ছাত্রলীগের কাজ কী, করছে কী

বুয়েটে আবরার হত্যা, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষার্থীকে যৌন নিপীড়ন, 'এক পায়ে পাড়া দিমু, আরেক পা টাইনা ছিঁড়ে ফেলব'— অডিও রেকর্ড ফাঁস করার অভিযোগ ইডেন কলেজের ২ শিক্ষার্থীকে সাড়ে ৬ ঘণ্টা রুমে আটকে রেখে নির্যাতন, এমন অসংখ্য ঘটনার সঙ্গে ছাত্রলীগের নেতা-কর্মীরা জড়িত।

বুয়েটে আবরার হত্যা, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষার্থীকে যৌন নিপীড়ন, 'এক পায়ে পাড়া দিমু, আরেক পা টাইনা ছিঁড়ে ফেলব'— অডিও রেকর্ড ফাঁস করার অভিযোগ ইডেন কলেজের ২ শিক্ষার্থীকে সাড়ে ৬ ঘণ্টা রুমে আটকে রেখে নির্যাতন, এমন অসংখ্য ঘটনার সঙ্গে ছাত্রলীগের নেতা-কর্মীরা জড়িত।

বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়-কলেজে ছাত্রলীগের বিরুদ্ধে হলে সিট দখল, নিয়োগ বাণিজ্য, টেন্ডার বাণিজ্য, চাঁদাবাজি, টর্চার সেলে সাধারণ শিক্ষার্থীদের নির্যাতন এমন অসংখ্য ঘটনার অভিযোগ রয়েছে।

ছাত্রলীগের নেতা-কর্মীদের দায়িত্ব ও কর্তব্য আসলে কী এবং তারা ক্যাম্পাসগুলোতে কী করেন তা জানতে দ্য ডেইলি স্টার কথা বলেছে আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক বি এম মোজাম্মেল হক, সমাজতান্ত্রিক ছাত্র ফ্রন্টের (বাসদ) কেন্দ্রীয় সভাপতি মুক্তা বাড়ৈ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের (ঢাবি) ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক সাদ্দাম হোসাইনের সঙ্গে।

মুক্তা বাড়ৈ বলেছেন, ছাত্রলীগ সাধারণ শিক্ষার্থীদের অধিকার নিয়ে কাজ না করে বরং দখলদারিত্ব ও সন্ত্রাসী কার্যক্রমেই বেশি সোচ্চার। অন্যদিকে ছাত্রলীগ ও আওয়ামী লীগের ২ নেতা বলছেন কিছু সীমাবদ্ধতা ও নেতিবাচক ঘটনা থাকলেও ছাত্রলীগ মূলত সাধারণ শিক্ষার্থীদের জন্যই কাজ করছে।

সমাজতান্ত্রিক ছাত্র ফ্রন্টের (বাসদ) সভাপতি বলেন, 'রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগের এক নেতা একজনকে "আবরারের মতো অবস্থা করা হবে" বলে হুমকি দিয়েছেন। ইডেন কলেজে ছাত্রলীগের সভাপতির কথা সবাই শুনেছে। সেখানে মেয়েদের জিম্মি করে নির্যাতন করা হয়। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে গত বছর ১৫ জন শিক্ষার্থীকে গেস্টরুম না যাওয়ার অপরাধে হল থেকে বের করে দিয়েছে ছাত্রলীগ। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে আবু বকর হত্যা, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে যুবায়ের হত্যা, বিশ্বজিৎ হত্যা— প্রতিটি জায়গায় ছাত্রলীগ জড়িত। তারা ক্যাম্পাসে দখলদারিত্ব ও সন্ত্রাসী কার্যক্রম চালাচ্ছে। শান্তিপূর্ণ ক্যাম্পাসগুলোতে সন্ত্রাসীদের অভয়ারণ্য তৈরি করেছে।'

'ছাত্রলীগ সব সময় ভিন্নমত দমনে সোচ্চার থাকে। শিক্ষার্থীদের যৌক্তিক দাবি আদায়ে তাদের কখনো কথা বলতে দেখা যায় না। বরং শিক্ষার্থীদের যৌক্তিক দাবি আদায়ের আন্দোলনে হামলা চালিয়ে, সন্ত্রাসী কার্যক্রম করে, তারা ভয়ের সংস্কৃতি তৈরি করে। মৌলিক অধিকার আদায়ের আন্দোলনে হামলা করাই তাদের তাদের কাজ। ক্যাম্পাসগুলোতে তাদের বিভিন্ন টর্চার সেল আছে। প্রশাসনের সহযোগিতায় তারা বিভিন্ন সন্ত্রাসী কার্যক্রম চালাচ্ছে,' যোগ করেন তিনি।

সাদ্দাম হোসাইন বলেন, 'বিশ্ববিদ্যালয়সহ বাংলাদেশের শিক্ষার্থীদের কাছে ছাত্রলীগ হচ্ছে নির্ভরতার একটি নাম। শিক্ষার্থীদের অভাব অনটন, উচ্চ শিক্ষার পরিবেশ ও আবাসন ব্যবস্থাসহ তাদের অধিকার নিয়ে সব সময় আমরা কাজ করি। তরুণ প্রজন্মের সুকুমারবৃত্তি ও নেতৃত্ব বিকাশে ছাত্রলীগ কাজ করে।'

আপনি যে অধিকারের কথা বলছেন ছাত্রলীগ কি আদৌ এসব অধিকার নিয়ে কাজ করে? জানতে চাইলে তিনি বলেন, 'আমাদের কিছু সীমাবদ্ধতা আছে। তবে সার্বিকভাবে দেখলে আমরা অবশ্যই শিক্ষার্থীদের অধিকার নিয়ে কাজ করি। শিক্ষার্থীদের আবাসন সুবিধাসহ তারা যাতে ভালো থাকে সেই অধিকার নিয়েই আমরা কাজ করছি।'

প্রতিটি আবাসিক হলে ছাত্রলীগের টর্চার সেল আছে, ছাত্রলীগ হলে রুম দখল করে থাকে, রাজনৈতিক কর্মসূচিতে যেতে বাধ্য করা হয়, না গেলে নির্যাতন করা হয়। এই বিষয়ে ঢাবি ছাত্রলীগের বক্তব্য জানতে চাইলে তিনি বলেন, 'এগুলোর বাস্তব কোনো ভিত্তি নেই। একজন শিক্ষার্থী কী করবে না করবে, কোন সংগঠন করবে, কোথায় থাকবে এটি তার অধিকার। হলে কোনো শিক্ষার্থী থাকলে তার প্রথম পরিচয় সে হলের আবাসিক হলের শিক্ষার্থী। তবে এটি সত্য যে অনেক আবাসিক হলেই এখন নেতিবাচক সংস্কৃতি বিদ্যমান আছে।'

আপনি বললেন একটি আবাসিক হলের শিক্ষার্থীরা কে কোন সংগঠন করবে এটি তার অধিকার। কিন্তু আপনারা কি ভিন্ন মতের বিশেষ করে ছাত্রদলের নেতা-কর্মীদের হলে থাকতে দেন? এমন প্রশ্ন করলে সাদ্দাম হোসেন বলেন, 'কে হলে থাকবে না থাকবে, সেটা তো ছাত্রলীগ নির্ধারণ করবে না। হল প্রশাসন নির্ধারণ করবে। আবাসিক হলে কে থাকবে না থাকবে, সেটি ছাত্র সংগঠনগুলোর দেখার কথা নয়। দেখার কথা প্রশাসনের।'

ইডেন ছাত্রলীগের সভাপতি সম্প্রতি যা করেছে তা কি ছাত্রলীগের কাজের মধ্যে পড়ে? জানতে চাইলে তিনি বলেন, 'এটি করে থাকলে অবশ্যই দুঃখজনক ঘটনা। এটি অস্বীকার করার উপায় নেই যে অনেকেই ক্ষমতার অপব্যবহার করছে। নৈতিকস্খলনের ঘটনা ঘটছে। তবে আমরা সবসময়ই বিভিন্ন অপরাধে জড়িতদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেই।'

বি এম মোজাম্মেল হক বলেন, 'ছাত্রলীগের দায়িত্ব ও কর্তব্য হলো শিক্ষার্থীদের অধিকার প্রতিষ্ঠা করা, গণতান্ত্রিক পরিবেশ সৃষ্টি করা, শিক্ষার্থীদের সুবিধা-অসুবিধা নিয়ে কথা বলা, নীতি ও আদর্শকে ধারণ করা এবং সেই আলোকে কথা বলা।'

সম্প্রতি ছাত্রলীগের যতটা ইতিবাচক সংবাদ পাওয়া যায়, তার চেয়ে বেশি নেতিবাচক সংবাদ। কেন এমনটা হচ্ছে জানতে চাইলে ছাত্রলীগের বিভিন্ন বিষয় দেখভালের দায়িত্বে থাকা এই নেতা বলেন, 'সব ছাত্র সংগঠনেই অপরাধ করে। তবে ছাত্রলীগের বিষয়গুলো প্রচার হয় বেশি। অনেক ছাত্রলীগ কর্মী ভুল করে। আত্ম উপলব্ধি হলে পরে ক্ষমাও চায়। পরিমিতিবোধ কম থাকার কারণেই অনেক শিক্ষার্থী বিভিন্ন অন্যায় কাজের সঙ্গে জড়িত হয়। তবে তাদের এ ধরনের ভুল করা উচিত না।'

গণমাধ্যমে দেখা যায় ছাত্রলীগ নিয়োগ বাণিজ্য, টেন্ডার বাণিজ্য, চাঁদাবাজি, সাধারণ শিক্ষার্থীদের টর্চার, যৌন হয়রানিসহ বিভিন্ন ঘটনার সঙ্গে জড়িত। এই ঘটনাগুলো কেন ঘটে? ছাত্রলীগ কি আপনাদের নিয়ন্ত্রণের বাইরে? এমন প্রশ্নের জবাবে আওয়ামী লীগের এই নেতা বলেন, 'আমাদের দেশে সমাজ ও রাজনীতির বিবর্তন হচ্ছে। রাজনীতি হলো মানুষের কল্যাণে, দেশের কল্যাণে। সেই ধারার বিচ্যুতি ঘটালেই নানা প্রশ্ন আসে। আমারও এমন প্রশ্ন আসে। কেউ আদর্শ ধারণ করে আবার কেউ ফায়দা লুটার চেষ্টা করে। যখন আমরা নির্ধারণ করতে পারি যে নীতিনৈতিকতার বিচ্যুতি ঘটেছে, কেউ সুবিধাবাদী, ফায়দা লুটকারী, তখন তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হয়। একেকজন একেক পরিবার থেকে থেকে আসে। হুট করেই কারো সম্পর্কে ধারণা পোষণ করা যায় না। তাই একটু সমস্যা হয়ে থাকে।'

ছাত্রলীগের প্রতিষ্ঠা ১৯৪৮ সালে। এতদিন পরে এসেও মতলববাজরা কীভাবে ছাত্রলীগের মধ্য ঢুকে? এমন প্রশ্ন করলে মোজাম্মেল হক বলেন, 'দেশের মানুষের সংখ্যা বেড়েছে। অনেক শিক্ষার্থী ছাত্রলীগ করতে চায়। শুরুর দিকে তাদের চিহ্নিত করা সম্ভব হয় না। আর একটা কথা আছে, চোরা না শুনে ধর্মের কাহিনি। অনেকে সুযোগের সন্ধানে থাকেন। তাই এমন ঘটনা ঘটে।'

'অনেক নেতাই আছেন যারা ছাত্রলীগকে নিজেদের স্বার্থে, নিজেদের হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করেন। এটা অস্বীকার করার কোনো উপায় নেই। অনেকে কমিটি নিয়ে পাগল হয়ে যায়। যারা পাগল হয়ে যায়, তারা কোনো খারাপ উদ্দেশ্যে ছাত্রলীগকে ব্যবহার করার জন্য পাগল হয়। সর্বোপরি আমাদের সমাজ কাঠামো ঠিক করতে পারলে, রাজনীতির মূলমন্ত্র দেশের মানুষের জন্য কাজ করা, তা বাস্তবায়ন করতে পারলে, এমন নেতিবাচক কোনো ঘটনা ঘটবে না। আমাদের সেদিকেই বেশি ভাবতে হবে, যোগ করেন তিনি'

এ বিষয়ে কথা বলতে কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগের সভাপতি আল নাহিয়ান খান ও সাধারণ সম্পাদক লেখক ভট্টাচার্যকে ২ বার করে ফোন করলেও তারা ধরেননি। ক্ষুদেবার্তা পাঠালেও তারা জবাব দেননি।

Comments