যুদ্ধবিরতিতে মধ্যস্থতা করেছে যুক্তরাষ্ট্র—ভারত কেন স্বীকার করছে না

শনিবার ভোরে পাকিস্তানে দ্বিতীয় দফায় ক্ষেপণাস্ত্র হামলা চালায় ভারত। সেদিন রাওয়ালপিন্ডিসহ তিনটি বিমান ঘাঁটিকে লক্ষ্যবস্তু বানানো হয়। এর মধ্যে একটি ঘাঁটি ছিল রাজধানী ইসলামাবাদ থেকে মাত্র ১০ কিলোমিটার দূরে। ওই হামলার পরই 'অপারেশন বুনিয়ান-উম-মারসুস' শুরু করে পাকিস্তান। গুজরাট, রাজস্থান, পাঞ্জাব ও কাশ্মীরের নিয়ন্ত্রণ রেখার ওপারে ভারতের ২৬টি সামরিক লক্ষ্যবস্তুতে ক্ষেপণাস্ত্র ও ড্রোন হামলা চালানো হয়। সর্বাত্মক যুদ্ধ বাঁধার আশঙ্কা তৈরি হয় পারমাণবিক অস্ত্রধারী দেশ দুটির মধ্যে। তবে এর কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প জানিয়ে দেন যে বিবদমান দুই পক্ষ যুদ্ধবিরতিতে সম্মত হয়েছে।
সামাজিক মাধ্যমে ট্রাম্পের পোস্টের প্রায় ঘণ্টাখানেক পর উভয় দেশ আনুষ্ঠানিকভাবে যুদ্ধবিরতির ঘোষণা দেয়। ভারতের পক্ষ থেকে যুদ্ধবিরতির কথা জানান পররাষ্ট্র সচিব বিক্রম মিশ্রি। তিনি বলেন, পাকিস্তানের উদ্যোগে দুই দেশের মধ্যে মহাপরিচালক পর্যায়ে ফোনালাপের পর যুদ্ধবিরতির সিদ্ধান্ত হয়। সংক্ষিপ্ত এই ঘোষণায় যুক্তরাষ্ট্র বা অন্য কোনো দেশের মধ্যস্থতার কথা এড়িয়ে যান তিনি।
ট্রাম্প তার 'ট্রুথ সোশ্যাল' প্ল্যাটফর্মে দেওয়া পোস্টে বলেন, যুক্তরাষ্ট্র এই যুদ্ধবিরতিতে মধ্যস্থতা করেছে। এজন্য তিনি ভারত ও পাকিস্তানকে অভিনন্দন জানান। পরদিন দেশ দুটির প্রধানমন্ত্রীর প্রশংসা করে ট্রাম্প বলেন, এই ঐতিহাসিক এবং বীরত্বপূর্ণ সিদ্ধান্তে পৌঁছাতে যুক্তরাষ্ট্র সাহায্য করতে পারায় তিনি গর্বিত। কাশ্মীর সমস্যার সমাধান খুঁজতে দুই প্রতিবেশীর সঙ্গে কাজ করার প্রস্তাবও দেন তিনি।
ট্রাম্প বলেন, 'হাজার বছর' পর কাশ্মীর নিয়ে একটি সমাধান সম্ভব কিনা তা দেখতে আমি আপনাদের উভয়ের সঙ্গে কাজ করব।
কাশ্মীরের পেহেলগামে বন্দুকধারীদের গুলিতে ২৬ পর্যটক নিহত হওয়ার দুই সপ্তাহ পর ৭ মে রাতে পাকিস্তান-নিয়ন্ত্রিত কাশ্মীর ও পাকিস্তানের পাঞ্জাবে কথিত জঙ্গি ঘাঁটিতে ক্ষেপণাস্ত্র হামলা চালায় ভারত। এর পাঁচদিন পর গতকাল সোমবার প্রথম ভাষণ দেন প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি। পররাষ্ট্র সচিবের মতো তিনিও যুক্তরাষ্ট্র বা অন্য কোনো দেশের মধ্যস্থতার কথা উল্লেখ করেননি। অথচ আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমের খবরে বলা হয়েছে, শুধু যুক্তরাষ্ট্রই নয়, উত্তেজনা কমাতে ৩০টির বেশি দেশ ভারত ও পাকিস্তানের সঙ্গে কথা বলেছে। অন্যদিকে, পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী শেহবাজ শরিফও তার ভাষণে যুক্তরাষ্ট্র ও চীনের ভূমিকার ভূয়সী প্রশংসা করেন।
পাকিস্তানের সঙ্গে সংঘাতে তৃতীয় পক্ষের মধ্যস্থতার কথা ভারতের স্বীকার না করার পেছনে আছে পুরোনো ইতিহাস। ভারত চায় না কাশ্মীর ইস্যুতে তৃতীয় কোনো দেশ নাক গলাক। স্বভাবতই, সম্পূর্ণ কাশ্মীরকে ভারতের অবিচ্ছেদ্য অংশ বলে মনে করে নয়াদিল্লি।
এই প্রেক্ষাপটে, ভারত সাত দশকের বেশি সময় ধরে পাকিস্তানের সঙ্গে বিরোধ নিষ্পত্তিতে তৃতীয় পক্ষের মধ্যস্থতা, বিশেষ করে যুক্তরাষ্ট্রের পক্ষ থেকে আসা প্রস্তাব ধারাবাহিকভাবে প্রত্যাখ্যান করে আসছে। ভারতের এই অনড় অবস্থানের পেছনে রয়েছে দেশটির পররাষ্ট্রনীতি, সিমলা চুক্তি এবং কাশ্মীরকে অভ্যন্তরীণ বিষয় হিসেবে দেখার মনোভাব।
বহির্বিশ্বের সঙ্গে ভারতের সম্পর্ক নির্ধারিত হয় পঞ্চশীল নীতির আলোকে। এর মধ্যে দ্বিপাক্ষিকতা এবং অভ্যন্তরীণ বিষয়ে হস্তক্ষেপ না করা অন্যতম। প্রতিবেশীদের সঙ্গে সরাসরি আলোচনার মাধ্যমে বিরোধ নিষ্পত্তির পুরোনো নীতির কথা বলে নয়াদিল্লি। ভারতের দৃষ্টিকোণ থেকে, কাশ্মীর সমস্যা সম্পূর্ণরূপে তার অভ্যন্তরীণ বিষয়। বাইরের মধ্যস্থতাকে অনাকাঙ্ক্ষিত হস্তক্ষেপ বলে মনে করে নয়াদিল্লি। তাদের আশঙ্কা, কাশ্মীর নিয়ে তৃতীয়পক্ষ যুক্ত হলে ভারতের লোকসান হবে কারণ সাধারণ কাশ্মীরীদের মধ্যে বড় একটি অংশ স্বাধীনতার পক্ষে।
কাশ্মীর ইস্যুতে যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যস্থতা মানতে ভারতের অস্বীকৃতির প্রধান ভিত্তি হলো সিমলা চুক্তি। মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের প্রেক্ষাপটে ১৯৭২ সালে ভারত-পাকিস্তানের মধ্যে এই চুক্তি হয়। এই চুক্তিতে উভয় দেশ তাদের মতপার্থক্য শান্তিপূর্ণ দ্বিপাক্ষিক আলোচনার মাধ্যমে সমাধান করতে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ হয়। সিমলা চুক্তির একটি প্রধান ফলাফল ছিল জম্মু ও কাশ্মীরে নিয়ন্ত্রণ রেখা প্রতিষ্ঠা, যা দুই দেশই মেনে চলতে সম্মত হয়। তাই ভারত কাশ্মীর ইস্যুতে যেকোনো আন্তর্জাতিক হস্তক্ষেপের বিরোধিতার প্রধান যুক্তি হিসেবে এই চুক্তির কথা সামনে আনে। আর বিজেপি সরকার তাদের পুরোনো পররাষ্ট্রনীতিতে বদল আনার কথাও কখনো বলেনি। ফলে কাশ্মীর ইস্যুতে তৃতীয় কোনো দেশের মধ্যস্থতার কথা স্বীকার করা মোদির জন্য সহজ ছিল না।
পেহেলগামে পর্যটকরা নিহত হওয়ার পর সিন্ধু পানিচুক্তি স্থগিত করে নয়াদিল্লি। এর পাল্টা পদক্ষেপ হিসেবে সিমলা চুক্তি স্থগিত করে পাকিস্তান। এর পরও ভারত নিজেদের স্বার্থেই এমন কিছু করতে চায় না যা শিমলা চুক্তির ধারাবাহিকতার পরিপন্থি হবে।
মার্কিনীদের মধ্যস্থতার কথা চেপে যাওয়ার পেছনে আরেকটি কারণ হলো ভারতের অভ্যন্তরীণ রাজনীতি। ৭ মে রাতে পাকিস্তানে ক্ষেপণাস্ত্র হামলার পর ভারতীয় গণমাধ্যমে বিপুল সাফল্যের কথা প্রচার করা হলেও আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমগুলো ভিন্ন কথা বলছিল। দেশটির নিরাপত্তা বাহিনীর উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা ও প্রত্যক্ষদর্শীদের বরাতে জানানো হয় আকাশযুদ্ধে ভারতের একাধিক যুদ্ধবিমান ভূপাতিত করেছে পাকিস্তান। যুক্তরাষ্ট্র ও ফ্রান্সের কর্মকর্তাদের বরাতেও সর্বাধুনিক রাফাল যুদ্ধবিমান ভূপাতিত হওয়ার খবর নিশ্চিত করা হয়। তবে ভারত সরকার আনুষ্ঠানিকভাবে এর সত্যতা স্বীকার বা অস্বীকার, কোনোটাই করেনি। ভারতের সামরিক কর্মকর্তারা দৈনিক সংবাদ সম্মেলনে বরাবরই বলে এসেছেন যে তাদের হামলায় পাকিস্তানের সামরিক লক্ষ্যবস্তু ও জঙ্গি ঘাঁটিগুলোর ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে।
এই পরিস্থিতিতে ভারতের যুদ্ধবিরতিতে রাজি হওয়ার একটাই অর্থ দাঁড়ায় যে যুদ্ধের ফল তাদের পক্ষে ছিল না। এ কারণে ভারতীয় গণমাধ্যম ও বিজেপি সমর্থকদের মধ্যে যুদ্ধের পক্ষে উন্মাদনা দেখা যায়। যুদ্ধবিরতির জন্য তারা পররাষ্ট্র সচিব বিক্রম মিশ্রিকে দায়ী করেন। অনলাইনে ব্যাপক ট্রোলিংয়ের শিকার হন তিনি। এমনকি তার মেয়েও ট্রোলিংয়ের হাত থেকে রেহাই পাননি।
ভারত ও পাকিস্তানের সংঘাত যে সর্বাত্মক যুদ্ধে গড়াচ্ছিল সেই কথা প্রথম জানায় নিউইয়র্ক টাইমস। পত্রিকাটির প্রতিবেদনে বলা হয়, শনিবার ভোরে রাওয়ালপিন্ডির নুর খান বিমান ঘাঁটিসহ তিনটি ঘাঁটিতে ভারত হামলা চালানোর পর নাটকীয়ভাবে উত্তেজনার পারদ চড়তে শুরু করে। জবাবে ভারতের পশ্চিম সীমান্তের কাছাকাছি সামরিক ঘাঁটিগুলোতে হামলা চালায় পাকিস্তান। নিউইয়র্ক টাইমসের খবরে বলা হয়, এই সংঘাত খুব দ্রুত পারমাণবিক যুদ্ধের দিকে ধাবিত হতে পারে বলে যুক্তরাষ্ট্রের কাছে তথ্য আসে। এ কারণে তাৎক্ষণিকভাবে সংঘাত থামাতে তৎপর হন ভাইস প্রেসিডেন্ট জেডি ভান্স ও পররষ্ট্রমন্ত্রী মার্কো রুবিও।
ভারতের যুদ্ধবিরতিতে রাজি হওয়ার পেছেনে যে কারণই থাকুক, দেশের ভেতর রাজনৈতিক ঝড় সামলাতে মোদি সরকার যে তৃতীয়পক্ষের মধ্যস্থতার কথা স্বীকার করবেন না তা অনেকটাই নিশ্চিত।
Comments