কর অব্যাহতি ও রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকে আমলা কমানোর সুপারিশ আইএমএফের
সফররত আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) প্রতিনিধিদল এখন পর্যন্ত ৪ দশমিক ৫ বিলিয়ন ডলার ঋণ দেওয়ার জন্য যেসব শর্তের কথা বলেছে, তার মধ্যে নতুন বা আমাদের জানা ছিল না, এমন কিছুই নেই বলেই বলা যায়।
১৫ দিনের ঢাকা সফরের দ্বিতীয় দিনে আইএমএফের প্রতিনিধিদল গতকাল জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের সঙ্গে দিনব্যাপী বৈঠক করেছে।
বৈঠকে প্রতিনিধিদল কর অব্যাহতি কমাতে বলেছে, যার মধ্যে আছে কর দেওয়ার বাধ্যবাধকতা থেকে পূর্ণ অব্যাহতি, হ্রাসকৃত হারে কর দেওয়া বা কিছু উপকরণের ওপর আংশিক কর দেওয়ার মতো সুবিধা।
ইতোমধ্যে সংশ্লিষ্ট সবার জানা আছে যে, বাংলাদেশে অনেক বেশি কর অব্যাহতি দেওয়া হয়, যা দীর্ঘমেয়াদে টেকসই কৌশল নয় এবং এর ওপর রাশ টেনে ধরার প্রয়োজনীয়তা সম্পর্কেও কারও মনে কোনো দ্বিধা নেই।
তবুও, এই সমস্যার বিষয়ে সবাই অবগত থাকলেও বিগত বছরগুলোতে এর সমাধানে তেমন কোনো উদ্যোগ নেওয়া হয়নি।
এ প্রসঙ্গে সবচেয়ে খারাপ বিষয় হচ্ছে যে সরকারের কোনো ধারণাই নেই এই তথাকথিত বদান্যতার কারণে ঠিক কী পরিমাণ অর্থ থেকে রাজকোষ বঞ্চিত হচ্ছে।
পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউট অব বাংলাদেশের (পিআরআই) নির্বাহী পরিচালক আহসান এইচ মনসুর বলেন, 'একটি নিয়মতান্ত্রিক প্রাক্কলন থাকা উচিত— যা আমাদের নেই।'
বেশ কিছুদিন আগে পিআরআই এ বিষয়ে একটি সমীক্ষা করে জানতে পেরেছে, প্রতি বছর এই খাতে ৪০ হাজার কোটি টাকা খরচ হচ্ছে। এই পরিমাণ খুব সহজেই ৬০ হাজার কোটি হতে পারে।
আইএমএফের সাবেক অর্থনীতিবিদ আহসান মনসুর বলেন, 'যেহেতু কোনো বেজলাইন প্রাক্কলন নেই, আমরা জানি না কী অবস্থায় আছি।'
গতকালের আলোচনার সঙ্গে সংশ্লিষ্টদের কাছ থেকে দ্য ডেইলি স্টার জানতে পেরেছে, ১০ সদস্য বিশিষ্ট আইএমএফের প্রতিনিধিদলটি এনবিআরকে প্রাক্কলনের কাজটি করার সুপারিশ করেছে।
বিশ্ব ব্যাংকের ঢাকা কার্যালয়ের সাবেক শীর্ষ অর্থনীতিবিদ জাহিদ হোসেন বলেন, 'এটা পুরনো ব্যাপার। এখন প্রশ্ন হলো, কে, কী করবে এবং কখন করবে।'
এই আলোচনার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট কয়েকজন নাম প্রকাশ না করার শর্তে ডেইলি স্টারকে কিছু তথ্য জানান। তারা জানান, এনবিআরের কর অব্যাহতির পরিমাণ কমানোর বিষয়ে অনীহা রয়েছে। কারণ কর অব্যাহতি মোট দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) প্রবৃদ্ধিকে গতিশীল করে।
আইএমএফের প্রতিনিধিরা একইসঙ্গে এনবিআরকে রাজস্ব আয় বাড়াতে অনুরোধ করেছে, যেটি দীর্ঘদিন ধরে বাংলাদেশের অর্থনীতির সবচেয়ে দুর্বল জায়গা।
বাংলাদেশে কর বনাম জিডিপি অনুপাত ১০ শতাংশেরও কম, যেটি বিশ্বের সবচেয়ে কম অনুপাতগুলোর মধ্যে একটি। তা সত্ত্বেও এ পরিস্থিতির উন্নয়নের জন্য তেমন কোনো উদ্যোগই নেওয়া হয়নি।
আইএমএফ এনবিআরের কাছে রাজস্ব আদায় পরিস্থিতি উন্নয়নের জন্য একটি দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা চেয়েছে।
প্রতিনিধিদলটি এনবিআরের নেওয়া বিভিন্ন সংস্কার কর্মসূচির ফলাফল নিয়ে একটি হালনাগাদ প্রতিবেদন চেয়েছে। বিশেষ করে কর প্রশাসনের অটোমেশনের বিষয়টি তারা উল্লেখ করেছে।
অর্থনীতিবিদ মনসুর বলেন, 'কোনো কিছুরই সংস্কার হয়নি। এ ধরনের সব উদ্যোগ ব্যর্থ হয়েছে। এনবিআরের সংস্কারে কোনো আগ্রহ নেই। আপনারা যদি সংস্কারের ওপর জোর দিতে বলেন, তাহলে তারা আরও জনবল চায়; যদিও তাদের যথেষ্ট জনবল রয়েছে।'
ওয়াশিংটন-ভিত্তিক ব্যাংকিং প্রতিষ্ঠান আইএমএফ অটোমেশন প্রক্রিয়া চালুর গতি বাড়াতে বলেছে, যে বিষয়টি দীর্ঘদিন ধরে স্থবির হয়ে আছে।
জাহিদ হোসেনের ভাষ্য, 'কোনো সংস্কারের মাধ্যমেই চূড়ান্ত লক্ষ্য অর্জন সম্ভব নয়।'
২০১২ ও ২০১৭ সালে যথাক্রমে শুল্ক আইন ও আয়কর আইন সংশোধনের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছিল। আইএমএফ এ ২টি বিষয়েও সর্বশেষ তথ্য জানতে চায়। এনবিআর কর্মকর্তারা উত্তরে জানান, এই ২টি আইনের সংশোধিত খসড়া সংসদে অনুমোদনের অপেক্ষায় রয়েছে।
প্রতিনিধিদলটি অর্থ মন্ত্রণালয়ের ব্যাংকিং বিভাগ ও বাংলাদেশ ব্যাংকের সঙ্গে বৈঠকে একই ধরনের প্রসঙ্গের অবতারণা করে।
তারা খেলাপি ঋণের পরিমাণ কমানোর জন্য একটি কৌশল-নথি তৈরির দাবি জানান। এটিও বাংলাদেশের অর্থনীতির একটি দীর্ঘদিনের সমস্যা। পাশাপাশি, প্রতিনিধিরা ব্যাংক কোম্পানি আইনসহ আর্থিক খাতের ৫টি আইনের সংশোধনের বিষয়ে সর্বশেষ তথ্য জানতে চান।
আইএমএফ ইতোমধ্যে বেশ কয়েকবার বাজারের ওঠা-নামার ভিত্তিতে বিদেশি মুদ্রার বিনিময় মূল্য নির্ধারণ, সুদের হারের ক্ষেত্রে সর্বোচ্চ সীমা প্রত্যাহার ও বৈদেশিক মুদ্রার গ্রস রিজার্ভ প্রকাশের চর্চা বন্ধ করার সুপারিশ করেছে।
জাহিদ হোসেন বলেন, 'এসব সমস্যার কথা সবাই জানেন। সরকার চাইলেই এ বিষয়গুলোর পরিবর্তনের উপায় খুঁজে বের করতে পারে।'
প্রতিনিধিদলটি রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকের বোর্ডে আমলার সংখ্যা কমানোর এবং বাংলাদেশ ব্যাংকের স্বায়ত্তশাসন নিশ্চিত করার আহ্বান জানিয়েছে।
একইসঙ্গে ব্র্যাক ব্যাংকের চেয়ারম্যানের দায়িত্বে থাকা আহসান এইচ মনসুর বলেন, 'স্বায়ত্তশাসনের তো দূরে থাক, কেন্দ্রীয় ব্যাংকের গভর্নররা তাদের হাতে থাকা ক্ষমতারও পূর্ণ সদ্ব্যবহার করেন না।'
প্রাথমিকভাবে ৬ মাস পর পর বছরে ২ বার মুদ্রানীতি ঘোষণা এবং ক্রমান্বয়ে তা বাড়িয়ে বছরে ৪ বার করার পরামর্শ দিয়েছে আইএমএফ প্রতিনিধিরা।
বাংলাদেশ ব্যাংকের কর্মকর্তারা আইএমএফকে জানায়, বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো (বিবিএস) ৩ মাস পর পর জিডিপির হালনাগাদ তথ্য প্রকাশ করতে পারলেই বছরে ৪ বার মুদ্রানীতি ঘোষণা করা সম্ভব হবে।
দলটি মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে কী কী উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে, সে বিষয়েও জানতে চায়। উল্লেখ্য, আগস্টে গত ১২ বছরের মধ্যে মূল্যস্ফীতির পরিমাণ সর্বোচ্চ ৯ দশমিক ৫ শতাংশে পৌঁছায়।
বাংলাদেশ ব্যাংকের কর্মকর্তাদের মতে, অদূর ভবিষ্যতে মূল্যস্ফীতির পরিমাণ ৯ থেকে ১০ শতাংশের মধ্যেই থাকবে।
অনুবাদ করেছেন মোহাম্মদ ইশতিয়াক খান
Comments