এ কেমন প্রতিবেশী?

সীমান্ত মানে দুটি রাষ্ট্রের শুধু ভৌগোলিক সীমানাই নয়, এর সঙ্গে জড়িয়ে থাকে দুটি রাষ্ট্রের সম্পর্কের গতিপ্রকৃতি, পারস্পরিক আস্থা ও মানবিকতার বিষয়গুলো।
দক্ষিণ এশিয়ায় প্রতিবেশী হিসেবে বাংলাদেশের জন্য ভারত গুরুত্বপূর্ণ একটি দেশ। দীর্ঘদিনের ঐতিহাসিক বন্ধুত্ব ও সহযোগিতার সম্পর্ক সত্ত্বেও সম্প্রতি সীমান্তের ঘটনা বাংলাদেশ-ভারত দ্বিপক্ষীয় সম্পর্ককে নতুন করে ভাবাচ্ছে।
ভারতের 'অপারেশন পুশ ব্যাক' নামের সাম্প্রতিক বিতর্কিত পদক্ষেপটি সম্পর্কের এই সংকটকে আরও গভীর করে তুলেছে।
ভারতের এই তথাকথিত 'অপারেশন পুশ-ব্যাক' বলতে মূলত দেশটিতে বসবাসরত 'অবৈধ বাংলাদেশি' নাগরিক ও রোহিঙ্গাদের কোনো আনুষ্ঠানিক ও আইনানুগ প্রক্রিয়া ছাড়াই সীমান্ত দিয়ে জোরপূর্বক বাংলাদেশে ঠেলে দেওয়ার বিষয়টি বোঝানো হচ্ছে।
এই প্রক্রিয়ায় মানবাধিকার ও আন্তর্জাতিক আইন স্পষ্টত লঙ্ঘিত হচ্ছে, যা বাংলাদেশ-ভারত দ্বিপাক্ষিক সম্পর্ককে গভীরভাবে প্রশ্নবিদ্ধ করেছে।
গত ১৫ জুনও ভারত থেকে পঞ্চগড়, ঠাকুরগাঁও, লালমনিরহাট ও মৌলভীবাজার সীমান্ত দিয়ে পুশ ইন করা ৫৪ জনকে আটক করেছে বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ (বিজিবি)।
সবচেয়ে আলোচিত ঘটনাগুলোর একটি ঘটেছে কুড়িগ্রাম সীমান্তে। গত ২৩ মে রাতে আসামের এক স্কুলশিক্ষক খাইরুল ইসলামসহ মোট ১৪ জনকে ভারতীয় কর্তৃপক্ষ জোরপূর্বক বাংলাদেশের ভেতরে ঠেলে দেয়।
খাইরুল ইসলাম আসামের মরিগাঁও জেলার মিকিরভেটা থানার বাসিন্দা। ভারতীয় নাগরিকত্ব নিয়ে তার একটি মামলা বর্তমানে ভারতের সুপ্রিম কোর্টে বিচারাধীন। অথচ এই বিচারাধীন অবস্থাতেই ভারতীয় কর্তৃপক্ষ তাকে সীমান্তের ওপারে ঠেলে দিয়েছে।
শুধু তা-ই নয়, খাইরুল ইসলাম সীমান্তে সাংবাদিকদের জানিয়েছেন, তাকে নির্যাতনের শিকার হতে হয়েছে। এমনকি হাত-চোখ বেঁধে, শারীরিক নির্যাতন করে তাদের বাংলাদেশে ঠেলে দেওয়া হয়েছে। এ ঘটনা কেবল অমানবিকই নয়, আন্তর্জাতিক মানবাধিকারেরও চরম লঙ্ঘন।
এ ঘটনার পর আসামের গুয়াহাটি হাইকোর্টে মামলা দায়ের হয়েছে। আসামের সিনিয়র আইনজীবী হাফিজ রশিদ চৌধুরী বলেছেন, 'যার নাগরিকত্ব নিয়ে সুপ্রিম কোর্টে মামলা চলছে, তাকে কীভাবে এভাবে অন্য দেশে ঠেলে দেওয়া হয়?' এই প্রশ্ন শুধু ভারতের অভ্যন্তরীণ আইনি ব্যবস্থার প্রতি নয়, বরং ভারতের নৈতিক অবস্থানের প্রতি একটি মৌলিক প্রশ্ন।
বাংলাদেশের দৃষ্টিকোণ থেকে এরকম ঘটনা কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্য নয়। বাংলাদেশ সরকার ও সীমান্তরক্ষী বাহিনী (বিজিবি) বরাবরই পরিষ্কার জানিয়েছে—বাংলাদেশের পক্ষ থেকে কোনো অবৈধ অভিবাসনকে উৎসাহ বা সমর্থন দেওয়া হয় না। কিন্তু আন্তর্জাতিক ও দ্বিপাক্ষিক নিয়ম অনুযায়ী যেকোনো প্রত্যাবাসন বা ফেরত পাঠানোর ক্ষেত্রে উভয় দেশের যৌথ বোর্ডের মাধ্যমে জাতীয়তা যাচাই করা জরুরি।
কিন্তু ভারতীয় কর্তৃপক্ষ কোনো যৌথ বোর্ড না করে, কোনো আনুষ্ঠানিক প্রক্রিয়া না মেনে একতরফাভাবে মানুষ ঠেলে দিচ্ছে। এটি স্পষ্টতই আন্তর্জাতিক মানবাধিকার এবং শরণার্থী আইনের (নন-রিফাউলমেন্ট) চরম লঙ্ঘন।
এর আগে, মে মাসের শুরুতে সেই কুড়িগ্রাম সীমান্ত দিয়ে জাতিসংঘের ইউএনএইচসিআর কর্তৃক নিবন্ধিত পাঁচজন রোহিঙ্গাকে রাতের আঁধারে ভারতীয় কর্তৃপক্ষ জোরপূর্বক বাংলাদেশে পুশ-ইন করেছিল। ভারতের আসামের মাটিয়া ক্যাম্প থেকে তাদের চোখ বেঁধে নিয়ে আসা হয় সীমান্তে।
এ ধরনের ঘটনা ভারতের মানবিক ও আইনি অবস্থানের প্রতি প্রশ্নচিহ্ন তৈরি করেছে।
এসব ঘটনার সঙ্গে যুক্ত হয়েছে আরেকটি মর্মান্তিক ঘটনা। ভারতের হরিয়ানা রাজ্য থেকে পাঁচজন বাংলাদেশি নাগরিক—নারী ও শিশুসহ—ত্রিপুরা সীমান্তের ফেনী নদীতে প্লাস্টিকের বোতল বেঁধে ফেলে দেওয়া হয়। ২২ মে স্থানীয়দের সহায়তায় বিজিবি তাদের উদ্ধার করে।
উদ্ধার হওয়া ব্যক্তিরা জানিয়েছেন, তাদের ওপর শারীরিক নির্যাতন চালানো হয়েছিল এবং তাদের সম্পদ কেড়ে নেওয়া হয়। এটিও আন্তর্জাতিক মানবাধিকার আইনের চরম লঙ্ঘন।
এসব ঘটনার পেছনে ভারতের অভ্যন্তরীণ রাজনীতির একটি বড় ভূমিকা রয়েছে। বিজেপি সরকার 'অবৈধ অভিবাসী' ও 'অনুপ্রবেশ' ইস্যুকে রাজনৈতিকভাবে ব্যবহার করছে।
আসামের মুখ্যমন্ত্রী হিমন্ত বিশ্ব শর্মা প্রকাশ্যেই ঘোষণা করেছেন যে, কোনো ধরনের আইনি প্রক্রিয়া ছাড়াই তারা 'পুশ-ব্যাক' কার্যক্রম চালিয়ে যাবেন। এই ধরনের বক্তব্য কেবল ভারতের অভ্যন্তরীণ রাজনীতিকেই উত্তপ্ত করছে না, বরং আন্তর্জাতিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে একটি নেতিবাচক দৃষ্টান্ত তৈরি করছে।
ভারতীয় গণমাধ্যমেও বাংলাদেশ নিয়ে নেতিবাচক ও বিদ্বেষমূলক প্রচারণা বেড়েছে। 'বাংলাদেশি অনুপ্রবেশকারী', 'দেশবিরোধী ষড়যন্ত্র', 'ভূমি জিহাদ'-এর মতো শব্দগুলো ক্রমাগত ব্যবহার করে ভারতীয় জনমতকে বাংলাদেশের বিরুদ্ধে উসকে দেওয়া হচ্ছে। এটি দুই দেশের সাধারণ মানুষের মাঝে আস্থাহীনতা তৈরি করছে।
বাংলাদেশ বরাবরই দায়িত্বশীল ভূমিকা পালন করেছে। বিজিবি সীমান্ত এলাকায় নিরাপত্তা জোরদার করেছে। বাংলাদেশের জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা খলিলুর রহমান স্পষ্ট করেছেন যে, কোনো ব্যক্তিকে আনুষ্ঠানিক যাচাই ছাড়া গ্রহণ করা হবে না। প্রতিটি ঘটনার বিস্তারিত নথিপত্র, সাক্ষ্যপ্রমাণ, ভিডিও ফুটেজসহ ডিজিটাল আর্কাইভ তৈরি করা হচ্ছে, যা প্রয়োজন হলে আন্তর্জাতিক ফোরামে ব্যবহার করা যাবে।
বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্ক ঐতিহাসিক ও গুরুত্বপূর্ণ। দুই দেশের অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক বিনিময়ের সম্ভাবনা অনেক। কিন্তু এই সম্ভাবনা তখনই বাস্তব হবে, যখন ভারত একটি দায়িত্বশীল প্রতিবেশী রাষ্ট্র হিসেবে আচরণ করবে। মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনা কোনোভাবেই দ্বিপাক্ষিক সম্পর্কের উন্নয়নকে সহায়তা করবে না, বরং দীর্ঘ মেয়াদে সম্পর্ককে ক্ষতিগ্রস্ত করবে।
ভারতের উচিত অবিলম্বে এই ধরনের কর্মকাণ্ড বন্ধ করা, আন্তর্জাতিক মানবাধিকার ও শরণার্থী আইনকে সম্মান করা এবং বিজিবির সঙ্গে সমন্বয়ের মাধ্যমে সীমান্ত পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনুষ্ঠানিক ও মানবিক পদ্ধতি অনুসরণ করা। সেই সঙ্গে ভারতীয় গণমাধ্যমের দায়িত্বশীল ভূমিকা পালন করা অত্যন্ত জরুরি।
একটি দায়িত্বশীল রাষ্ট্র হিসেবে ভারতকে অবশ্যই প্রতিবেশীর মর্যাদা ও সার্বভৌমত্বের প্রতি সম্মান প্রদর্শন করতে হবে। 'পুশ ব্যাক' কিংবা 'পুশ ইন'-এর মতো মানবিক বিপর্যয়ের মধ্য দিয়ে সম্পর্কের ভিত্তি কখনো দৃঢ় হয় না। ভারতের রাজনৈতিক নেতাদের অবশ্যই মনে রাখতে হবে, সীমান্তের রক্ত ও কান্নার মধ্য দিয়ে নয়, বরং পারস্পরিক শ্রদ্ধা ও মানবিকতার মধ্য দিয়েই একটি সত্যিকার স্থিতিশীল প্রতিবেশী সম্পর্ক নির্মাণ করা যায়।
ভারত-বাংলাদেশের কূটনৈতিক ইতিহাসে এটি একটি কঠিন সময়। কিন্তু এই সংকট উত্তরণে ভারতীয় কর্তৃপক্ষের মানবিক ও বাস্তবিক পদক্ষেপই সবচেয়ে জরুরি। দ্বিপাক্ষিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে মানবাধিকার লঙ্ঘন কোনো বিকল্প হতে পারে না—এটাই দক্ষিণ এশিয়ার শান্তি ও স্থিতিশীলতার জন্য সবার উপলব্ধি করা উচিত।
অবশেষে বলতে হয়, সীমান্তে মানবাধিকার লঙ্ঘন বন্ধ না করলে কেবল ভারত নয়, পুরো দক্ষিণ এশিয়ার স্থিতিশীলতাই হুমকির মুখে পড়বে। প্রতিবেশীর প্রতি এ ধরনের আচরণ বিশ্বের কাছে একটি নেতিবাচক দৃষ্টান্ত স্থাপন করবে, যা কারও কাম্য নয়।
সময় এসেছে, ভারতকে প্রমাণ করতে হবে—তারা কী ধরনের প্রতিবেশী হতে চায়। মানবিক, নৈতিক নাকি অন্য কিছু? এই প্রশ্নের উত্তরই নির্ধারণ করবে দক্ষিণ এশিয়ার ভবিষ্যৎ।
সাঈফ ইবনে রফিক: কবি ও সাংবাদিক
Comments