যে কারণে ইউক্রেনে ভয়াবহ ক্ষেপণাস্ত্র হামলা করছে রাশিয়া

শোধ তুলতেই যে ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধের ভয়াবহতম হামলাটি মস্কো চালিয়েছে, তা নিশ্চিত করেন রুশ প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন নিজেই। রয়টার্স ফাইল ছবি

ক্রিমিয়া-রাশিয়া সেতুতে বিস্ফোরণের পর ইউক্রেনের রাজধানী কিয়েভসহ দেশটির গুরুত্বপূর্ণ শহরগুলোতে আজ সোমবার ব্যাপক ক্ষেপণাস্ত্র হামলা চালিয়েছে রাশিয়া। যুদ্ধ শুরুর পর এটিই ইউক্রেনে চালানো সবচেয়ে তীব্র রুশ হামলা। এতদিন ধরে বিভিন্ন সময় ক্ষেপণাস্ত্র হামলা চললেও সেগুলোর মাত্রা এত বেশি ছিল না। 'নানামুখী চাপের মধ্যে থাকা' রুশ প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন ইউক্রেনে এত বড় আকারে হামলা চালানোর সিদ্ধান্ত কেন নিলেন, তা উঠে এসেছে আন্তর্জাতিক বিভিন্ন গণমাধ্যমে।  

 

কতটা ভয়াবহ ছিল হামলা

আজ স্থানীয় সময় সকাল থেকে এখন পর্যন্ত দেশজুড়ে ৮৩টি ক্ষেপণাস্ত্র আঘাত হেনেছে বলে জানিয়েছে ইউক্রেন। কিয়েভ ছাড়াও ব্যাপক ক্ষেপণাস্ত্র হামলা চালানো হয়েছে লিভিভ, দিনিপ্রো, ঝাপোরিঝঝিয়া শহরে। ইউক্রেনের পুলিশের বরাত দিয়ে রয়টার্স জানিয়েছে, ক্ষেপণাস্ত্রের আঘাতে অন্তত ১০ জন নিহত হয়েছেন। আহত হয়েছেন অন্তত ৬০ জন। হামলায় কিয়েভের গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনাও ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। অনেক অঞ্চলে বিদ্যুৎ সংযোগ বিচ্ছিন্ন হয়েছে বলে খবর পাওয়া গেছে।

ইউক্রেনজুড়ে এখন আতঙ্ক আর কালো ধোঁয়া। একাধারে চলা হামলা এখানেই আপতত শেষ, নাকি আবারও চলবে তা নিয়ে উদ্বিগ্ন এখন ইউক্রেন। কিয়েভ প্রশাসনের অফিসিয়াল টেলিগ্রাম চ্যানেলের বরাত দিয়ে বিবিসি জানিয়েছে, কিয়েভে আবারও বিমান হামলার সাইরেন বাজছে। শহরটির মেয়র ভিতালি ক্লিতসকো বাসিন্দাদের সুরক্ষা ব্যবস্থা পর্যবেক্ষণ করতে এবং পানি ও খাবার মজুদ রাখার অনুরোধ জানিয়েছেন।

রয়টার্স জানিয়েছে, ভয়াবহ এই রুশ হামলা নিয়ে ইতোমধ্যে উদ্বেগ প্রকাশ করেছে আন্তর্জাতিক অঙ্গন। বিভিন্ন দেশ ও জোটের পক্ষ থেকে নিন্দা জানানো হয়েছে।

ন্যাটো জোটের মহাসচিব জেনস স্টলটেনবার্গ টুইটে বলেছেন, 'আমি ইউক্রেনের পররাষ্ট্রমন্ত্রী দিমিত্রো কুলেবার সঙ্গে কথা বলেছি এবং ইউক্রেনের বেসামরিক অবকাঠামোতে রাশিয়ার ভয়াবহ ও নির্বিচার হামলার নিন্দা জানিয়েছি। যতদিন দরকার হবে ততদিনই ন্যাটো ক্রেমলিনের আগ্রাসনের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে ইউক্রেনের সাহসী জনগণকে সমর্থন দেওয়া অব্যাহত রাখবে।'

কিয়েভে রাশিয়ার ক্ষেপণাস্ত্র হামলার পর আগুনে পুড়ছে কয়েকটি গাড়ি। ছবি: রয়টার্স

এদিকে যুক্তরাজ্যের প্রধানমন্ত্রী লিজ ট্রাসের মুখপাত্রের বরাত দিয়ে রয়টার্স জানিয়েছে, রুশ ক্ষেপণাস্ত্র হামলার একদিন পর আগামীকাল মঙ্গলবার ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট ভলোদিমির জেলেনস্কির সঙ্গে আলোচনা করবেন শীর্ষ ধনী দেশগুলোর জোট জি-৭ নেতারা।

এদিকে পুতিন স্পষ্টভাবে বলেছেন, এ হামলাই শেষ হামলা নয়। রাশিয়ার ওপর হুমকি এলে, ফের এমন তীব্র হামলা চালিয়ে জবাব দেওয়া হবে।   

হামলার নেপথ্যে  

২০১৪ সালে মস্কোর সঙ্গে ক্রিমিয়া সংযুক্ত হওয়ার ৪ বছর পর ২০১৮ সালে রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন ক্রিমিয়া ও রাশিয়ার মধ্যে সংযোগ স্থাপনকারী সেতু উদ্বোধন করেন। বিবিসির প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, রাশিয়া সেতুটি ব্যবহার করে সামরিক সরঞ্জাম, গোলাবারুদ ও কর্মীদের রাশিয়া থেকে দক্ষিণ ইউক্রেনের যুদ্ধক্ষেত্রে নিয়ে যাওয়ার জন্য।

পুতিনের ৭০ তম জন্মদিনের একদিন পর গত ৮ অক্টোবর এই সেতুতে শক্তিশালী ট্রাক বিস্ফোরণ ঘটে। বিস্ফোরণে সেতুর একাংশ ধসে পড়ে। এ ঘটনায় অন্তত ৩ জন নিহত হয়। সরাসরি এ হামলার দায় স্বীকার না করলেও ইউক্রেন সরকার ও সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা এ ঘটনায় উচ্ছ্বাস প্রকাশ করে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে পোস্ট দিতে থাকেন।

ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট ভলোদিমির জেলেনস্কির উপদেষ্টা মাইখাইলো পোদোলিয়াক লিখেন, 'ক্রিমিয়া, সেতু ও শুরু। অবৈধ সবকিছু ধ্বংস করতে হবে, চুরি হওয়া সবকিছু ইউক্রেনে ফেরত দিতে হবে, রাশিয়ার দখলকৃত সবকিছু অবশ্যই হটাতে হবে।'

ক্রিমিয়া-রাশিয়া সংযোগ সেতুতে বিস্ফোরণকে ‘সন্ত্রাসী হামলা’ হিসেবে উল্লেখ করেছে রাশিয়া। ক্ষেপণাস্ত্র হামলার পর কিয়েভ থেকে তোলা হয়েছে ছবিটি। ছবি: রয়টার্স

ইউক্রেনের প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয় সেতুতে বিস্ফোরণকে এপ্রিলে রাশিয়ার মস্কভা ক্ষেপণাস্ত্র ক্রুজার ডুবে যাওয়ার সঙ্গে তুলনা করে। প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের টুইটে বলা হয়, 'ইউক্রেনের ক্রিমিয়াতে রাশিয়ান শক্তির ২টি কুখ্যাত প্রতীক হারিয়ে গেছে। লাইনে এরপর কোনটা?' ইউক্রেন সরকারও এ ঘটনা নিয়ে ব্যঙ্গ করে টুইট করে।

যদিও রাশিয়া সেতুটির ক্ষয়ক্ষতি তেমন গুরুতর নয় বলে দাবি করে এবং ওইদিনই সেতুটি রেল ও যান চলাচলের জন্য খুলে দেওয়ার ঘোষণা দেয়। পরে খুলেও দেওয়া হয় সেতুটি।

তবে ইউক্রেনের এমন প্রতিক্রিয়ায় রাশিয়ার পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় তখন বলে, 'বেসামরিক অবকাঠামো ধ্বংসের বিষয়ে কিয়েভ সরকারের প্রতিক্রিয়া তাদের সন্ত্রাসী মনোভাবের প্রমাণ।'

রাশিয়া এ হামলার শোধ নেবে কি না, বা নিলে কীভাবে-তা নিয়ে চলছিল আলোচনা। যদিও পুতিনের 'সবচেয়ে পছন্দের সেতু'তে হামলার প্রতিক্রিয়ায় তিনি 'গালভরা বুলি' দিয়েছেন বলে পশ্চিমের সংবাদমাধ্যমে প্রচার করা হয়। সামরিক বিশেষজ্ঞদের অনেকে মন্তব্য করেন, 'পুতিনের এ হামলার জবাব দেওয়ার সক্ষমতা নেই।'

এরপরই পুতিনের নির্দেশে ইউক্রেনে আজ ভয়াবহ হামলাটি চালায় রাশিয়া।

প্রতিশোধ নিতেই হামলা, হতে পারে আবারও  

ক্রিমিয়া-রাশিয়া সংযোগ সেতুতে বিস্ফোরণের শোধ তুলতেই যে ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধের ভয়াবহতম হামলাটি মস্কো চালিয়েছে, তা নিশ্চিত করেন পুতিন নিজেই।

রয়টার্স ও রুশ সংবাদমাধ্যম আরটির প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, আজ রাশিয়ার নিরাপত্তা পরিষদের একটি বৈঠকের উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে পুতিন বলেন, ক্রিমিয়া-রাশিয়া সেতুর মতো আরও কোনো হামলা হলে কিয়েভকে কঠোর জবাব দেওয়া হবে। ইউক্রেন যদি রাশিয়ার বিরুদ্ধে আরও 'সন্ত্রাসী হামলা' করে তাহলে আজ রাশিয়া যেমন প্রতিক্রিয়া জানিয়েছে, তেমন সামরিক প্রতিক্রিয়া জানানো হবে।

হামলার পর ধোঁয়ায় ঢেকে যায় কিয়েভ। ছবি: রয়টার্স

তিনি আরও বলেন, 'আজ সকালে প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের পরামর্শে এবং রুশ জেনারেল স্টাফদের পরিকল্পনা অনুসারে ইউক্রেনের জ্বালানি, সামরিক কমান্ড ও যোগাযোগ ব্যবস্থার ওপর দূরপাল্লার বায়ু, সমুদ্র এবং স্থল-ভিত্তিক অস্ত্র দিয়ে বড় ধরনের হামলা চালানো হয়েছে।'

'আমাদের ভূখণ্ডে সন্ত্রাসী হামলা চালানোর প্রচেষ্টা অব্যাহত থাকলে রাশিয়া কঠোরভাবে এবং এবং রাশিয়ার বিরুদ্ধে তৈরি হওয়া হুমকির সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ প্রতিক্রিয়া জানাবে। এ বিষয়ে কেউ কোনো সন্দেহই রাখবেন না', যোগ করেন তিনি।

পুতিনের এ কথা থেকে স্পষ্ট, হামলা বা হুমকিতে পড়লে এ ধরনের হামলা আবারও চালাতে পিছপা হবে না রাশিয়া।

কোন পথে পুতিন ও যুদ্ধ  

বিভিন্ন আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমের তথ্যমতে, সময়টা এমনিতেই তেমন অনুকূলে নেই রুশ প্রেসিডেন্টের। অতি সম্প্রতি ইউক্রেনীয় সেনাদের পাল্টা হামলায় দখলকৃত দেশটির পূর্বাঞ্চলের বেশ কয়েকটি এলাকা থেকে মস্কো নিজেদের সেনা সরিয়ে নিতে বাধ্য হয়েছে। এ ছাড়াও, নিজ দেশে রিজার্ভ সেনাদের প্রস্তুত থাকার নির্দেশ দিয়েছেন পুতিন।

আন্তর্জাতিক গণমাধ্যম সূত্রে জানা গেছে, প্রেসিডেন্ট পুতিনের এসব সিদ্ধান্ত তাকে নিজ দেশে 'অ-জনপ্রিয়' করে তুলেছে। আরও বেশি 'একা' হয়ে পড়েছেন তিনি। পুতিনবিরোধী বিক্ষোভের সংবাদ প্রকাশিত হয়েছে। সেখানে অনেকে গ্রেপ্তারও হয়েছেন। রুশ নাগরিকরা দেশ ছেড়ে প্রতিবেশী দেশগুলোয় আশ্রয় নিচ্ছেন বলেও সংবাদ প্রকাশিত হয়েছে।

এমন পরিস্থিতিতে গত ৮ অক্টোবর রাশিয়ার দখল করা ক্রিমিয়া উপদ্বীপকে মূল ভূখণ্ডের সঙ্গে যুক্ত করা বহুল আলোচিত সেতুতে ভয়াবহ বিস্ফোরণ পুতিনের নেতৃত্বকে আরও চ্যালেঞ্জের মুখে ফেলে দেয়। আশঙ্কা করা হচ্ছে— নতুন নতুন ইউক্রেনীয় হামলা ক্রেমলিনকে আরও নাজুক পরিস্থিতিতে ফেলতে পারে।

গতকাল রোববার আল-জাজিরার 'পুতিন ইজ ফাইটিং অ্যালোন' শিরোনামের মতামতে প্রেসিডেন্ট পুতিনের ক্রমশ 'নিঃসঙ্গ' হয়ে পড়ার চিত্র তুলে ধরা হয়েছে।

এতে বলা হয়েছে, যাদেরকে প্রেসিডেন্ট পুতিনের মিত্র হিসেবে গণ্য করা হয় তাদেরকে ইউক্রেন যুদ্ধে এখন আর এই রুশ নেতার 'পাশে' দেখা যাচ্ছে না।

যুদ্ধক্ষেত্রে পুতিন যখন 'সাফল্য' দেখাতে পারছেন না, তখন তিনি কর্নেল জেনারেল সের্গেই সুরোভিকিনকে ইউক্রেন যুদ্ধে নতুন কমান্ডার হিসেবে নিয়োগ দিয়েছেন। সুরোভিকিনের রয়েছে ১৯৮০-র দশকে আফগানিস্তান ও ১৯৯০-র দশকে চেচনিয়া যুদ্ধের অভিজ্ঞতা। 'নিষ্ঠুরতার জন্য' এই জেনারেলের পরিচিতি আছে বলেও সংবাদমাধ্যম সূত্রে জানা গেছে। কিছু বিশ্লেষকের মতে, সুরোভিকিনকে নিয়োগ দেওয়া এটাই নির্দেশ করে, রাশিয়া বিচ্ছিন্নভাবে আক্রমণ না চালিয়ে একটিমাত্র অঞ্চলকে লক্ষবস্তু হিসেবে নির্ধারণ করে হামলা চালাবে।

সুইস মিলিটারি রিভিউর আলেক্সান্দ্রে ভট্রাভার্স বলেন, 'এটা লুহানস্ক হতে পারে, দনেৎস্ক হতে পারে, কিংবা হতে পারে আরও দক্ষিণের কোনো অঞ্চল। বস্তুত, আমরা যা দেখতে পাচ্ছি, তা হল, রুশ অভিযানের আওতা কমিয়ে আনা হচ্ছে।'

সুরোভিকিনের মাধ্যমে রাশিয়া চলমান যুদ্ধে কতটা সুবিধা করতে পারবে তা সময়ই বলে দেবে। তবে আজ এই ভয়াবহ হামলার পর অনেক বিশ্লেষক বলছেন, হয়তো 'নির্দয়' সুরোভিকিনের হাত ধরে যুদ্ধের মোড় ঘুরতেও পারে।

 

Comments

The Daily Star  | English
violence-against-women

Provost to nightguard: Different faces, same disregard for women

The widespread unrest at Chittagong University and adjacent villages where students and villagers clashed with each other for the better part of a day, had begun with a nightguard assaulting a female student who had returned to her mess, reportedly at 11:00pm

31m ago