পবিত্র আশুরা: শোকের ঐতিহ্য ও সংস্কৃতির মেলবন্ধন

ঢাকায় আশুরার তাজিয়া মিছিল। ছবি: প্রবীর দাশ

'নীল সিয়া আসমান লালে লাল দুনিয়া

আম্মা লাল তেরি খুন কিয়া খুনিয়া

কাঁদে কোন ক্রন্দসী কারবালা ফোরাতে?

সে কাঁদনে আসু আনে সিমারের ও ছোরাতে।

রুদ্র মাতম ওঠে দুনিয়া দামেস্কে –

জয়নালে পরালো এ খুনিয়ারা বেশ কে ?

হায় হায় হোসেনা ওঠে রোল ঝঞ্ঝায়,

তলোয়ার কেঁপে ওঠে এজিদের পাঞ্জায়

উন্ মাদ দুল দুল ছুটে ফেরে মদিনায়

আলীজাদা হোসেনের দেখা হেথা যদি পায়…..।'

কাজী নজরুল ইসলামের তার অমর 'মোহর্‌রম' কবিতায় আশুরার প্রেক্ষাপট বর্ণনা করেছিলেন এভাবেই। নজরুল আশুরার দিন নিয়ে লিখেছিলেন বেশ কয়েকটি কবিতা। বাংলা সাহিত্যে সাহিত্যিক মীর মশাররফ হোসেন আশুরার দিনে কারবালার প্রেক্ষাপট নিয়ে লিখেছেন 'বিষাদ সিন্ধু' নামে গোটা একটি ঐতিহাসিক উপন্যাস। বাংলা সাহিত্যেও কারবালার বিয়োগাত্মক ঘটনা নিয়ে অজস্র কবিতা লেখা হয়েছে।

এ তো গেল সাহিত্য। ১০ই মহররম বা আশুরার দিনটি বাংলার লোক সংস্কৃতিতে এক অনন্য জায়গা দখল করে আছে। ইসলাম ধর্মের সঙ্গে যুক্ত আর কোনো ঘটনা লোক সাংস্কৃতিতে এতটা গুরুত্ব পায়নি। বাংলা সংস্কৃতির সঙ্গেই যেন ওতপ্রোতভাবে মিশে গেছে মহররম।

আশুরায় দিনে ধর্মপ্রাণ মুসলমানরা রোজা রাখেন। শিয়া মতাবলম্বীরা তাজিয়া মিছিল, শোক মাতম, মহররমের পালা, মহররমের জারি, মহররমের শিন্নি আয়োজন করেন। কোথাও কোথাও মহররমের মেলা বসে।

মৌলভীবাজারের কুলাউড়ার পৃথিমপাশা ইউনিয়নে এই মেলার আয়োজন হয়। মানিকগঞ্জের বিভিন্ন এলাকায় আয়োজন হয় 'মহররমের জারি' গান। কারবালার প্রান্তরে ইমাম হোসেন কীভাবে শহীদ হয়েছিলেন তা গানের মাধ্যমে বর্ণনা করা হয়। মানিকগঞ্জের গড়পাড়া ইমামবাড়ীও মহররম এবং আশুরা পালনের ঐতিহ্য ধরে রেখেছে। দিনব্যাপী মহররমের মেলা বসে চট্টগ্রামের রাঙ্গুনিয়ার মরিয়মনগরে। এই মেলা কেবল সদাইপত্রের মধ্যেই সীমাবদ্ধ নয়। মোরগ লড়াই, লাঠিখেলার আয়োজন থাকে এই মেলায়। মেহেরপুরের কুতুবপুরেও প্রতিবছর আয়োজন হয় মহররমের মেলা।

সিলেটের ওসমানীনগর বা পূর্বের বালাগঞ্জ থানার ২০টি গ্রামে এখনো বর্ণিলভাবে মহররমের প্রথম ১০ দিন পালিত হয়। সেখানে মহররমের জারির মাধ্যমে বিষাদ বেদনায় ভারাক্রান্ত মানুষের আর্তনাদে শোকের মাতম সৃষ্টি হয়। লোক সংস্কৃতি বিশেষজ্ঞ সুমনকুমার দাশ তার 'লোকায়ত জীবন ও লোকসাহিত্য' গ্রন্থে বর্ণনা করেছেন সেই চিত্র। তিনি উল্লেখ করেছেন, 'জারিগানে অংশ নেওয়া বয়াতি ও দোহারেরা জানান, জারিগানের লিখিত পদগুলোতে হাসান-হোসেনের বীরত্ব, জয়নবের বিলাপ, ইয়াজিদ বাহিনীর চক্রান্তের পাশাপাশি কারবালায় ঘটা নানা নিষ্ঠুরতার বর্ণনা থাকে। ওই সময়ের মধ্যে প্রত্যেকটি স্থানে পৃথকভাবে বিভিন্নজনের লেখা প্রায় চার শ জারিগান পরিবেশিত হয়।'

মহররম মাসের প্রথম দিন থেকে আশুরা পর্যন্ত ১০ দিন পরিবারের সব সদস্যদের নিয়ে সম্মিলিতভাবে মহররমের জারিগান পরিবেশিত হয়। এইসময় প্রতিটি পাক পাঞ্জাতন মোকামে বিভিন্ন গ্রাম থেকে ভক্তরা তাজিয়া, ঘোড়া নিশান দিয়ে পূর্বের মানত শোধ করেন। এই দিনগুলোতে তারা রোজা রাখেন, রাতে নিরামিষ খান এবং খালি পায়ে চলাচল করেন। সিলেটে মহররমের জারিগানে একমাত্র লিখিত এবং মুদ্রিত পুঁথি পাওয়া যায়। অন্য অঞ্চলে মুখে মুখে প্রচলিত আছে মহররমের জারিগান।

কিশোরগঞ্জের ভারত সীমান্তবর্তী বৌলাইতে পালিত হয় মহররমের শোক জারি। প্রয়াত সৈয়দ শাহ আব্দুল আউয়াল চিশতি প্রথম সেখানে তরফিয়া জারিদলের মাধ্যমে জারিগানের প্রবর্তন করেছিলেন। এর ধারাবাহিকতায় এখনো মহররমের প্রথম ১০ দিন সেখানে শোক জারি গাওয়া হয়।

পুরান ঢাকায় আশুরা পালনের ইতিহাস সুপ্রাচীন। মোগল আমল থেকেই এর সূচনা। মোগলরাই শিয়া মতাবলম্বীদের ঢাকায় নিয়ে এসেছেন। বিখ্যাত মোগল শাহজাদা শাহ সুজা বাংলার সুবেদার হয়েছিলেন ১৬১৬ সালে। শাহ সুজা শিয়া মতাবলম্বী ছিলেন। ঐতিহাসিকদের মতে প্রায় সাড়ে তিন শ শিয়া পরিবারকে ঢাকায় এনেছিলেন শাহ সুজা। ঢাকার সবচেয়ে বিখ্যাত ইমামবাড়া হোসেনী দালান নির্মিত হয়েছিল শাহ সুজার সুবেদারির সময়েই। শাহ সুজা তার নৌ সেনাপতি সৈয়দ মীর মুরাদকে দিয়ে ইমাম হোসেনের স্মরণে নির্মাণ করেছিলেন হসেনি দালাল। 'বাংলাদেশের প্রত্নসম্পদ' বইয়ে আবুল কালাম মোহাম্মদ যাকারিয়া হোসেনী দালানের ভবনের দেয়ালে লাগানো শিলালিপির কথা উল্লেখ করেছেন। তবে সেটি ছিল ছোট আকারের ইমামবাড়া। এটি পরে ভেঙে গেলে নায়েব নাজিমরা নতুন করে ইমামবাড়া নির্মাণ করেন।

ব্রিটিশ আমলে ঢাকা জেলার সিভিল সার্জন জেমস টেলর তার লেখা 'কোম্পানি আমলে ঢাকা' বইতে উল্লেখ করেছিলেন, ১৮৩২ সালেও আদি ইমামবাড়া টিকে ছিল। ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি দুই দফা সংস্কার করলেও পরবর্তীতে ১৮৯৭ সালের ভূমিকম্পে তা বিধ্বস্ত হয়। যদিও লক্ষাধিক টাকা খরচ করে পুনর্নির্মাণ ও সংস্কার করেছিলেন ঢাকার নবাব খাজা আহসানউল্লাহ।

শিয়া মতাবলম্বীরা এই ইমামবাড়া ও আশুরা পালনকে টিকিয়ে রাখেন। তেমনই আশুরা পালনের আরেকটি ঐতিহ্য ধরে রেখেছে পুরান ঢাকার ফরাশগঞ্জের 'বিবিকা রওজা'। ঐতিহাসিকদের মতে এটাই ঢাকার সবচেয়ে প্রাচীন ইমামবাড়া।

মহরমের নবম দিন অর্থাৎ আশুরার আগের দিন মাগরিবের পর বিবিকা রওজা থেকে শিয়া মতাবলম্বীরা পায়ে হেঁটে এবং দুলদুল ঘোড়া নিয়ে বাংলাবাজার, লক্ষ্মীবাজার, ডালপট্টি এবং সূত্রাপুরের সড়ক ঘুরে মিছিল করেন। পরে আশুরার দিন ঢাকার বিভিন্ন সড়ক ঘুরে তাজিয়া মিছিল করেন তারা।

ভক্তরা মহররমের প্রথম ১০ দিনে নানা রকম মানত করেন। যদি মানত পূর্ণ হয় তবে তারা বিবিকা রওজায় এসে সেই মানত আদায় করেন। বিবিকা রওযায় অনেকে আবার তাওয়াফ ও করেন এসময়। একসময় শিয়ারা কেবল পুরান ঢাকায় সীমাবদ্ধ থাকলেও বর্তমানে ঢাকার বিভিন্ন এলাকায় ছড়িয়ে পড়েছে। তবে তাজিয়া মিছিলের প্রধান মিছিল বের হয় ঢাকার সবচেয়ে ঐতিহ্যবাহী ইমামবাড়া হোসেনী দালান থেকেই।

আশুরার দিনটি যেমন ধর্মীয়ভাবে গাম্ভীর্যপূর্ণ তেমনইভাবে বাংলার লোক সংস্কৃতির অবিচ্ছেদ্য অংশ। বহুক্ষেত্রেই বাংলার লোক সংস্কৃতি এবং বিভিন্ন ধর্মীয় উৎসব মিলেমিশে একাকার হয়ে গেছে। তেমনই এক অনন্য উদাহরণ আশুরা।

সূত্র- কোম্পানি আমলে ঢাকা/ জেমস টেলর লোকায়ত জীবন ও লোকসাহিত্য/ সুমনকুমার দাশ

[email protected]

 

Comments

The Daily Star  | English
cyber security act

A law that gagged

Some made a differing comment, some drew a political cartoon and some made a joke online – and they all ended up in jail, in some cases for months. This is how the Digital Security Act (DSA) and later the Cyber Security Act (CSA) were used to gag freedom of expression and freedom of the press.

7h ago