একটি পরিবারের অন্তহীন ভোগান্তি

ঘটনাটি ৪ বছর আগের। সাদা পোশাকের কয়েকজন ব্যক্তি মোহন মিয়াকে তার মিরপুরের বাসা থেকে তুলে নিয়ে যায়। এরপর আর তিনি ঘরে ফেরেননি।

ঘটনাটি ৪ বছর আগের। সাদা পোশাকের কয়েকজন ব্যক্তি মোহন মিয়াকে তার মিরপুরের বাসা থেকে তুলে নিয়ে যায়। এরপর আর তিনি ঘরে ফেরেননি।

মোহনের বাবা জমশের আলীর দাবি, র‍্যাব-৪ এর সদস্যরা কোনো কারণ না জানিয়ে তার বড় ছেলেকে ধরে নিয়ে গেছে। এ অভিযোগের স্বপক্ষে তার কাছে প্রমাণ আছে বলেও দাবি করেন তিনি।

জাতিসংঘের একটি ওয়ার্কিং গ্রুপ গত বছর সরকারের কাছে অন্তত ৭৬টি 'গুমে'র ঘটনার বিষয়ে তথ্য চেয়েছে। মোহনের 'গুমে'র ঘটনাটি জাতিসংঘের ওই তালিকায় রয়েছে।

মোহনের পরিবারের অভিযোগ, চলতি বছরের ১০ এপ্রিল জমশেরের ছোট ছেলে রাজু আহমেদকেও (৪০) র‍্যাব-৪ এর সদস্যরা (কয়েকজনের পরনে সাদা পোশাক ছিল) মিরপুর-২ নম্বরের একই বাড়ি থেকে গভীর রাতে ধরে যায়। গত ৪ বছর ধরে মালয়েশিয়ায় কর্মরত রাজু এ ঘটনার প্রায় ২ সপ্তাহ আগে দেশে এসেছিলেন।

তারা দাবি করেন, রাজুর বিরুদ্ধে ৮ বছর আগে দায়ের করা মাদক মামলার সূত্রে তার বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি হয়েছে। র‍্যাব তাকে পরের দিন মিরপুর পুলিশের কাছে সোপর্দ করে।

তবে রাজুকে আদালতে হাজির করার পর পুলিশ জানতে পারে, শাহ আলী থানায় দায়ের করা গাঁজা সেবন সংক্রান্ত মামলাটি ২০১৯ সালেই খারিজ হয়ে গেছে।

রাজুকে তুলে নেওয়ার ঠিক ১ মাস আগে, র‍্যাবের এই ইউনিটটি একটি চাঁদাবাজির মামলায় মোহনের ১৫ বছর বয়সী ছেলে ও তার ১৭ বছর বয়সী ফুফাতো ভাইকে অন্তর্ভুক্ত করে।

১০ মার্চ দায়ের করা একটি মিথ্যে মামলায় এই ২ জনসহ আরও ৬ জনের বিরুদ্ধে একজন স্থানীয় বাসিন্দাকে মারধর ও তার কাছ থেকে জোরপূর্বক চাঁদা আদায়ের অভিযোগ আনা হয়। অভিযুক্তদের সবাই স্কুল ও কলেজ ছাত্র। দ্য ডেইলি স্টার এ বিষয়ে গত মাসে একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে।

১ আগস্ট র‍্যাব-৪ এর সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে কর্মকর্তারা জানান, তারা ২৫ জুলাই পত্রিকায় প্রকাশিত প্রতিবেদন থেকে এ চাঁদাবাজির মামলার বিষয়ে জানতে পেরেছেন। তারা এ বিষয়ে তদন্ত শুরু করেছেন বলেও জানান।

র‍্যাব-৪ এর কমান্ডিং অফিসার মোজাম্মেল হক বলেন, 'সব অভিযোগের তদন্ত হবে এবং সে অনুযায়ী ব্যবস্থা নেওয়া হবে।'

এর আগে ২৫ জুলাইর প্রতিবেদন সম্পর্কে তাদের মতামত জানতে চাওয়া হলে র‍্যাব-৪ এর কর্মকর্তারা নিরপরাধ তরুণদের মামলায় জড়ানোর অভিযোগ অস্বীকার করেন।

একটি পরিবারের ভোগান্তি

১০ এপ্রিলের গ্রেপ্তারের ঘটনার বর্ণনা দিতে যেয়ে রাজু জানান, একটি মাইক্রোবাস, একটি গাড়ি ও ২টি মোটরসাইকেল নিয়ে রাত সাড়ে ১১টার দিকে র‍্যাব সদস্যরা তাদের বাড়িতে আসেন। প্রথমে ৭-৮ জন সাদা পোশাকে তাদের বাসায় প্রবেশ করেন। বেশ কয়েকজন বাইরে অপেক্ষা করছিলেন।

তারা নিজেদেরকে র‍্যাবের সদস্য হিসেবে পরিচয় দেন এবং তাকে ৮ বছর আগে দায়ের করা মাদক মামলার সূত্রে তাদের সঙ্গে যেতে বলেন।

৪ বছর আগে মোহনের 'গুমে'র ভয়াবহতার সঙ্গে তার পরিবার তখনো মানিয়ে নিতে পারেনি। তারা ধারণা করেন, সাদা পোশাকের মানুষগুলো তাদেরকে ধোঁকা দিচ্ছেন। জমশের আলী তাদেরকে এটাও জানান যে একইভাবে কিছু র‍্যাব সদস্য তার বড় ছেলেকে তুলে নিয়ে গেছে।

প্রায় আধাঘণ্টা পর, কয়েকজন ইউনিফর্ম পরা র‍্যাব সদস্য সেখানে পৌঁছান এবং জোর দিয়ে জানান, রাজুকে তাদের সঙ্গে যেতে হবে।

পরিবারের সদস্যরা গ্রেপ্তারি পরোয়ানা দেখতে চাইলেও কর্মকর্তারা তা দেখাননি। এক পর্যায়ে তারা 'রাজুর কলার ধরে' তাকে জোর করে একটি গাড়িতে উঠান।

রাজু বলেন, 'গাড়ির ভেতরে তারা আমাকে ৩ বার চড় মারেন।' তিনি আরও জানান, তার মা ও স্ত্রী গাড়িটি অনুসরণ করেন এবং তাদেরকে র‍্যাব-৪ এর কার্যালয়ে প্রবেশ করতে দেখেন।

আদালতের কর্মকর্তারা জানান, এই মামলাটি সাক্ষীর অভাবে ২০১৯ সালের জানুয়ারিতে খারিজ হয়ে যায়।

রাজু ডেইলি স্টারকে বলেন, 'আমি মালয়েশিয়া যাওয়ার ৩ মাস পর আমার ভাই "গুম" হন। তারপর আমি নিজেও "গুমে"র শিকার হতে যাচ্ছিলাম।'

মোহনকে ২০১৮ সালের ১০ জুন রাতে একটি জনবহুল জায়গা থেকে তুলে নেওয়া হয়। ৩টি সিসিটিভি ক্যামেরায় এই ঘটনা আংশিক ধারণ আছে।

ডেইলি স্টারের হাতে আসা একটি ভিডিও ফুটেজে দেখা গেছে, জমশের আলীর মিরপুর-২ নম্বরের বাসার কাছে সাদা পোশাক পরা ৫-৬ জন দাঁড়িয়ে ছিলেন। পরে আরও ২ জন মোটরসাইকেলে সেখানে আসেন। মোটরসাইকেল আরোহীরা মোহনকে তাদের ২ জনের মাঝে জোর করে বসিয়ে সেখান থেকে দ্রুতগতিতে চলে যান।

প্রায় ১০ দিন পর হাফিজুর রহমান নামে এক ব্যক্তি জমশেরের বাসায় যান। তিনি নিজেকে র‍্যাব-৪ এর সদস্য হিসেবে পরিচয় দেন এবং জানান মোহন র‍্যাবের হেফাজতে আছে। মোহনের বাবা হাফিজুরকে কিছু টাকা ও তার সন্তানের জন্য ওষুধ দেন।

জমশের জানান, পরের দিন হাফিজুর একটি চিঠি নিয়ে ফিরে আসেন। তার দাবি, এটি মোহন তার স্ত্রীর উদ্দেশে লিখেছেন। চিঠিতে জানা যায়, মোহন র‍্যাব হেফাজতে আছেন এবং সেখানে তাকে নির্যাতন করা হচ্ছে।

এই ঘটনা নিয়ে ২০১৮ সালের ২৮ আগস্ট জমশের একটি সংবাদ সম্মেলনের আয়োজন করেন। সেখানে তিনি সাংবাদিকদের তার কল হিস্টোরি দেখান, যেখানে দেখা যায় হাফিজুরের নম্বর থেকে তার নম্বরে জুনের ১৩ থেকে ২৪ তারিখের মধ্যে প্রায় ১০০টি কল করা হয়েছে।

৯৪টি কল এসেছে মিরপুর-পাইকপাড়া এলাকা থেকে, যেখানে র‍্যাব-৪ এর কার্যালয় অবস্থিত। বাকি ৬টি কলের মধ্যে একটি রাজারবাগ পুলিশ লাইনস থেকে করা। বেশ কিছু কল র‍্যাব-৪ এর ৩টি আনুষ্ঠানিক নম্বরে করা হয়। আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর এক সদস্যের কাছ থেকে জমশের কল ডিটেল রেকর্ড সংগ্রহ করেন।

জমশের সাংবাদিকদের হাফিজুরের সিম কার্ডের নিবন্ধন ফর্মটিও দেখান, যেখানে পুলিশের পোশাক পরা এক ব্যক্তিকে দেখা যায়।

মোহনের 'গুমে'র ঘটনা অনুসন্ধান করার সময় ডেইলি স্টার ২০১৯ সালের মে মাসে হাফিজুরের সঙ্গে কথা বলে। হাফিজুর জানান, তিনি আগে র‍্যাব-৪ এর সদস্য ছিলেন। কিন্তু এ মুহূর্তে তার পোস্টিং মেহেরপুর পুলিশে।

একই মাসে র‍্যাব-৪ এর তৎকালীন কমান্ডিং অফিসার চৌধুরী মঞ্জুরুল কবির তার ইউনিটের বিরুদ্ধে মোহনকে তুলে নেওয়ার অভিযোগ অস্বীকার করেন।

১ আগস্ট ডেইলি স্টারের সঙ্গে কথা বলার সময় বর্তমান কমান্ডিং অফিসার মোজাম্মেল হক এ বিষয়ে মন্তব্য করতে রাজি হননি। তিনি জানান, ঘটনার সময় তিনি এই ইউনিটে ছিলেন না।

রাজুকে তুলে নেওয়া প্রসঙ্গে তিনি জানান, র‍্যাব প্রায়ই আদালতের ইস্যু করা গ্রেপ্তারি পরোয়ানা অনুযায়ী ব্যবস্থা নিয়ে থাকে। এই মামলার গ্রেপ্তারি পরোয়ানা প্রত্যাহার করা হয়েছে কি না, সে বিষয়টি খতিয়ে দেখতে হবে।

জমি নিয়ে বিবাদের যোগসূত্র?

জমশের তার সব 'ঝামেলার' জন্য স্থানীয় বাসিন্দা আজিজুল হোসেন খানের সঙ্গে এক খণ্ড জমি নিয়ে বিবাদের যোগসূত্র রয়েছে বলে দাবি করেন। তিনি জানান, এই ব্যক্তির প্রভাবে কিছু র‍্যাব সদস্য তার বিরুদ্ধাচরণ করছেন। তবে ডেইলি স্টার এই দাবির সত্যতা যাচাই করতে পারেনি।

নথি অনুযায়ী, ২০০৭ সালে আজিজুল মিরপুরের এই বিতর্কিত পৌনে এক কাঠা জমির পাওয়ার অব অ্যাটর্নি পান। ফারুক নামের এক ব্যক্তির সঙ্গে চুক্তি সাক্ষরের পর তিনি এই ক্ষমতা পান।

তবে জমশেরের দাবি, এই প্লটটি তাদের পৈতৃক জমির অংশ, যেখানে তারা বাড়ি বানিয়েছেন। বিষয়টি এখন আদালতের নিষ্পত্তির অপেক্ষা আছে।

'তিনি (আজিজুল) দীর্ঘদিন ধরে আমাদের উচ্ছেদের চেষ্টা করছেন। তিনি আমাকে হুমকি দিলে আমি ২ বার থানায় সাধারণ ডায়েরি (জিডি) করেছি। এরপর আমার পরিবারের সদস্যদের বিরুদ্ধে একের পর এক বেশ কয়েকটি মামলা দায়ের করা হয়। তবে আমাদের সব মামলা থেকে অব্যাহতি দেওয়া হয়েছে। এবার তারা আমার নাতি ও ভাগ্নের নামে নতুন মামলা করেছে', যোগ করেন তিনি।

আজিজুল তার বিরুদ্ধে আনা সব অভিযোগ অস্বীকার করে বলেন, 'এই জমি নিয়ে  একটি বিবাদ হয়েছে। তার মানে এই না যে, আমি এসব করার জন্য (র‍্যাবকে) প্রভাবিত করেছি।'

নাম প্রকাশ না করার শর্তে মিরপুরের একজন কাউন্সিলর ও এলাকার কয়েকজন বাসিন্দা জানান, আজিজুল ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ এবং তার বেশ কিছু নিকটাত্মীয় পুলিশে চাকরি করেন।

এ বিষয়ে মন্তব্য করতে রাজি হননি আজিজুল।

জমশের 'র‍্যাবের তথ্যদাতা' হিসেবে জয় আহমেদ নামে আরেকজনের কথা উল্লেখ করেন ‍তিনি। জয় এর আগে মোহন মিয়াকে র‍্যাবের হেফাজত থেকে মুক্ত করার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন। এ কাজের জন্য জমশেরের কাছ থেকে ২ লাখ টাকা নেওয়ার অভিযোগে দায়ের করা মামলায় তিনি কিছুদিন হাজতে ছিলেন বলে জানান জমশের।

তবে জয় এ ঘটনার সঙ্গে সংশ্লিষ্টতার অভিযোগ অস্বীকার করেন।

ইতোমধ্যে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে চাঁদাবাজির মামলার তদন্তভার র‍্যাবের হাতে তুলে দেওয়া হয়েছে। এর আগে, পল্লবী থানা পুলিশ এ ঘটনার তদন্ত করছিল।

পল্লবী থানার উপপরিদর্শক আনোয়ার হোসেন এ মামলার তদন্ত কর্মকর্তা ছিলেন। তিনি জানান, ২৫ জুলাই র‍্যাব এই মামলার নথিগুলো গ্রহণ করেছে। একই দিনেই ডেইলি স্টারে এ বিষয়ে একটি প্রতিবেদন ছাপা হয়।

মামলার বাদী নাজমুল হোসেন বাপ্পী ডেইলি স্টারকে জানান, ৭ মার্চ মিরপুরে মোটরসাইকেল দুর্ঘটনা সূত্রে এই মামলা দায়ের করা হয়। একটি চলন্ত মোটরসাইকেলের ধাক্কায় তার বাবা আহত হন। সেটি চালাচ্ছিল একজন কিশোর।

পরদিন ওই কিশোরের পরিচিত ৫ কলেজশিক্ষার্থী তাদের বাসায় ঘটনাটির নিষ্পত্তি করতে গেলে র‍্যাব-৪ এর কয়েকজন সদস্য তাদের তুলে নেয়।

জমশেরের নাতি ও ভাগ্নেকে পরে এই মামলায় অভিযুক্ত করা হয়। এ বিষয়ে বাদী কিছুই জানতেন না বলে দাবি করেছেন। 

অনুবাদ করেছেন মোহাম্মদ ইশতিয়াক খান

Comments