‘ড্রোন দিয়ে এডিস মশা খোঁজা উচ্চাভিলাষী, অকার্যকর, শুধু অর্থের অপচয়’

ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশন (ডিএনসিসি) এডিস মশার উৎস খুঁজতে ড্রোনের মাধ্যমে আগামীকাল শনিবার থেকে ১০ দিনব্যাপী চিরুনি অভিযান চালাবে। এই কাজে ব্যবহৃত হবে ৫টি ড্রোন। চিরুনি অভিযানের পরেও ড্রোনের ব্যবহার চলমান থাকবে।

এডিস মশার উৎস খুঁজতে ড্রোনের ব্যবহার বিষয়ে কীটতত্ত্ববিদরা বলছেন, এটি একটি উচ্চাভিলাষী এবং অকার্যকর উদ্যোগ। সঠিক জরিপ করে সক্রিয় ক্লাস্টার ধ্বংস করতে না পারলে এডিস মশা বাড়বে, সঙ্গে ডেঙ্গু রোগীও বাড়তে থাকবে।

তবে সিটি করপোরেশন বলছে, ড্রোনের মাধ্যমে যেসব ছাদে পানি পাওয়া যাবে সেখানে তাদের কর্মীরা গিয়ে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেবে যা এডিস মশার লার্ভা নিধনে সহায়তা করবে।

ড্রোন ব্যবহার বিষয়ে কীটতত্ত্ববিদ অধ্যাপক কবিরুল বাশার দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, 'ড্রোন ব্যবহার একটি ভালো উদ্যোগ। তবে এটি এডিস মশার প্রজননস্থল শনাক্তকরণের চেয়ে কিউলেক্স মশা শনাক্তকরণে বেশি কার্যকর। কাজেই এখন এডিস মশার প্রজনন স্থল শনাক্ত করে তা ধ্বংস করার উদ্যোগগুলো নেওয়া বেশি জরুরি বলে আমি মনে করি।'

জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণিবিদ্যা বিভাগের ফ্যাকাল্টি ড. জিএম সাইফুর রহমান দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, 'ড্রোন দিয়ে এডিস মশা শনাক্ত আদৌ কোনো কার্যকর উদ্যোগ না। এটি টাকার অপচয় ছাড়া আর কিছু না। ১ মিলিলিটার পানির মধ্যেও লার্ভা জন্মায়, ১ ইঞ্চি পাত্রের মধ্যেও লার্ভা জন্মায়। ড্রোনের সাহায্যে সেগুলো খুঁজে বের করা সহজ না। আর এখন তো এসব কাজ করার সময় না। যেসব এলাকায় রোগী বেশি তা খুঁজে বের করে সেসব এলাকায় চিরুনি অভিযান চালিয়ে অ্যাডাল্ট মশা মেরে ফেলতে হবে।'

তিনি বলেন, 'কোথায় ডেঙ্গু রোগী বেশি আছে আমাদের সিটি করপোরেশনের কাছে এমন জরিপ নেই। এটি না করতে পারলে রোগী আরও বাড়েতে থাকবে। সক্রিয় ক্লাস্টার দ্রুত ধ্বংস করতে হবে। সিটি করপোরেশন যে উদ্যোগ নিয়েছে সেগুলো কার্যকর হচ্ছে কি না তা মনিটরিং করতে হবে। কিন্তু তারা আসলে তেমন কার্যকর কোনো কাজ করছে না।'

কীটতত্ত্ববিদ তৌহিদ উদ্দিন আহমেদ বলেন, 'ড্রোন দিয়ে এডিস মশা বা লার্ভা খোঁজা কোনোভাবেই সম্ভব না। ড্রোন দিয়ে ওপর থেকে পানি দেখা যাবে কিন্তু সেখানে লার্ভা দেখা যাবে কি না, সেটি দেখার বিষয়। ছাদ বাগান এডিস মশার জন্য তেমন একটা সমস্যা না। সমস্যা হলে ভবনের বেসমেন্ট বা নিচের অংশ। সেখানে বিভিন্ন জিনিস পড়ে থাকে। পানির মিটারের গর্তে এডিস মশা হয়। ঢাকায় মূলত নির্মাণাধীন ভবনের এডিস মশার লার্ভা বেশি থাকে। তাছাড়া বিভিন্ন থানায় জব্দ করা বিভিন্ন গাড়িসহ অন্যান্য পড়ে থাকা মালামালে এডিস মশার লার্ভা থাকে সেদিকে নজর দিতে হবে।'

ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণে সার্ভেল্যান্স বা জরিপ অনেক বেশি জরুরি উল্লেখ করে তিনি বলেন, 'আমাদের সিটি করপোরেশনের সবচেয়ে সমস্যা হলো তাদের কোনো সার্ভেল্যান্স নেই। তাদের যদি ভালো জরিপ থাকতো এবং ডেটাবেস থাকতো তাহলে এডিস মশা নিয়ন্ত্রণ করা যেত। কিন্তু সিটি করপোরেশনের নিজস্ব কোনো জরিপ নেই। শুধু স্বাস্থ্য অধিদপ্তর বছরে ৩ বার জরিপ করে। আমি কয়েকবার এই জরিপের সঙ্গে যুক্ত ছিলাম। এই জরিপও একটি ভুল পদ্ধতি। কোথায় রোগী বেশি, মশার সঙ্গে রোগীর সম্পর্ক কী সেটি খুঁজে বের করতে হবে।'

'ড্রোনের ব্যবহার একটি উচ্চাভিলাষী পদ্ধতি। এতে করে শুধু অর্থের অপচয় হবে। তাছাড়া আমাদের দেশে কেনাকাটার বিষয়ে নানা কথা আছে। নমুনার ভিত্তিতে কয়েকটি ছাদ বাগান দেখলেই হবে। এর জন্য কোনো ড্রোন লাগে না,' তিনি যোগ করেন।

ড্রোন ব্যবহারের কারণ জানতে চাইলে ডিএনসিসির প্রধান স্বাস্থ্য কর্মকর্তা ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মো. জোবায়দুর রহমান ডেইলি স্টারকে বলেন, 'বিভিন্ন বাড়ির ছাদ বাগানে যে পানি জমে থাকে সেখানে লার্ভা জন্মায়। বিষয়টি অনেক সময় মালিক খেয়াল করে না। আর আমাদের পক্ষেও সব বাড়ির ছাদে যাওয়া সম্ভব হয় না। তাছাড়া অনেক মালিক ছাদ বাগানে যাওয়ার অনুমতিও দেয় না। ছাদে উঠতে গেলে দেখা যায় অনেক বাড়িতে লিফট নেই। আমাদের কর্মীরাও মানুষ। তারা ৪-৫টা বাড়ির ছাদে ওঠার পর আর উঠতে চাইবে না। তাই ড্রোন প্রযুক্তি নেওয়া হয়েছে। ড্রোন দিয়ে কোনো ছাদ বাগানে পানি দেখা গেলে সেখানে আমাদের কর্মীরা যাবে এবং ব্যবস্থা নেওয়া হবে।'

অনেক আগেই ডেঙ্গু রোগী বাড়তে শুরু করেছে। এতদিন পরে এসে ড্রোনের ব্যবহার কতটা কার্যকর হবে জানতে চাইলে তিনি বলেন, 'আমরা অনেক আগেই বিভিন্ন ব্যবস্থা নিয়েছি। প্রয়োজনীয়তার ভিত্তিতে কৌশল অনুযায়ী আমরা বিভিন্ন ধরনের উদ্যোগ নিচ্ছি। আমি মনে করি না এই পদ্ধতি আরও আগে নেওয়া দরকার ছিল। এডিস মশার লার্ভা খুঁজে বের করে তা ধ্বংস করার জন্য যখন যা প্রয়োজন আমরা সেটা করছি। কিন্তু জনগণ সচেতন না বলেই এডিস মশা নিয়ন্ত্রণে আনা যাচ্ছে না। আগামী ১৫ দিনের মধ্যে ডিএনসিসির আওতাধীন ছাদগুলো ড্রোন দিয়ে নজরদারির আওতায় এনে আমরা ব্যবস্থা নিতে পারবো বলে আশা করছি।'

বিভিন্ন থানায় জব্দ করা গাড়ি ও মালামাল বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, 'এগুলোতে এডিস মশার লার্ভা পাওয়া যাচ্ছে এবং এটি আমাদের উদ্বেগের বিষয়। কিন্তু আসলে তারাও অসহায়। কারণ ডাম্পিংয়ের কোনো ব্যবস্থা নেই। তবে আমাদের কর্মীরা বিভিন্ন থানায় গিয়ে যেখানে পানি জমে সেখানে ওষুধ দিয়ে আসে। তবে এটি কোনো স্থায়ী সমাধান না। এগুলো ডাম্পিং করতে না পারলে এই সমস্যার সমাধান হবে না।'

এ বছর ডিএনসিসি কোন এলাকায় রোগী বেশি এমন কোনো তথ্য আপনাদের কাছে আছে কি না জানতে চাইলে তিনি বলেন, 'এ বছর উত্তরা ও তেজগাঁও এলাকায় লার্ভা বেশি পাওয়া গেছে। আমার সেসব এলাকায় ব্যবস্থা নিয়েছি।'

তবে কোন এলাকায় ডেঙ্গু রোগী বেশি সে বিষয়ে কোনো সুনির্দিষ্ট তথ্য দিতে পারেননি ডিএনসিসির প্রধান স্বাস্থ্য কর্মকর্তা।

ড্রোন দিয়ে বাড়ির ছাদ দেখবেন, কিন্তু বিশেষজ্ঞরা বলছেন, 'ছাদের চেয়ে বাড়ির বেসমেন্ট এবং নির্মাণাধীন ভবনে এডিসের লার্ভা বেশি'—সেগুলো কীভাবে দেখবেন জানতে চাইলে তিনি বলেন, 'আমরা তো আর বসে নেই। আমাদের লোকজন কাজ করছে। তারা পানির মিটারের গর্তসহ যেসব জায়গায় লার্ভা থাকতে পারে সেসব জায়গায় ওষুধ প্রয়োগ করছে।'

উল্লেখ্য কীটতত্ত্ববিদরা এ বছর ডেঙ্গু রোগী বাড়তে পারে বলে আগেই সতর্ক করেছেন। চলতি বছরের ৩০ জুন পর্যন্ত ১ হাজার ৮৯ জন ডেঙ্গু রোগী শনাক্ত হয়েছেন এবং একজন মারা গেছেন।

Comments

The Daily Star  | English
price hike of essential commodities in Bangladesh

Essential commodities: Price spiral hits fixed-income families hard

Supply chain experts and consumer rights activists blame the absence of consistent market monitoring, dwindling supply of winter vegetables, and the end of VAT exemptions granted during Ramadan.

14h ago