নৌবাহিনী: শীর্ষ শক্তিধর দেশ

বিশ্বের অর্ধেকেরও বেশি অঞ্চলে শাসন, প্রভাব ও আধিপত্য বিস্তারের পেছনে ছিল ইংরেজদের শক্তিশালী নৌবাহিনী। আধুনিক সময়ে নৌবাহিনীর ক্ষেত্র হয়েছে আরও বিস্তৃত ও বহুমুখী।
নৌবাহিনী

বিশ্বের অর্ধেকেরও বেশি অঞ্চলে শাসন, প্রভাব ও আধিপত্য বিস্তারের পেছনে ছিল ইংরেজদের শক্তিশালী নৌবাহিনী। আধুনিক সময়ে নৌবাহিনীর ক্ষেত্র হয়েছে আরও বিস্তৃত ও বহুমুখী।

বিমানবাহী জাহাজ, যুদ্ধজাহাজ, সাবমেরিনের বহরসহ এতে যোগ হয়েছে আরও আধুনিক সরঞ্জাম। এগুলো শুধু সমুদ্রক্ষেত্রে নয় বরং স্থল ও আকাশেও যুদ্ধের সক্ষমতা রাখে।

প্রতিকূল উপকূলে সেনা ও সাঁজোয়া যান সরবরাহ থেকে শুরু করে নিজ দেশের ভূখণ্ডে শত্রুকে পাল্টা আক্রমণ করার জন্য এগুলো প্রস্তুত করা হয়।

শুধু জাহাজের সংখ্যার ওপরই একটি দেশের নৌবাহিনীর শক্তি নির্ভর করে না। এক্ষেত্রে জাহাজ, অস্ত্র ও সরঞ্জামগুলো প্রযুক্তিগত দিক দিয়ে কতটা এগিয়ে সে বিষয়টিও গুরুত্বপূর্ণ।

প্রযুক্তিতে পিছিয়ে থাকা এবং পুরনো একাধিক জাহাজের বিপরীতে একটি প্রযুক্তিগত দিক দিয়ে উন্নত জাহাজের শক্তিতে এগিয়ে থাকা মোটেও অস্বাভাবিক নয়। শুধু সংখ্যাগত দিক বিবেচনায় না নিয়ে একাধিক বিষয়ে গুরুত্ব দিতে হবে।

দেখে নেওয়া যাক, ২০২২ সালে নৌবাহিনীতে বিশ্বের শীর্ষ শক্তিধর দেশগুলোর জনবল, জাহাজ, অস্ত্র ও সরঞ্জামগুলো সম্পর্কে।

যুক্তরাষ্ট্রের নৌবাহিনী

বিশ্বের সবচেয়ে শক্তিশালী ও সক্ষম নৌবাহিনীর মধ্যে মার্কিন নৌবাহিনী অন্যতম। গ্লোবাল ফায়ার পাওয়ার ইনডেক্সের তথ্য অনুযায়ী দেশটির নৌবহরে আছে পৃথিবীর সবচেয়ে বেশি সংখ্যক বিমানবাহী রণতরী। এর সংখ্যা ১১ এবং হেলিকপ্টারবাহী রণতরী আছে ৯টি।

যুক্তরাষ্ট্রের নৌবাহিনীর ইউএসএস জেরাল্ড ও ফোর্ড বিশ্বের বৃহত্তম বিমানবাহী রণতরী।

কম শব্দে চলতে পারা ও প্রযুক্তিগতভাবে উন্নত ডেস্ট্রয়ারগুলো মার্কিন নৌবহরের গুরুত্বপূর্ণ অংশ। দেশটির অধীনে আছে ৯২টি ডেস্ট্রয়ার। এগুলো এখন পর্যন্ত পৃথিবীর বৃহত্তম ডেস্ট্রয়ার। এগুলো প্রাথমিকভাবে স্থলে আক্রমণের জন্য মোতায়েন করা হয়।

তবে, যুক্তরাষ্ট্রের কোনো ফ্রিগেট নেই। কর্ভেট আছে ২২টি ও উভচর যুদ্ধজাহাজ ৩৪টি।

যুক্তরাষ্ট্রের আছে পারমাণবিক শক্তিতে চালিত সাবমেরিন। যেগুলোয় আছে আন্তঃমহাদেশীয় পারমাণবিক ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র। তাদের মোট সাবমেরিনের সংখ্যা ৬৮টি।

এ ছাড়া, দেশটির আছে ১০টি টহল জাহাজ, ৮টি মাইন ওয়ারফেয়ার ক্রাফট। নেভাল এভিয়েশনের অধীনে আছে ২ হাজার ৬২৬টি বিমান। যুক্তরাষ্ট্রের নৌবাহিনীতে সক্রিয় সদস্যের সংখ্যা প্রায় ৩ লাখ ৫০ হাজার।

চীনের নৌবাহিনী

চীন দ্রুত গতিতে যুদ্ধজাহাজ ও সাবমেরিন তৈরির মাধ্যমে বিশ্বব্যাপী এক শক্তিশালী প্রতিযোগী হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে।

চীনের নৌবাহিনী পিপলস লিবারেশন আর্মির বহরে আছে ৩টি বিমানবাহী ও ১টি হেলিকপ্টারবাহী রণতরী। সম্প্রতি, দেশটির তাদের তৃতীয় ও প্রযুক্তিগত দিক দিয়ে সবচেয়ে উন্নত বিমানবাহী রণতরী ফুজিয়ান উদ্বোধন করেছে।

চীনের ৪১টি ডেস্ট্রয়ার, ৪৯টি ফ্রিগেট ও ৭০টি কর্ভেট আছে। সাবমেরিনের সংখ্যা ৭৯। টহল জাহাজের সংখ্যা ১৫২ ও মাইন ওয়ারফেয়ার ক্রাফট ৩৬।

চীনের নেভাল এভিয়েশনের অধীনে আছে ৬০০'র বেশি বিমান। নৌবাহিনীর সক্রিয় সদস্যের সংখ্যা প্রায় ৩ লাখ।

যদিও চীনের বহরে যুক্তরাষ্ট্রের চেয়ে জাহাজ সংখ্যা বেশি তবে সেগুলো এখনো ততটা অত্যাধুনিক নয়। দেশটির এর দ্রুত সম্প্রসারণের ক্ষমতা থেকে বোঝা যায় এটি পৃথিবীর যেকোনো শক্তিশালী নৌবাহিনীকে চ্যালেঞ্জ করার সক্ষমতা রাখে।

নৌবাহিনী

রাশিয়ার নৌবাহিনী

রাশিয়ার নৌবাহিনীর বহরে বিমানবাহী রণতরী আছে একটি, তবে কোনো হেলিকপ্টারবাহী রণতরী নেই।

দেশটির উভচর যুদ্ধজাহাজ আছে ৫২টি, ডেস্ট্রয়ার ১৫টি, ফ্রিগেট ১১টি, কর্ভেট ৮৬টি এবং টহল জাহাজ আছে ৫৯টি। মাইন ওয়ারফেয়ার ক্রাফট আছে ৪৯টি। নেভাল এভিয়েশনের অধীনে আছে ৩৫৯'র বেশি বিমান। নৌবাহিনীতে সক্রিয় সদস্যের সংখ্যা প্রায় ১ লাখ ৫০ হাজার থেকে ৬০ হাজারের মতো।

রাশিয়ার নৌবাহিনীর 'মেরুদণ্ড' বলা হয় এর পারমাণবিক শক্তি চালিত সাবমেরিনগুলোকে। এ দেশের মোট সাবমেরিনের সংখ্যা ৭০। এগুলো মেরিন ইনফ্যান্ট্রি ও ব্যালিস্টিক মিসাইল, পারমাণবিক ক্ষমতাসম্পন্ন আন্তঃমহাদেশীয় ক্ষেপণাস্ত্র বহন ও উৎক্ষেপণে সক্ষম। রাশিয়ার আছে বিশ্বের সবচেয়ে বড় সাবমেরিন বেলগোরোড (কে-৩২৯)।

ব্রিটেনের নৌবাহিনী

বিশ্বে প্রায় ২০০ বছরের শক্তিশালী সাম্রাজ্য ব্রিটেনের রয়্যাল নেভির শক্তির ওপর ভর করে দাঁড়িয়ে ছিল। ইউনাইটেড কিংডমের রয়্যাল নেভির নৌবহরে আছে প্রায় ৭৫টি জাহাজ।

ব্রিটেনের বিমানবাহী রণতরী আছে ২টি। কোনো হেলিকপ্টারবাহী রণতরী নেই। উভচর যুদ্ধজাহাজ ৬টি, ডেস্ট্রয়ার ৬টি ও ফ্রিগেট ১২টি থাকলেও কোনো কর্ভেট নেই।

রয়্যাল নেভির সাবমেরিন আছে ১০টি। প্রতিটি সাবমেরিনে বসানো পারমাণবিক ক্ষেপণাস্ত্র প্রতিটি দেশকে ৩ বার নিশ্চিহ্ন করার ক্ষমতা রাখে। টহল জাহাজ ও মাইন ওয়ারফেয়ার ক্রাফটের সংখ্যা যথাক্রমে ২৬টি ও ১১টি।

ব্রিটেনের প্রায় সব যুদ্ধজাহাজ রয়্যাল নেভি নিজেই তৈরি করে। পৃথিবীর সবচেয়ে আধুনিক জাহাজ আছে এই নৌবহরে। রয়্যাল নেভির এইচএমএস ভিক্টরি বিশ্বের প্রাচীনতম নৌ জাহাজ, যা এখনো সক্রিয়। এটি ২০২২ সালে ২৪৪ বছর পূর্ণ করেছে।

জাপানের নৌবাহিনী

জাপান মেরিটাইম সেলফ ডিফেন্স ফোর্সের অধীনে ৪টি হেলিকপ্টারবাহী রণতরী থাকলেও বিমানবাহী রণতরীর সংখ্যা শূন্য।

জাপানের উভচর যুদ্ধজাহাজ ৭টি, ডেস্ট্রয়ার ৩৬টি ও কর্ভেট ৬টি থাকলেও ফ্রিগেট নেই।

দেশটির মোট সাবমেরিন ২১টি। টহল জাহাজ ও মাইন ওয়ারফেয়ার ক্রাফট আছে যথাক্রমে ৬টি ও ২১টি।

এ দেশের বাহিনীতে সক্রিয় সদস্যের সংখ্যা প্রায় ৫০ হাজার ৮০০ জন। নেভাল এভিয়েশন পরিচালনা করে ৩৪৬টি বিমান।

জাপানি নৌবাহিনীর আছে অত্যাধুনিক যুদ্ধজাহাজ। এগুলো সবচেয়ে অত্যাধুনিক ও উন্নত সাবমেরিনগুলোর একটি বহর পরিচালনা করে।

তবে জাপানের নৌবাহিনী শুধুমাত্র আত্মরক্ষার জন্য তৈরি। এ কারণে তাদের নৌবাহিনী পারমাণবিক সাবমেরিন পরিচালনা করে না।

ফ্রান্সের নৌবাহিনী

ফরাসি মেরিন ন্যাশনাল বিশ্বের প্রাচীনতম নৌবাহিনীর একটি। বিশ্বজুড়ে ফরাসি সাম্রাজ্যের বিস্তার ও প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে এটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিল। এর নৌবহরে আছে প্রায় ১৮০টি জাহাজ। বিমানবাহী রণতরীর সংখ্যা ১টি ও হেলিকপ্টারবাহী রণতরীর সংখ্যা ৩।

ফ্রান্সের উভচর যুদ্ধজাহাজ ৩টি, ডেস্ট্রয়ার ১০টি ও ফ্রিগেট ১১টি থাকলেও কর্ভেট নেই।

ফরাসি নৌবাহিনীর মোট সাবমেরিনের সংখ্যা ১০। টহল জাহাজ আছে ১৫টি ও মাইন ওয়ারফেয়ার ক্রাফট আছে ১৭টি।

এর নৌবাহিনীতে সক্রিয় সদস্যের সংখ্যা প্রায় ৩৭ হাজার। তাদের নেভাল এভিয়েশনের অধীনে আছে ১৭৮টি বিমান।

যুক্তরাষ্ট্রের বাইরে ফ্রান্সের চার্লস ডি গল পৃথিবীর একমাত্র পারমাণবিক শক্তিচালিত যুদ্ধজাহাজ। এর অস্ত্রাগারে আছে শক্তিশালী পারমাণবিক অস্ত্রের সংগ্রহ।

ভারতের নৌবাহিনী

ভারতীয় নৌবাহিনীকে আনুষ্ঠানিকভাবে রয়্যাল ইন্ডিয়ান নেভি বলা হয়। ভারতীয় নৌবাহিনী দক্ষিণ এশীয় শক্তি হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে।

এ দেশের নৌবাহিনীতে আছে ২টি বিমানবাহী রণতরী—একটি আইএনএস বিক্রমাদিত্য ও অন্যটি দেশীয়ভাবে তৈরি আইএনএস বিক্রান্ত। তবে কোনো হেলিকপ্টারবাহী রণতরী নেই।

ভারতের আছে বিশ্বের সবচেয়ে সক্ষম কয়েকটি ডেস্ট্রয়ার। এর সংখ্যা ১০টি। উভচর যুদ্ধজাহাজ আছে ৬টি, ফ্রিগেট ১৩টি ও কর্ভেট ২২টি।

ভারতীয় নৌবাহিনীর সাবমেরিন আছে ১৭টি। ভারত সেই ৫টি দেশের একটি যারা পারমাণবিক শক্তিচালিত সাবমেরিন তৈরির প্রযুক্তিগত জ্ঞান রাখে এবং তৈরি করে। ভারতের ২টি পারমাণবিক শক্তিসম্পন্ন সাবমেরিন আছে।

ভারতের টহল জাহাজ ১২৮টি। নৌবাহিনীতে সক্রিয় সদস্যের সংখ্যা ৬৭ হাজার ৩০০ জন। নেভাল এভিয়েশনের অধীনে আছে ৩০০টি বিমান।

দক্ষিণ কোরিয়ার নৌবাহিনী

দক্ষিণ কোরিয়ার নৌবাহিনীতে আছে ২৩৪টি জাহাজ। আছে ২টি হেলিকপ্টারবাহী রণতরী, ৩৪টি উভচর যুদ্ধজাহাজ, ১২টি ডেস্ট্রয়ার, ১৮টি ফ্রিগেট ও ১১টি কর্ভেট।

দেশটির নৌবাহিনীর মোট সাবমেরিনের সংখ্যা ২২টি। টহল জাহাজ আছে ১১১টি ও মাইন ওয়ারফেয়ার ক্রাফট ১৩টি। সক্রিয় কর্মীর সংখ্যা মোট ৭০ হাজার। নেভাল এভিয়েশনের আছে ৭০টি বিমান।

ইতালির নৌবাহিনী

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ পর্যন্ত ইতালির নৌবাহিনীকে রয়্যাল নেভি বলা হতো। এর বিমানবাহী রণতরী আছে ২টি তবে হেলিকপ্টারবাহী রণতরী নেই।

এর উভচর যুদ্ধজাহাজ আছে ৩টি, ডেস্ট্রয়ার ৪টি ও ফ্রিগেট ১৩টি। এর নৌবাহিনীর সাবমেরিন আছে ৮টি এবং টহল জাহাজ ও মাইন ওয়ারফেয়ার ক্রাফটের সংখ্যা যথাক্রমে ২১টি ও ১০টি।

নৌবাহিনীতে সক্রিয় কর্মীর সংখ্যা ৩১ হাজার।

এর নেভাল এভিয়েশনে থাকা ৭০টি বিমান দেশটির বিমানবাহিনী পরিচালনা করে।

ইতালীয় নৌবাহিনীর বহরে অনেক ধরনের যুদ্ধজাহাজ আছে। এর বিমানবাহী রণতরী বিমানের পাশাপাশি হেলিকপ্টারবাহী হিসেবেও কাজ করতে পারে।

তাইওয়ানের নৌবাহিনী

তাইওয়ান আয়তনে ছোট হলেও এই দেশটির শক্তিশালী নৌবাহিনী আছে। দেশটির নৌবাহিনীর বহরে আছে ১১৭টি জাহাজ।

এ দেশের উভচর যুদ্ধজাহাজের সংখ্যা ৭। ডেস্ট্রয়ার আছে ৪টি, ফ্রিগেট ২২টি ও কর্ভেট ১৪টি।

তাইওয়ানের নৌবাহিনীর সাবমেরিন আছে ৪টি। এর টহল জাহাজের সংখ্যা ৪৩। মাইন ওয়ারফেয়ার ক্রাফট আছে ১৪টি। নৌবাহিনীতে সক্রিয় কর্মীর সংখ্যা ৩৮ হাজার ও নেভাল এভিয়েশনের অধীনে বিমান আছে ২৮টি।

তথ্যসূত্র: গ্লোবাল ফায়ারপাওয়ার ইনডেক্স, ওয়ার্ল্ড ডিরেক্টরি অফ মডার্ন মিলিটারি ওয়ারশিপস, বিবিসি, রয়টার্স, আল জাজিরা, এভিয়েশন ডিফেন্স ইউনিভার্স

Comments