মানিকগঞ্জ

ড্রেজার দিয়ে মাটি তোলায় ৫ বছরে ১৫০০ বাড়িঘর কালীগঙ্গায় বিলীন

কালীগঙ্গা নদীতে ড্রেজার বসিয়ে মাটি তোলায় গত ৫ বছরে মানিকগঞ্জের দৌলতপুর উপজেলার ৮টি গ্রামের অন্তত দেড় হাজার বাড়িঘর নদীগর্ভে বিলীন হয়েছে। নদী ভাঙনের ঝুঁকিতে আছে বিভিন্ন সরকারি স্থাপনাসহ আরও বসতবাড়ি ও বিস্তীর্ণ এলাকার ফসলি জমি।
নদীগর্ভে
দৌলতপুর উপজেলার ৮টি গ্রামের অন্তত দেড় হাজার বাড়িঘর নদীগর্ভে বিলীন হয়েছে। ছবি: জাহাঙ্গীর শাহ/স্টার

কালীগঙ্গা নদীতে ড্রেজার বসিয়ে মাটি তোলায় গত ৫ বছরে মানিকগঞ্জের দৌলতপুর উপজেলার ৮টি গ্রামের অন্তত দেড় হাজার বাড়িঘর নদীগর্ভে বিলীন হয়েছে। নদী ভাঙনের ঝুঁকিতে আছে বিভিন্ন সরকারি স্থাপনাসহ আরও বসতবাড়ি ও বিস্তীর্ণ এলাকার ফসলি জমি।

কালীগঙ্গা নদী মানিকগঞ্জ জেলা শহর থেকে ঘিওর উপজেলার জাবরা এলাকা হয়ে দৌলতপুর উপজেলার চরকাটারী এলাকায় যমুনা নদীতে মিশেছে। জেলা শহর থেকে যমুনার মোহনা পর্যন্ত ২০ কিলোমিটার এই নদীর দৈর্ঘ্য। 

সূত্র জানায়, দৌলতপুর উপজেলার খলশী, চকমিরপুর এবং জিয়নপুর এই ৩ ইউনিয়নের ৬ কিলোমিটার এলাকায় অবৈধভাবে ড্রেজার বসানো হয়েছে। 

গত ১২ আগস্ট সরেজমিনে দৌলতপুর উপজেলার এই ৩ ইউনিয়নে গিয়ে দেখা যায়, ৬ কিলোমিটার নদী এলাকায় অন্তত ৫০টি স্থানে অবৈধভাবে ড্রেজার বসিয়ে নদী থেকে মাটি তোলা হচ্ছে।

ড্রেজার
কালীগঙ্গা নদীতে ড্রেজার বসিয়ে মাটি তোলার পাড় ভেঙে বাড়িঘর বিলীন হচ্ছে। ছবি: জাহাঙ্গীর শাহ/স্টার

যেসব এলাকায় ড্রেজার বসানো হয়েছে সেখানে নদীভাঙন মারাত্মক আকার ধারণ করেছে। 

ভাঙনকবলিত এলাকার বাসিন্দাদের অভিযোগ, গত ৫-৬ বছর ধরে নদী থেকে ড্রেজার বসিয়ে মাটি উত্তোলন চলছে। স্থানীয় প্রশাসনের সামনে সরকার দলীয় লোকজন এই অবৈধ ব্যবসা করছেন।

এর ফলে ভাঙ্গা রামচন্দ্রপুর ও আবুডাঙ্গা গ্রাম পুরোটাই এবং পারমাস্তুল, রামচন্দ্রপুর, চরমাস্তুল, লাউতারা, জৈন্তা পংতিরছা ও বিষ্ণুপুর গ্রামের অর্ধেক এলাকা নদীগর্ভে চলে গেছে। গত ৫ বছরে রামচন্দ্রপুর ও আবুডাঙ্গা গ্রামের অন্তত ৬০০ পরিবারসহ সবগুলো গ্রামের মোট ১৫০০ পরিবার গৃহহীন হয়েছেন বলে জানান তারা।

খলশী ইউনিয়ন পরিষদের সাবেক চেয়ারম্যান সাখাওয়াত জাহাঙ্গীর সেনা দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, 'আমি ২০১৬ সালের মার্চ মাস থেকে ২০২২ সালের জানুয়ারি পর্যন্ত খলশী ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যানের দায়িত্বে ছিলাম। আমি বারবার চেষ্টা করেও নদী থেকে ড্রেজার বসিয়ে মাটি উত্তোলন বন্ধ করতে পারি নাই। সরকার দলীয় প্রভাবশালীরা স্থানীয় প্রশাসনের মদদে এই অবৈধ ব্যবসা চলছে।'

ড্রেজার
কালীগঙ্গা নদীতে ড্রেজার বসিয়ে মাটী তোলা হচ্ছে। ছবি: জাহাঙ্গীর শাহ/স্টার

তিনি বলেন, 'গত ৫ বছরে বিষ্ণুপুর গ্রামের ১০০টির বেশি বাড়ি-ঘর ও জমিজমা নদীগর্ভে বিলীন হয়েছে। এই গ্রামের বাসিন্দা এবং ৬ নং ওয়ার্ডের ইউপি সদস্য আতিকুর রহমান খানের ৪টি টিনের ঘর, একটি মুরগীর খামারসহ বাড়িটি গত বছর নদীগর্ভে বিলীন হয়েছে। ওই গ্রামের হামেদ নদীতে ড্রেজার বসিয়েছেন। তার সঙ্গে সরকারদলীয় লোকজন জড়িত বলে কেউ প্রতিবাদ করতে সাহস পায় না।'

'এভাবে নদীতে ড্রেজার বসিয়ে নদী থেকে মাটি তোলা অব্যাহত থাকলে পারমাস্তুল ও বিষ্ণুপুর গ্রামের অধিকাংশ এলাকা নদীগর্ভে বিলীন হবে,' বলেন তিনি।

চকমিরপুর ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান শফিকুল ইসলাম ডেইলি স্টারকে বলেন, 'আমার ইউনিয়নের ভাঙ্গা রামচন্দ্রপুর গ্রামের সবটুকুই নদীতে বিলীন হয়েছে। রামচন্দ্রপুর ও চরমাস্তুল এলাকার অর্ধেক এলাকা ইতোমধ্যে নদীগর্ভে চলে গেছে। প্রতি বছরই পানি বাড়া এবং কমার সময় নদীভাঙন দেখা দেয়।'

এ ইউনিয়নের লাউতারা গ্রামের বাসিন্দা আবুল কালাম আজাদ ডেইলি স্টারকে বলেন, 'জিয়নপুর ইউনিয়নের আবুডাঙ্গা, লাউতারা এবং জৈন্তা পংতিরছা গ্রামের পাশে নদীতে ড্রেজার বসিয়ে মাটি উত্তোলনের ফলে নদীভাঙন দেখা দিয়েছে। গত ৫-৬ বছরে আবুডাঙ্গা গ্রামের সবটুকু নদীগর্ভে বিলীন হয়েছে। লাউতারা এবং জৈন্তা পংতিরছা গ্রামের অধিকাংশ এলাকা নদীগর্ভে বিলীন হয়েছে।'

ভিটেমাটি হারিয়ে এসব এলাকার বাসিন্দারা দৌলতপুর, মানিকগঞ্জ, নবীনগর ও সাভার এলাকায় গিয়ে বসবাস করছেন বলে জানান তিনি।

ড্রেজার
কালীগঙ্গা নদীতে ড্রেজার বসিয়ে মাটী তোলা হচ্ছে। ছবি: জাহাঙ্গীর শাহ/স্টার

জানতে চাইলে মানিকগঞ্জ পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী মো. মাঈন উদ্দিন দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, 'এসব ড্রেজার সাধারণত নদীর পাড়েই বসানো হয়। তাই মাটি উত্তোলনের ফলে পাড় ভেঙে গিয়ে বসতভিটা, ফসলি জমি নদীতে বিলীন হওয়ার আশঙ্কা থাকে।' 

দৌলতপুর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মো. ইমরুল হাসানের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, 'নদীতে ড্রেজার বসিয়ে মাটি উত্তোলনের অভিযোগে বেশ কয়েকটি অভিযান চালিয়েছি। জেল-জরিমানা করেছি। ড্রেজার পুড়িয়ে দিয়েছি। এরপরও যদি কেউ এই ড্রেজার বসিয়ে নদী থেকে মাটি উত্তোলন করে, তাহলে প্রশাসনের পক্ষ থেকে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া হবে।'

এদিকে, কালিগঙ্গা নদীর ঘিওর উপজেলারও বেশ কয়েকটি এলাকায় ড্রেজার বসিয়ে নদী থেকে মাটি উত্তোলন করা হচ্ছে বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে। এর ফলে সাইংজুরি, ঘিওর, কুস্তা এলাকায় ব্যাপক নদীভাঙন দেখা দিয়েছে। 

এ ঘিওর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা হামিদুর রহমান ডেইলি স্টারকে বলেন, 'আমি এটা করতে দেবো না। ভ্রাম্যমাণ আদালতের মাধ্যমে অভিযান চালিয়ে দুদিন আগেও ৫০ হাজার টাকা জরিমানা করেছি।'

তিনি বলেন, 'ড্রেজারগুলো ইঞ্জিনচালিত নৌকায় বসানো হয়। অভিযানের খবর পেয়েই তারা নৌকা নিয়ে পালিয়ে যায়। তবুও অভিযান অব্যাহত থাকবে।'

Comments