ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণে সিটি করপোরেশনের কার্যক্রম ‘কার্যকর নয়’
চলতি বছরের ৩১ মে পর্যন্ত দেশে ৩৫২ জন ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়েছেন। ২০১৯ সালে সবচেয়ে বেশি ১ লাখ ১ হাজার ৩৫৪ ডেঙ্গু রোগী শনাক্ত হয়েছিল। সেবছর জানুয়ারি থেকে মে পর্যন্ত প্রথম ৫ মাসে ৩২৪ জন রোগী ছিল। গত বছর দেশে ২৮ হাজার ৪২৯ জন রোগী শনাক্ত হয়। যার মধ্যে প্রথম ৫ মাসে রোগী ছিল মাত্র ১০০ জন। ২০১৯ ও ২০২১ সালের প্রথম ৫ মাসের তুলনায় চলতি বছর রোগীর সংখ্যা বেশি।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের তথ্যমতে, এবছর মৌসুমপূর্ব জরিপে প্লাস্টিক ড্রামে ২৩ দশমিক ৯৮ শতাংশ এডিস মশার লার্ভা পাওয়া গেছে। ২০১৯ সালে এই হার ছিল ১১ দশমিক ৪৩ শতাংশ। ২০১৯ সালে জলমগ্ন ফ্লোরে লার্ভা ছিল ২০ শতাংশ, এবছর সেটি ২৩ দশমিক ৬৪ শতাংশ।
অন্যান্য বছরের তথ্য বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, সাধারণত জুন থেকে অক্টোবর হচ্ছে ডেঙ্গুর মৌসুম। আর ডেঙ্গু রোগী বেশি থাকে আগস্ট ও নভেম্বরে এবং অক্টোবরের পর তা কমতে থাকে। এবছর জানুয়ারি থেকেই ডেঙ্গু রোগী দেখা যাচ্ছে। ডেঙ্গু ভাইরাসের বাহক এডিস মশা নিয়ন্ত্রণে সিটি করপোরেশনের করণীয় কী এবং তারা তা করছে কি না, তা জানতে দ্য ডেইলি স্টার টেলিফোনে কথা বলেছে কীটতত্ত্ববিদ তৌহিদ উদ্দিন আহমেদ, ড. মঞ্জুর আহমেদ চৌধুরী, অধ্যাপক কবিরুল বাশার ও ড. জিএম সাইফুর রহমানের সঙ্গে।
তারা প্রত্যেকেই বলেছেন, এডিস মশা নিয়ন্ত্রণ বছরব্যাপী কার্যক্রম পরিচালনা করতে হবে। কিন্তু আমাদের এখানে শুধু মৌসুমভিত্তিক কার্যক্রম পরিচালিত হয়। সারাবছর কাজ না করার কারণে এডিস মশার প্রকোপ বাড়ছে। ফলে বাড়ছে ডেঙ্গু রোগীও।
বিশেষজ্ঞদের অভিযোগ, এডিস মশা নিধন করে ডেঙ্গুর প্রকোপ কমিয়ে আনতে তারা সিটি করপোরেশনকে যে পরামর্শ দেয়, তা অনেকটাই উলুবনে মুক্তা ছড়ানোর মতো। তাদের কথা শোনা হয় না। সিটি করপোরেশন যে পদ্ধতিতে কাজ করছে, তা কার্যকর নয়। তবে সিটি করপোরেশন বলছে, তারা কার্যকরভাবেই সারাবছর এডিস মশা নিধনে কাজ করছে।
কীটতত্ত্ববিদ তৌহিদ উদ্দিন আহমেদ বলেন, 'সিটি করপোরেশন গতানুগতিক কাজ করছে। এডিস মশা নিয়ন্ত্রণে বিশেষ কোনো ব্যবস্থা আমি দেখছি না। ঢাকায় অনেক নির্মাণাধীন ভবন আছে। এসব জায়গায় এডিস মশার লার্ভা বেশি থাকে। সিটি করপোরেশন এসব জায়গায় যায়, জরিমানা করে। শুধু জরিমানা করলেই হবে না। লোকজনকে যতদিন না সচেতন করা যায়, ততদিন কাজ হবে না। জরিমানা করে কোনোভাবেই ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণ সম্ভব না। সিটি করপোরেশনের নিজস্ব কোনো জরিপ ব্যবস্থা নেই। তারা মূলত স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের জরিপেরই ওপর নির্ভর করেই কার্যক্রম পরিচালনা করে। যে জরিপ করা হয়, সেখানে কোনো বৈজ্ঞানিক পদ্ধতি অনুসরণ করা হয় না। তাই এডিস মশার সঠিক চিত্রও পাওয়া যায় না।'
তৌহিদ উদ্দিন আহমেদের ভাষ্য, 'মশা মারার জন্য যেসব ওষুধ কেনা হয়, সেগুলো কার্যকর কি না এবং সেগুলো ঠিকমতো প্রয়োগ করা হচ্ছে কি না, তা তদারকি করা হচ্ছে না। সিটি করপোরেশনের অধীনে নতুন কিছু ওয়ার্ড যুক্ত হয়েছে, যেগুলোর অবস্থা আরও খারাপ। উপযুক্ত লোক দিয়ে যতক্ষণ পর্যন্ত না ভালো জরিপ করা হয়, ততক্ষণ পর্যন্ত ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব বলে মনে হয় না।'
ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণে জনগণকে সচেতন ও সম্পৃক্ত করার পরামর্শ দিয়ে তিনি বলেন, 'ষষ্ঠ থেকে অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত স্কুল শিক্ষার্থীদের ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণে প্রশিক্ষণ দিতে পারলে তারা এই কাজটি সহজেই করতে পারে। ঢাকায় বিভিন্ন সোসাইটি আছে। এই সোসাইটিগুলোকে কাজে লাগাতে হবে। তাদেরকে প্রয়োজনীয় সহযোগিতা করতে হবে।'
তিনি বলেন, 'এডিস মশা নিধন করে ডেঙ্গুর প্রকোপ কমাতে আমরা বিভিন্ন সময়ে পরামর্শ দেই। অনেক কথা বলি। কিন্তু সেগুলো অনেকটাই উলুবনে মুক্তা ছড়ানোর মতো। আমাদের কথা তারা তেমন শুনে না। তা ছাড়া অপরিকল্পিত নগরায়ন ও জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে এডিস মশা বাড়ছে। ফলে ডেঙ্গু রোগীও বাড়ছে।'
পরিস্থিতি খারাপের দিকে যাচ্ছে উল্লেখ করে কীটতত্ত্ববিদ ড. মঞ্জুর আহমেদ চৌধুরী বলেন, 'যেখানে রোগী পাওয়া যাচ্ছে, সেখানে ক্লাস্টার ধ্বংস করতে হবে। ভাইরাস যেখানে পাওয়া যাবে, সেখানে লার্ভি সাইট প্রয়োগ করে মশা মারতে হবে। তবেই ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণে আনা সম্ভব। কিন্তু আমাদের সিটি করপোরেশনের দায়িত্বে যারা আছেন, তারা এসব বিষয় বোঝে না। সিটি করপোরেশনের যে অভিযান, সেগুলোর কোনো মানে হয় না। এগুলো মানসম্মত কোনো পদ্ধতি না। সবচেয়ে জরুরি ভালোভাবে জরিপ করা এবং সে অনুযায়ী ব্যবস্থা নেওয়া। কিন্তু আমরা এসব করতে দেখি না। সারাবছর এডিস মশা নিয়ন্ত্রণে কাজ করতে হবে। সিটি করপোরেশন তা করে না।'
কীটতত্ত্ববিদ অধ্যাপক কবিরুল বাশার বলেন, 'গত ২ বছরের তুলনায় এ বছর এডিস মশার লার্ভার ঘনত্ব বেশি পাওয়া গেছে। বিষয়টি সিটি করপোরেশনকে জানালেও তেমন একটা ব্যবস্থা নিতে দেখা যায়নি। এডিস মশা নিয়ন্ত্রণে সারাবছর কাজ করতে হবে। কিউলেক্স ও এডিস মশা নিয়ন্ত্রণে আলাদাভাবে অভিযান চালাতে হবে। কিন্তু সিটি করপোরেশন এই কাজগুলো সারাবছর করে না।'
জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণিবিদ্যা বিভাগের ফ্যাকাল্টি ড. জিএম সাইফুর রহমান বলেন, 'গতবার মশা নিয়ন্ত্রণ প্রক্রিয়া কার্যকর না হওয়ায় এ বছর এডিস মশার পরিমাণ বেড়ে গেছে। রোগী কমে যাওয়ায় এই বিষয়টিকে গুরুত্ব দেওয়া হয়নি।'
তিনি বলেন, 'সিটি করপোরেশন বারবার জনগণকে সচেতন হওয়ার কথা বলছে। জনগণেরও আগ্রহ আছে। কিন্তু তাদের হাতে কোনোরকম উপায় উপকরণ না দিয়ে জনসম্পৃক্ততার কথা বলে মাঠ দাপিয়ে জনগণের ঘাড়ে দোষ চাপালে স্বাস্থ্য ব্যবস্থায় উন্নতি হবে না। অন্যদিকে কার্যকরী ও যুগোপযোগী কীটনাশকের কথা বিশেষজ্ঞরা বারবার বললেও কেউ তা আমলে নিচ্ছে না।'
এডিস মশা নিয়ন্ত্রণে কার্যকর উদ্যোগ নেওয়া হচ্ছে না উল্লেখ করে তিনি আরও বলেন, 'উড়ার গতি কম হওয়ার কারণে এডিস মশা ৫০- ১৫০ মিটারের মধ্যেই বিচরণ করে থাকে। এডিস মশার পরিমাণ বাড়লে ১০-১৪ দিনের ব্যবধানে সেই এলাকায় রোগী বেড়ে যায়। এই অবস্থানকে অ্যাক্টিভ ক্লাস্টার বলে। এই অ্যাক্টিভ ক্লাস্টার দ্রুত নিয়ন্ত্রণে আনতে পারলে ডেঙ্গুর প্রাদুর্ভাব নিয়ন্ত্রণ করা যাবে। এডিস মশার ক্লাস্টার বিষয়ে সিটি করপোরেশনের কাছে হালনাগাদ তথ্য থাকতে হবে। গত ২ বছর বিশেষজ্ঞরা এসব কথা বলে যাচ্ছে। কিন্তু দায়িত্ববানরা তা শুনছেন না। কোনোভাবেই এই ক্লাস্টার পদ্ধতির আইডিয়াটা তাদের মাথায় ঢোকানো যাচ্ছে না।'
এই কীটতত্ত্ববিদ বলেন, 'ডেঙ্গু বিস্তারের ক্ষেত্রে অন্য আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো ভাইরাসের স্ট্রেনের ধরন। ভাইরাসের ৪টি স্ট্রেনের কোনো এক স্ট্রেন দিয়ে একবার কেউ আক্রান্ত হলে তার জীবদ্দশায় ওই স্ট্রেন দিয়ে আর আক্রান্ত হওয়ার সম্ভাবনা থাকে না। কিন্তু নতুন স্ট্রেনের আসলে আবারও আক্রান্ত হওয়ার সম্ভাবনা থাকে। সেজন্য অ্যাক্টিভ ক্লাস্টার এলাকার মশা ধরে এবং সম্ভাব্য রোগীদের নমুনা নিয়ে মাঝেমধ্যে পরীক্ষা করে বিষয়টা নিশ্চিত হওয়া জরুরি। নতুন স্ট্রেন শনাক্ত হলে বাড়তি সতর্কতা প্রয়োজন। সেই এলাকার অধিবাসীদের সতর্ক করার পাশাপাশি মশা নিধন কর্মসূচিও জোরদার করতে হবে। তবে সিটি করপোরেশন এই কথাগুলোর গুরুত্ব দিচ্ছে না।'
'এডিস মশা নিয়ন্ত্রণে যেমন লোক দরকার, সিটি করপোরেশনের তেমন দক্ষ লোক নেই। তা ছাড়া কার্যকর পদ্ধতিতে এডিস মশা নিয়ন্ত্রণ করা হচ্ছে না। সঠিক ক্লাস্টার বের করা প্রয়োজন। লোক না থাকার কারণে সিটি করপোরেশন তা করতে পারছে না। তাই ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণে আসছে না', যোগ করেন তিনি।
ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের প্রধান স্বাস্থ্য কর্মকর্তা ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মো. জোবায়দুর রহমান ডেইলি স্টারকে বলেন, 'এডিস মশা নিয়ন্ত্রণে ১০ দিনের অভিযানে যেসব জায়গায় লার্ভা পাওয়া গেছে তা ধ্বংস করা হয়েছে। কয়েকজনের বিরুদ্ধে জরিমানা ও মামলা করা হয়েছে। মানুষকে সচেতন করা হয়েছে। সামনে এসব কাজ আরও করা হবে। সাধারণ নাগরিক, মসজিদের ইমাম, স্কুলের শিক্ষকদের সঙ্গে আমরা কাজ করছি। সামনে আমরা রোড শো করবো, আবারও অভিযান পরিচালনা করবো। এখন পর্যন্ত আমাদের উদ্বেগের জায়গা হলো নির্মাণাধীন ভবনগুলো। যেখানে লার্ভা পাওয়া গেছে তাদের নামে মামলা দিয়ে এবং জরিমানা করে ডেঙ্গু অনেকটা আয়ত্তে আনা গেছে। এখন পর্যন্ত উদ্বেগজনক অবস্থায় নেই আমরা। যদি বাড়তে দেওয়া না যায়, তাহলে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে থাকবে বলে আশা করছি।'
তিনি বলেন, 'আমাদের কর্মীরা সারাবছর কাজ করছে। এডিস ও কিউলেক্স মশার জন্য আলাদা কর্মীর দরকার নেই। একই কর্মীরা সারাবছর মশা নিয়ন্ত্রণে কাজ করছে। নভেম্বর থেকে মার্চ-এপ্রিল পর্যন্ত কিউলেক্স মশা এবং এপ্রিল থেকে অক্টোবর পর্যন্ত এডিস মশার বিরুদ্ধে কাজ করছে। কাজ কিন্তু প্রতিদিন হচ্ছে।'
ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা (অতিরিক্ত সচিব) ফরিদ আহাম্মদ ডেইলি স্টারকে বলেন, 'আমাদের রুটিন কার্যক্রম অব্যাহত আছে। প্রতি ওয়ার্ডে ১৩ জন করে দৈনিক ১ হাজার ৫০ জন কাজ করছেন। সকালে লার্ভি সাইট প্রয়োগ করা হয় এবং বিকেলে ফগিং করা হয়। ১৫ জুন থেকে ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনা করা হবে।'
তিনি বলেন, 'স্বাস্থ্য অধিদপ্তর সাধারণত বছরে ৩ বার জরিপ করে থাকে। কিন্তু আমাদের সারাবছর কাজ চলমান থাকে। আমাদের নতুন যে ১৮টি ওয়ার্ড, এ বছর কিন্তু স্বাস্থ্য অধিদপ্তর সেখানে জরিপ করেনি। আমরা নিজেরাই নতুন এসব ওয়ার্ডে জরিপ করেছি। আমাদের কীটতত্ত্ববিদ আছে। আমরা প্রতি ১৫ দিন পরপর নমুনা নিয়ে তা পরীক্ষা করছি। ফলাফলের ওপর আমরা সিদ্ধান্ত নেই। ১৫ দিন পর পর আমাদের আলোচনা সভা হয়।'
পরিকল্পনা অনুযায়ী সবার পরামর্শ নিয়ে সারাবছর কাজ হচ্ছে উল্লেখ করে তিনি বলেন, 'এডিস মশার ডিম এক বছর পর্যন্ত থাকে। সেসব বিষয় মাথায় নিয়েই আমরা কাজ করছি। ডেঙ্গু যাতে নিয়ন্ত্রণে থাকে, সে অনুযায়ী কাজ হচ্ছে। শতভাগ সূচি নিয়ে কাজ করলেও ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণে সিটি করপোরেশন শুধু ২৫ শতাংশ অবদান রাখতে পারে। বাকি ৭৫ শতাংশ অবদান রাখতে হবে অন্যান্য বিভাগ ও জনগণকে। জনগণকে সচেতন করার জন্য যা করা দরকার, আমরা তাই করছি। অন্যান্য বিভাগ, মসজিদের ইমাম, স্কুল-কলেজের শিক্ষকসহ সবার সঙ্গে কথা বলছি। সবাইকে সচেতন করার চেষ্টা করছি।'
আপনারা বলছেন যে সব ধরনের উদ্যোগ নিচ্ছেন, কিন্তু ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণে আসছে না কেন, জানতে চাইলে তিনি বলেন, 'আমাদের বিভিন্ন কার্যক্রমের কারণে কিন্তু ডেঙ্গু সহনীয় পর্যায়ে আছে। তা নাহলে আরও খারাপ অবস্থার দিকে যেত। জনগণ যদি শতভাগ সচেতন হয়, তবেই ডেঙ্গু অনেক কমিয়ে আনা সম্ভব হবে। অন্যথায় সম্ভব না। আমাদের কর্মীরা তো আর বাড়ির ভেতরে যায় না। এসব জায়গায় এডিস মশার লার্ভা থাকে। কাজেই মানুষের সচেতনতা সবচেয়ে জরুরি। আমরা সর্বাত্মক চেষ্টা করছি।'
Comments