না দেখে লিলি সমস্ত রাত রাস্তার ওপর বাড়ি তৈরির জন্য স্তূপ করে রাখা ইটের পাশে বাচ্চা দুটোকে নিয়ে বড় রাস্তায় আর্মির আনাগোনা আর কারফিউয়ের মধ্যে বসে রইল।"'
'এবার শুনুন, সেই ভদ্রলোকটিই এই লোক আমি যার পদোন্নতির কেস অনুমোদন করলাম। আমি মনে করি আমাদের জীবনের এই ঘটনার সাথে তার চাকুরিজীবনকে এক করে দেখা উচিত নয়। কেউ হয়ত কোনভাবে জেনেছে আমার পরিবারের সাথে তার এমন কিছু ঘটনা ঘটেছিল, তাই তার ফাইলে এসেছে মুক্তিযুদ্ধে বিতর্কিত ভূমিকার কথা।'
'তাজউদ্দীন সাহেবের কথা শেষ হলে আমি থমকে গেলাম। বিস্মিত হয়ে শুধু বললাম, "স্যার, ইউ আর আ গ্রেট ম্যান!" তারপর আমরা আবার অন্যান্য ফাইলগুলো দেখতে শুরু করলাম। ন্যায়বিচারের ক্ষেত্রে সাংঘাতিক নৈর্ব্যাক্তিক একটা মনোভাব ছিল তাজউদ্দীন সাহেবের।' (তাজউদ্দীন আহমদ আলোকের অনন্তধারা-প্রথম খণ্ড, পৃষ্ঠা: ১৫৬-১৫৮)
৪.
রাজনীতিতে নৈতিকতা প্রতিষ্ঠা করতে চেয়েছিলেন তাজউদ্দীন আহমদ জীবনভর। জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রেও নীতিনিষ্ঠতা প্রতিষ্ঠা করেছিলেন নির্মোহ দৃঢ়তায়। আর ছিল তার মানবিক দৃষ্টিভঙ্গি। রাজনীতিতেও তিনি তার সফল প্রয়োগ করেছেন। ফলে তিনি অনেক ক্ষেত্রে এই ভূখণ্ডের কিছুটা পশ্চাৎপদ রাজনীতির চেয়ে ছিলেন অনেকটাই এগিয়ে। ছিলেন কিছুটা বেমানানও। এই ভূখণ্ডের অনাগত কালের মানুষের জন্য তাজউদ্দীন আহমদের জীবন ও কর্ম তাই এক বিস্ময় এবং জ্ঞানদীপ্ত কৌতূহলের বিষয় হয়ে রয়েছে। ১০০তম জন্মদিনে রাজনীতির এই নৈতিক মানুষটিকে জানাই আবারও শ্রদ্ধা ও ভালোবাসা।
শুভ কিবরিয়া: সিনিয়র সাংবাদিক, রাজনৈতিক বিশ্লেষক
Comments