যাদের হারিয়ে শোকাহত বাংলা একাডেমি
মৃত্যুর চেয়েও মানুষকে অনেক বেশি আচ্ছন্ন করে রাখছে মৃত্যুভয়। ভয়ের দোলাচলের মধ্যেই আমরা হারিয়েছি বেশ কয়েকজন গুণী ব্যক্তিকে। তাদের সঙ্গে আর কোনদিন দেখা হবে না। কবি-সাহিত্যিক-শিল্পীদের শারীরিক মৃত্যু হলেও তারা তাদের সৃষ্টির মাধ্যমে বেঁচে থাকেন কাল থেকে কালান্তর।
গত এক বছরে আমরা অনেককে হারিয়েছি। তাদের মধ্যে দায়িত্বে থাকা অবস্থায় ত্রিরত্ন হারিয়েছে বাংলা একাডেমি। তারা বাঙালি জাতিসত্তা ও বুদ্ধিবৃত্তিক উৎকর্ষের অনন্য প্রতিষ্ঠানটির গুরুত্বপূর্ণ পদে ছিলেন। রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনের পথ ধরেই ১৯৫৫ সালের ৩ ডিসেম্বর গড়ে ওঠে আমাদের বুদ্ধিবৃত্তিক চর্চার অন্যতম বাতিঘর বাংলা একাডেমি।
১৯৫৪ সালে যুক্তফ্রন্টের একুশ দফার দাবিতে প্রতিষ্ঠিত একাডেমি ধারণ করেছে বঙ্গবন্ধুর ছয় দফা, গণ-অভ্যুত্থান হয়ে মহান মুক্তিযুদ্ধকে। দীর্ঘ রাজনৈতিক ঘটনাপ্রবাহে এই একাডেমির মাধ্যমে বাঙালি সংস্কৃতির চেতনা উন্মোচিত হয়েছে।
শিল্পী, সাহিত্যিক, সাংস্কৃতিক কর্মীদের আন্দোলনে যারা গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখেছেন তাদের অন্যতম ছিলেন জাতীয় অধ্যাপক আনিসুজ্জামান ও অধ্যাপক শামসুজ্জামান খান। সেসব আন্দোলনে যুক্ত ছিলেন কবি হাবীবুল্লাহ সিরাজীও। বাংলা একাডেমির সদ্য হারানো গুণীজনদের নিয়ে এই আলোচনা।
মহামারি করোনা কেড়ে নিয়েছে দুই মনীষীকে। তাদের হারিয়ে যখন বেদনায় ভার হয়ে আছে মন তখনি ক্যান্সারে আক্রান্ত হয়ে চলে গেলেন কবি হাবীবুল্লাহ সিরাজী।
তারপরও থেমে নেই। মৃত্যুর মিছিল দীর্ঘ থেকে দীর্ঘতর হচ্ছে, এ যেন শেষ হওয়ার নয়। গত ১০ মে করোনায় আক্রান্ত হয়ে লেখক-গবেষক-বাংলা একাডেমির সহকারী পরিচালক আহমদ মমতাজ মারা গেছেন। তার রচিত বইয়ের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে ‘মুক্তিযুদ্ধের কিশোর ইতিহাস’ ও ‘শমশের গাজী’।
বাংলা একাডেমির তথ্য মতে, হাবীবুল্লাহ সিরাজী বাংলা একাডেমির দায়িত্ব নেন ২০১৮ সালের ২০ ডিসেম্বর। তিনি মারা যান গত ২৪ মে।
শামসুজ্জামান খান মহাপরিচালক হিসেবে ছিলেন ২০০৯ সালের ২৪ মে থেকে ২০১৮ সালের ১৯ ডিসেম্বর পর্যন্ত।
ইমেরিটাস অধ্যাপক আনিসুজ্জামান বাংলা একাডেমির সভাপতি হিসেবে দায়িত্ব নেন ২০১২ সালের ১৩ ডিসেম্বর এবং মারা যান ২০২০ সালের ১৪ মে। অধ্যাপক শামসুজ্জামান খান সভাপতির দায়িত্ব পান ২০২০ সালের ২৯ জুন এবং মারা যান গত ১৪ মে।
সদ্য দায়িত্বপ্রাপ্ত সভাপতি অধ্যাপক রফিকুল ইসলাম দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, ‘তিন জনের বিদায় অত্যন্ত শোকের। বাংলা একাডেমির অপূরণীয় ক্ষতি হয়েছে। বাংলাদেশের জন্যও তারা গুরুত্বপূর্ণ ছিলেন। এমন মেধা-মননের মানুষ আর পাবো কি না সন্দেহ।’
‘একাডেমি পরিচালনা করতে যে যোগ্যতা প্রয়োজন তা তাদের ছিল,’ উল্লেখ করে তিনি আরও বলেন, ‘এখন তাদের স্থানে কারা আসবে জানি না। আমি তাদের চিরশান্তি কামনা করছি। আর প্রত্যাশা করব যোগ্য লোকই পাবে বাংলা একাডেমি।’
আনিসুজ্জামান
আবু তৈয়ব মহম্মদ আনিসুজ্জামান। এটি তার পারিবারিক নাম। তার জন্ম ১৯৩৭ সালের ১৮ ফেব্রুয়ারি, পশ্চিমবঙ্গের ২৪ পরগনায়। দেশভাগের পর তিনি চলে আসেন ঢাকায়। বাবা এটিএম মোয়াজ্জেম ছিলেন বিখ্যাত হোমিওপ্যাথি চিকিৎসক। মা সৈয়দা খাতুনের ছিল লেখালেখির অভ্যাস।
অন্য দিকে, বাঙালি মুসলিম সমাজের বড় মানুষদের একজন ছিলেন শেখ আব্দুর রহিম। বাংলা ভাষায় তিনি নবী মুহাম্মদ (স.) জীবনী লিখেছেন। তার নাতি আনিসুজ্জামান হয়েছিলেন বাংলাদেশের জাতীয় অধ্যাপক। তিনি বাংলা সাহিত্য-সংস্কৃতির আকাশ আলোকিত করেছেন।
আনিসুজ্জামান মাত্র ২৫ বছর বয়সে পিএইচডি অর্জন করেন ‘বাংলা সাহিত্য ও মুসলিম মানস’ অভিসন্দর্ভ লিখে। তিনি তা উৎসর্গ করেছিলেন জ্ঞানতাপস ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহকে। এটি তাকে বাংলা গবেষণা সাহিত্যে স্থায়ী আসন দিয়েছিল। পরে তিনি ‘পুরনো বাংলা গদ্য’, ‘স্বরূপ সন্ধান’, ‘বিপুলা পৃথিবী’, ‘আমার একাত্তর’সহ অনেক বই রচনা করেন।
শিক্ষা-সাহিত্য-সংস্কৃতির অঙ্গনে স্বল্পভাষী আনিসুজ্জামান ছিলেন বহুল আলোচিত ব্যক্তিত্ব। তিনি দেশের শীর্ষ গবেষক, চিন্তাবিদ ও সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব হিসেবে সর্বজন সমাদৃত ছিলেন।
১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলন থেকে ১৯৭১ সালের স্বাধীনতা ও এর পরবর্তীতে সমাজ জীবনের অসংগতি ও সংকট মোচন করতে বাঙালি যে সংগ্রাম করে চলেছে, তাতে তিনি অংশ নিয়েছিলেন ও নেতৃত্ব দিয়েছিলেন। অর্থাৎ সংবিধানের বাংলা অনুবাদক হিসেবেও তিনি শেকড়ের অনুসন্ধান করেছেন।
ফলে বিদ্বৎসমাজে তার জীবনাচার বিস্ময়কর এবং তা নিয়ে আলোচনার অনেক দিক রয়েছে। তীক্ষ্ণ মেধার বিরলপ্রজ এই মানুষের জীবনবোধ সমাজের নানান অলিগলিতে প্রভাব ফেলেছে। আবার কখনো মঞ্চে, কখনো সভাপ্রধান হিসেবে সম্ভাবনাকে গুরুত্ব দিয়ে সমস্যাকে মোকাবিলা করেছেন।
আনিসুজ্জামানের জীবনজুড়ে ছিল প্রায় এক শতাব্দীর ভাঙা-গড়া ও বাঙালির ইতিহাস-ঐতিহ্যের প্রতিচ্ছায়া। এক সাক্ষাৎকারে তিনি বলেছিলেন— ‘১৯৫২ সালে ভাষা আন্দোলনে আমি সক্রিয়ভাবে অংশ নিয়েছি। মনে হয়েছে, এই আন্দোলনের জন্য আমি প্রাণ পর্যন্ত দিতে পারি।’
শামসুজ্জামান খান
শামসুজ্জামান খানের জন্ম ১৯৪০ সালের ২৯ ডিসেম্বর মানিকগঞ্জ জেলার চারিগ্রামে। মা ও দাদির তত্ত্বাবধানে তার শৈশব, কৈশোরের পাঠ ও মানস গড়ে ওঠে। বাবা এমআর খান কলকাতায় একজন পরিচিত অনুবাদক ছিলেন। প্রপিতামহ এলহাদাদ খান ও তার ভাই আদালত খান ঔপনিবেশিক শাসনামলে স্বনামধন্য বুদ্ধিজীবী ছিলেন। সাহিত্যিক মীর মশাররফ হোসেনের বন্ধু ছিলেন এলহাদাদ খান।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের থেকে শিক্ষাজীবন শেষে শিক্ষকতা দিয়ে কর্মজীবন শুরু করেছিলেন শামসুজ্জামান খান। বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সময় তিনি শিক্ষক ও তরুণ বন্ধুদের অনুপ্রেরণায় লেখালেখিতে মনোযোগ দেন।
তিনি মুন্সিগঞ্জের হরগঙ্গা কলেজ, ঢাকা জগন্নাথ কলেজ, ময়মনসিংহ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় ও জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যাপনা করেন। পরে তিনি বাংলাদেশ জাতীয় জাদুঘর ও বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমির মহাপরিচালক হিসেবেও দায়িত্ব পালন করেছিলেন।
লোকশিল্প গবেষক শামসুজ্জামানের রচিত ও সম্পাদিত গ্রন্থের সংখ্যা শতাধিক। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য ‘ফোকলোর চর্চা’, ‘বঙ্গবন্ধুর রাষ্ট্রচিন্তা ও বর্তমান বাংলাদেশ’, ‘বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে আলাপ ও অন্যান্য প্রসঙ্গ’, ‘মুক্তবুদ্ধি’, ‘ধর্মনিরপেক্ষতা ও সমকাল’, ‘বাঙালির বহুত্ববাদী লোকমনীষা’, ‘মীর মশাররফ হোসেন: নতুন তথ্যে নতুন ভাষ্যে’, ‘সৃজনভুবনের আলোকিত মানুষেরা’, ‘রঙ্গরসের গল্পসমগ্র’, ‘কিশোর রচনাসমগ্র’, ‘বাংলাদেশের উৎসব’, ‘বাংলা সন ও পঞ্জিকা’ ও ‘ফোকলোর চিন্তা’।
তিনি বাংলাদেশের লোকজ সংস্কৃতি গ্রন্থমালা শিরোনামে ৬৪ খণ্ডে ৬৪ জেলার লোকজ সংস্কৃতির সংগ্রহশালা সম্পাদনা এবং ১১৪ খণ্ডে বাংলাদেশের ফোকলোর সংগ্রহমালা সম্পাদনা করেছিলেন।
হাবীবুল্লাহ সিরাজী
কবি হাবীবুল্লাহ সিরাজীর জন্ম ১৯৪৮ সালের ৩১ ডিসেম্বর ফরিদপুর জেলার রসুলপুরে। তার বাবা আবুল হোসেন সিরাজী ও মা জাহানারা বেগম। ফরিদপুর জিলা স্কুল থেকে মাধ্যমিক, ফরিদপুরের রাজেন্দ্র কলেজ থেকে উচ্চমাধ্যমিক ও বুয়েট থেকে প্রকৌশলে স্নাতক পাশ করেন।
তিনি কবিতার পাশাপাশি গদ্যও লিখতেন চমৎকার। তার অনবদ্য অনুবাদ পাঠকদের আকৃষ্ট করে। তিনি চিন্তা ও ভঙ্গিমায় স্বতন্ত্র ছিলেন। প্রাবন্ধিক হিসেবেও ছিলেন সুপাঠ্য। তার লেখায় থাকে লোকজ ও বিশ্বসাহিত্য-সংস্কৃতির নানা প্রসঙ্গ-অনুষঙ্গ।
তার আখ্যানমূলক ও আত্মজৈবনিক রচনা প্রশংসার দাবিদার। তিনি শিশু-কিশোর সাহিত্যে স্বমহিমায় সমুজ্জ্বল। নতুন প্রজন্মের বোধে ধরা দেয় তার ছড়া, কবিতা ও শিশুতোষ রচনা। সব মিলিয়ে বাংলা সাহিত্যে হাবীবুল্লাহ সিরাজী এক বিশিষ্ট নাম।
তার প্রকাশিত কাব্যগ্রন্থের মধ্যে আছে- ‘দাও বৃক্ষ দাও দিন’, ‘মোমশিল্পের ক্ষয়ক্ষতি’, ‘মধ্যরাতে দুলে ওঠে গ্লাশ’, ‘হাওয়া কলে জোড়া গাড়ি’, ‘নোনা জলে বুনো সংসার’, ‘স্বপ্নহীনতার পক্ষে’, ‘আমার একজনই বন্ধু’, ‘পোশাক বদলের পালা’, ‘বিপ্লব বসত করে ঘরে’, ভুলের কোনো শুদ্ধ বানান নেই’, ‘শূন্য’, ‘পূর্বে না উত্তরে’, ‘ইতিহাস বদমাশ হলে মানুষ বড়ো কষ্ট পায়’, ‘আমার জ্যামিতি’, ‘পশ্চিমের গুপ্তচর’, ‘মিথ্যে তুমি দশ পিঁপড়ে’, ‘কবিরাজ বিল্ডিংয়ের ছাদ’, ‘বডিমিস্ত্রি ফেসবুক’, ‘যে শ্রেষ্ঠ একা’, ‘আমি জেনারেল’ ইত্যাদি।
কয়েকদিন আগে এক অনলাইন সাক্ষাৎকারে তাকে প্রশ্ন করা হয়েছিল— বিশ্বযুদ্ধ-পরবর্তী সময়ে আপনার জন্ম, একাত্তরের যুদ্ধ আপনি দেখেছেন। মহামারির মধ্যে দিয়ে যাচ্ছি, আপনি কতটা আশাবাদী?
উত্তরে হাবীবুল্লাহ সিরাজী বলেছিলেন, ‘মহামারিতে আমরা নিমজ্জিত, এটা যুদ্ধের চেয়েও ভয়ঙ্কর। যুদ্ধে অন্তত বুঝতে পারি আমাদের প্রতিপক্ষ কে এবং আত্মরক্ষায় কী কী করতে হবে। কিন্তু, এই যে মহামারি আমাদের তছনছ করে দিয়েছে, আমাদের পরিবারের মধ্যেও প্রবেশ করছে— এর মতিগতি বোঝা মুশকিল।’
তিনি ‘ভয় ও মৃত্যু’ শিরোনামে কবিতায় লিখেন, ‘ভয় সামনে এলে উল্টে যায় চিত্রফল জলের বিলাস থেকে রৌদ্রের সাহস সে সরল হ’তে পারে অথবা সবল তাকে অতিক্রম করে খাটো তীব্র ফ্রেম ফিরিস্তির কোনো অংশ বুঝি সত্য মৃত্যু…’
চলমান করোনা মহামারিতে আরও দুই সাবেক মহাপরিচালক আশরাফ সিদ্দিকী ও মনজুরে মওলা মারা যান। স্বাধীনতার পর প্রায় ছয় বছর বাংলা একাডেমির মহাপরিচালকের দায়িত্ব পালন করেছিলেন ড. আশরাফ সিদ্দিকী। তিনি লোকসাহিত্যিক, ঔপন্যাসিক ও শিশুসাহিত্যিক হিসেবে খ্যাতিমান ছিলেন।
কবি মনজুরে মওলা আশির দশকে প্রায় তিন বছর বাংলা একাডেমির মহাপরিচালকের দায়িত্ব পালন করেছিলেন। তাদের নামের সঙ্গে জড়িয়ে আছে অমর একুশে গ্রন্থমেলার ইতিহাস।
এই দেশ বরেণ্য ব্যক্তিরা সাহিত্য-সংস্কৃতি সমাজের লোক হলেও প্রতিষ্ঠান পরিচালনা করেছিলেন নিষ্ঠার সঙ্গে। বাংলা একাডেমি ছিল তাদের ধ্যান-জ্ঞান। অবকাঠামো উন্নয়নের পাশাপাশি নানা বিভাগ ও গবেষণা স্তর বাড়াতে নিষ্ঠা, তদারকি ও মনোযোগ তাদের স্মরণীয় করে রাখবে।
Comments