আর্কাইভ থেকে

জনগণের স্বার্থে বোট ক্লাব? কোনোভাবেই নয়!

তুরাগ নদী সীমানার ভেতরে স্থাপিত ঢাকা বোট ক্লাবের ছবিটি গত সপ্তাহে তোলা হয়েছে | স্টার

সম্প্রতি নায়িকা পরীমনি তার বিরুদ্ধে ধর্ষণ ও হত্যা চেষ্টার অভিযোগ আনার পর আলোচনায় আসা ঢাকা বোট ক্লাব লিমিটেডের অবস্থানই এখন প্রশ্নবিদ্ধ।

ক্লাবটি বন্যা প্রবাহ অঞ্চল ও তুরাগ নদ সীমানার ভেতরে স্থাপন করা হয়েছে। কিন্তু, তবুও কেউ এটিকে অবৈধ বলতে পারবে না। প্রকৃতপক্ষে ক্লাবটির রয়েছে সব ধরনের অনুমতি, যার মাধ্যমে এটি একটি বৈধ স্থাপনা হিসেবে পরিচালিত হতে পারে।

তুরাগ নদের দখলকৃত জমির ওপর অবৈধভাবে নির্মিত অন্য যেকোনো স্থাপনা থেকে দৃশ্যত এটি আলাদা নয়। সুতরাং, কেউ ভাবতে পারেন যে কীভাবে এই জমিতে ক্লাবটি তৈরি করার অনুমতি দেওয়া হলো।

কর্তৃপক্ষ 'জনগণের স্বার্থ'র অজুহাত দিয়ে যেকোনো আইন বা নিয়মকে বদলে ফেলতে পারে এবং সেক্ষেত্রে অবৈধ কার্যক্রমও বৈধ হয়ে যায়। কিন্তু, দৃশ্যত এই ক্লাবটির সঙ্গে জনগণের স্বার্থ কোনোভাবেই সম্পৃক্ত নয়। কিছু প্রভাবশালী মানুষের বিনোদনের উদ্দেশ্যেই ক্লাবটি প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে।

ক্লাবটির নয় জন নির্বাহী সদস্যের একজন নিজামুল হক ভূঁইয়া দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, 'আমরা সংশ্লিষ্ট সব কর্তৃপক্ষের কাছ থেকে অনুমতি নিয়েছি।' তিনি আরও বলেন, 'আমরা ক্লাবটির জন্যে প্রায় ১৭টি সরকারি বিভাগের কাছ থেকে ছাড়পত্র নিয়েছি।'

বোট ক্লাব ভবনটি নদীর সীমানা পিলারকে ছাড়িয়ে যায়নি বলে দাবি করেছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক সমিতির সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্বে থাকা নিজামুল হক ভূঁইয়া।

বিরুলিয়া অঞ্চলে তুরাগ নদীর তীরে ক্লাবটির ৬০ বিঘা জমি রয়েছে। নিজামুল জানান, এই জমির মধ্যে ৩০ বিঘা তারা বাংলাদেশ পানি উন্নয়ন বোর্ডের (পাউবো) কাছ থেকে ইজারা নিয়েছেন এবং বাকিটা তারা স্থানীয়দের কাছ থেকে কিনে নিয়েছেন।

সম্প্রতি সরেজমিনে গিয়ে দেখা যায়, ভবনটির পেছনের দেয়ালটি নদীর সীমানা পিলারগুলো থেকে মাত্র কয়েক ইঞ্চি দূরে বসানো হয়েছে।

ডেইলি স্টার আরও জানতে পেরেছে, ক্লাবের কমপাউন্ড তৈরি করা হয়েছে ঢাকা বন্যা প্রতিরক্ষা বাঁধের পাশে অবস্থিত বন্যা প্রবাহ অঞ্চলকে ভরাট করে।

রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (রাজউক) বিশদ অঞ্চল পরিকল্পনা (ড্যাপ) কমিটি 'বিশেষ বিবেচনায়' ২০১৮ সালে এই জমিটিকে বন্যা প্রবাহ অঞ্চল থেকে বাদ রাখার সুপারিশ করে।

গৃহায়ন ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয়ের অধীনস্থ সংস্থা রাজউকের পরিকল্পনা ও নিয়ন্ত্রণ বিভাগের এক কর্মকর্তার মতে, কমিটি এ সংক্রান্ত একটি প্রজ্ঞাপনও দিয়েছিল।

২০১৯ সালে চূড়ান্ত অনুমোদন দেওয়া হয় উল্লেখ করে নিজামুল হক বলেন, 'তারা পর্যায়ক্রমে অনুমতি দিয়েছে। অনুমোদনের প্রক্রিয়া এরকমই।'

ভবনটি গত বছর নির্মাণ করা হয় এবং এ বছরের ফেব্রুয়ারিতে উদ্বোধন করা হয়।

নাম প্রকাশ না করার শর্তে এক কর্মকর্তা জানান, ক্লাবের ব্যবস্থাপনা পরিষদ বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ নৌপরিবহন কর্তৃপক্ষের (বিআইডব্লিউটিএ) সঙ্গেও এক ধরনের সমঝোতায় পৌঁছেছে। কারণ, এটি একেবারে নদীর সীমানা সংলগ্নে নির্মাণ করা হয়েছিল।

আইনজীবী ও পরিবেশবাদীদের মতে, নদীর সীমানায় কোনো ধরনের স্থাপনা নির্মাণ করা আইনের সুস্পষ্ট লঙ্ঘন।

বাংলাদেশ পানি আইন-২০১৩ অনুযায়ী, নদীর সীমানা হচ্ছে 'নদীর পানির সর্বোচ্চ উচ্চতা থেকে নদীর তীরবর্তী ভূমির যে অংশটি ৫০ মিটার দূর পর্যন্ত বিস্তৃত।'

২০০৯ সালে উচ্চ আদালত সরকারকে আদেশ দেয় ঢাকার চারটি নদীর (বুড়িগঙ্গা, তুরাগ, বালু ও শীতলক্ষ্যা) মূল সীমানা নির্ধারণ করতে এবং ক্যাডাস্ট্রাল সার্ভে (সিএস) ম্যাপ অনুযায়ী নদীগুলোকে তাদের আগের অবস্থায় ফিরিয়ে নিতে।

বাংলাদেশ পরিবেশ আইনবিদ সমিতির (বেলা) প্রধান নির্বাহী সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান বলেন, 'নদীর এত কাছাকাছি জায়গায় এবং এর সঙ্গে সংযুক্ত নিম্ন-ভূমিকে ভরাট করে বোট ক্লাবের মতো যেকোনো স্থাপনা তৈরি করা উন্মুক্ত স্থান আইন ২০০০, পানি আইন ২০১৩, নগর উন্নয়ন আইন ১৯৭৩ ও ঢাকা মাস্টার প্ল্যান ১৯৯৫ আইনগুলোকে লঙ্ঘন করে।'

খেলার মাঠ, উন্মুক্ত স্থান, উদ্যান ও প্রাকৃতিক জলাধার সংরক্ষণ আইন, ২০০০ এর ছয় নম্বর ধারায় বলা হয়েছে, সরকার চাইলে বন্যা প্রবাহ অঞ্চলে নির্মাণকাজের অনুমতি দিতে পারে, যদি তা কোনোভাবে ঢাকা মাস্টার প্ল্যানকে বিঘ্নিত না করে।

বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব প্ল্যানার্সের মহাসচিব আদিল মোহাম্মদ খান ডেইলি স্টারকে বলেন, 'যে অঞ্চলে বোট ক্লাব নির্মাণ করা হয়েছে, সেটি সংরক্ষিত বন্যা প্রবাহ অঞ্চল হিসেবে ঢাকা মাস্টার প্ল্যানে অন্তর্ভুক্ত ছিল।'

বোট ক্লাবকে অনুমতি দেওয়ার প্রক্রিয়া সম্পর্কে তিনি বলেন, 'সাধারণত পেশাদার পরিকল্পনাবিদদেরকে এ ধরনের কমিটিতে অন্তর্ভুক্ত করা হয় না। এ কারণে কমিটিগুলো সাধারণত রাজনৈতিক প্রভাবের ভিত্তিতে সিদ্ধান্ত নেয়।'

এ ছাড়াও, পাউবোর ৩০ বিঘা জমি নিয়েও প্রশ্ন তোলা যেতে পারে। কারণ, বাংলাদেশ পানি উন্নয়ন বোর্ড আইন ২০০০ অনুযায়ী সংস্থাটি শুধুমাত্র তখনই জমি ইজারা দিতে পারে, যখন বিষয়টির সঙ্গে জনগণের স্বার্থ জড়িত থাকে।

ইজারা সম্পর্কে জানতে চাইলে পাউবোর মহাপরিচালক এ কে এম ওয়াহেদ উদ্দিন চৌধুরী প্রথমে বলেন, 'কোনো মন্তব্য করার আগে আমাকে কাগজপত্র পরীক্ষা করতে হবে।'

পরবর্তীতে তিনি এ বিষয়ে কথা বলার জন্য একজন অতিরিক্ত প্রধান প্রকৌশলীর সঙ্গে যোগাযোগ করার উপদেশ দেন। কিন্তু, উল্লিখিত প্রকৌশলীকে বারবার ফোন করা হলেও তিনি ফোন ধরেননি।

বিআইডব্লিউটিএর চেয়ারম্যান কমোডোর গোলাম সাদেক ব্যস্ততার কারণে ফোনে কথা বলতে পারেননি। তিনি ডেইলি স্টারের প্রতিবেদককে বলেন তাকে মেসেজ পাঠাতে। সে অনুযায়ী তাকে বোট ক্লাব সংক্রান্ত একটি মেসেজ পাঠানো হয়। কিন্তু, তিনি সেটির কোনো উত্তর দেননি।

ঢাকা বোট ক্লাব যখন অনুমোদন পায়, তখন ড্যাপের মূল্যায়ন কমিটির সভাপতি ছিলেন সাবেক স্থানীয় সরকার, পল্লি উন্নয়ন ও সমবায় (এলজিআরডি) মন্ত্রী খন্দকার মোশাররফ হোসেন। এ বিষয়ে তার সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি প্রথমে জানান, তিনি দায়িত্বে থাকাকালে ঢাকা বোট ক্লাবের অনুমোদন দেওয়া হয়েছিল কি না, সেটি তার মনে নেই।

বর্তমানে ফরিদপুর-৩ আসন থেকে নির্বাচিত সংসদ সদস্য মোশাররফ হোসেন ২০১৫ সালের জুলাই থেকে ২০১৯ সালের জানুয়ারি পর্যন্ত এলজিআরডি মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বে ছিলেন। তিনি বলেন, 'আমার মনে হয় না আমার মেয়াদ চলাকালে বোট ক্লাব অনুমোদন পেয়েছিল। হয়তো ক্লাবটিকে আমার মেয়াদের আগে বা পরে অনুমোদন দেওয়া হয়েছিল।'

তিনি আবারও বলেন, 'ক্লাবটি সম্ভবত মন্ত্রণালয়ের পরিবর্তে স্থানীয় কর্তৃপক্ষের কাছ থেকে অনুমোদন নিয়েছিল।'

২০১৯ সালের জানুয়ারি থেকে ২০২০ সালের ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত গৃহায়ন ও গণপূর্ত মন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করেন এস এম রেজাউল করিম। তিনি বলেন, 'ড্যাপের মূল্যায়ন কমিটি যখন বোট ক্লাবের অনুমোদন দেয়, তখন আমি সংসদ সদস্যই ছিলাম না। মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বে থাকার তো প্রশ্নই ওঠে না।'

তবে, তিনি জানিয়েছেন, তিনিও ক্লাবটির একজন সদস্য।

কার স্বার্থে এই স্থাপনা নির্মাণ?

রাজউকের সদস্য (উন্নয়ন ও নিয়ন্ত্রণ) মো. শফি উল হকের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি জানান, ড্যাপের বিশেষ কমিটি ভূমি ব্যবহারের পরিকল্পনা পরিবর্তন করে সেটিকে বন্যা প্রবাহ অঞ্চল থেকে প্রাতিষ্ঠানিক প্লটে রূপান্তর করেছিল।

কোন যুক্তিতে বোট ক্লাবকে বন্যা প্রবাহ অঞ্চলের ওপর দালান নির্মাণের অনুমতি দেওয়া হয়েছিল, সে বিষয়ে জানতে চাইলে রাজউকের ড্যাপের প্রকল্প পরিচালক মো. আশরাফুল ইসলাম জানান, মন্ত্রিসভার ড্যাপ সংক্রান্ত পরিষদ এই অনুমতি দিয়েছিল। তিনি বলেন, 'এটি চার বছর আগের ঘটনা। খুব সম্ভবত একটি বিনোদনকেন্দ্র নির্মাণ করার জন্য অনুমতি দেওয়া হয়েছিল।'

সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান বলেন, 'সরকার চাইলে যে কাউকে এরকম একটি ভূমির ওপর জনগণের স্বার্থ রক্ষা করার জন্য স্থাপনা নির্মাণ করার অনুমতি দিতে পারে। কিন্তু, একটি সামাজিক ক্লাব নির্মাণের কাজ কখনো জনগণের স্বার্থে করা হয় না। কারণ, এটি শুধুমাত্র তার সদস্যদের স্বার্থ রক্ষা করে।'

ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের (টিআইবি) নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান বলেন, 'বোট ক্লাব কোনো দিক দিয়েই জনগণের স্বার্থের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট নয়।'

'এটি অল্প কিছু মানুষের জন্য বিনোদনের কেন্দ্র। সরকারের উচিত ছিল বন্যা প্রবাহ অঞ্চলটিকে সুরক্ষা দেওয়া', বলেন তিনি।

বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলনের (বাপা) কেন্দ্রীয় কমিটির সাধারণ সম্পাদক শরীফ জামিল বলেন, 'এটি দুর্ভাগ্যজনক যে সে মানুষগুলোই নদী আর বন্যা প্রবাহ অঞ্চলকে ভরাট করে বোট ক্লাবটি তৈরি করেছেন, যাদের দায়িত্ব ছিল নদীগুলোর সুরক্ষার ব্যবস্থা করা।'

তিনি বলেন, 'একই কারণে বিআইডব্লিউটিএর কর্মকর্তারাও পিলারের মাধ্যমে বেআইনিভাবে সীমানা নির্ধারণের কাজের স্বপক্ষে যুক্তি দিতে দ্বিধা বোধ করেন না।'

নিজামুল হক ভূঁইয়ার মতে, বর্তমান মন্ত্রিসভার অন্তত একজন মন্ত্রী ও একজন সাবেক মন্ত্রী এই ক্লাবটির সদস্য।

এক হাজার ৮০০ সদস্য বিশিষ্ট এই ক্লাবের সভাপতি পুলিশের মহাপরিদর্শক বেনজির আহমেদ। সদস্যদের অনেকেই সরকারের উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা, ব্যবসায়ী, বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ও বিচারক হিসেবে কর্মরত আছেন।

ক্লাবটির ১১ সদস্যের নির্বাহী কমিটিতে রয়েছেন একজন সভাপতি, একজন উপদেষ্টা ও নয় জন নির্বাহী সদস্য।

ওয়েবসাইটে ক্লাব সভাপতির এক বার্তায় বলা হয়েছে, ডিবিসি মূলত একটি নৌকা চালানোর ক্লাব, যা এর নাম থেকেই বোঝা যায়।

তবে, পানির সঙ্গে সংশ্লিষ্ট ক্রীড়ার পাশাপাশি এখানে অন্যান্য খেলাধুলার ব্যবস্থাও থাকবে। যেমন: মাছ ধরা, টেনিস, স্কোয়াশ, বিলিয়ার্ডস ও আরও অনেক কিছু। বার্তায় আরও বলা হয়েছে, ক্লাবটি চাচ্ছে 'কিছু সুনির্দিষ্ট পরিবারের সদস্যদের জন্য মরুভূমির মাঝে প্রশান্তিমূলক মরূদ্যান হিসেবে কাজ করতে, যেখানে তারা এসে অবকাশ যাপন করতে পারবেন এবং একই ধরনের মন-মানসিকতার মানুষদের সঙ্গে পরিচিত হতে পারবেন।'

বার্তায় আরও বলা হয়েছে, 'এটি তুরাগ নদীর বিশুদ্ধ ও স্নিগ্ধ তীরে অবস্থিত এমন একটি ক্লাব, যেখানে শান্তিপূর্ণ ও প্রাকৃতিক পরিবেশের ছোঁয়ায় বিলাসবহুল জীবনকে আস্বাদন করা যায় এবং তা ঢাকা শহরে থেকেই।'

সাভার থানায় পরীমনি একটি মামলা দায়ের করার পর পুলিশ গত ১৪ জুন বোট ক্লাবের সদস্য নাসির ইউ মাহমুদ ও ব্যবসায়ী তুহিন সিদ্দিক অমিসহ পাঁচ জনকে গ্রেপ্তার করে।

একটি সংবাদ সম্মেলনে চলচ্চিত্র অভিনেত্রী পরীমনি অভিযোগ করেন, গত ৯ জুন রাত ১২টার দিকে বোট ক্লাবে নাসির ও অমি তাকে ধর্ষণের চেষ্টা করেন।

ইংরেজি থেকে অনুবাদ করেছেন মোহাম্মদ ইশতিয়াক খান

Comments

The Daily Star  | English

JP central office vandalised, set ablaze

A group of unidentified people set fire to the central office of Jatiyo Party in Dhaka's Kakrail area this evening

1h ago