বিশ্বের শীর্ষ পারমাণবিক শক্তিধর দেশ

বিশ্বের পারমাণবিক শক্তিধর দেশগুলো
বিশ্বের পারমাণবিক শক্তিধর দেশগুলোর কার কাছে কত অস্ত্র আছে। ছবি: স্টার গ্রাফিক্স

একটি দেশের সামরিক শক্তি পরিমাপের অন্যতম মানদণ্ড এখন সে দেশের অস্ত্রাগারে থাকা পারমাণবিক অস্ত্রের সংখ্যা। বর্তমানে বিশ্বে বেশ কয়েকটি দেশের কাছে প্রায় ১৩ হাজার ৮০ পারমাণবিক অস্ত্র রয়েছে বলে জানা যায়।

তবে পারমাণবিক অস্ত্র মজুদের শীর্ষে আছে রাশিয়া ও যুক্তরাষ্ট্র। এ ছাড়াও, চীন, ফ্রান্স, যুক্তরাজ্য, পাকিস্তান, ভারত, ইসরায়েল ও উত্তর কোরিয়াসহ ৯ দেশের কাছে পারমাণবিক অস্ত্র আছে।

স্নায়ুযুদ্ধের সময় শুধু যুক্তরাষ্ট্র বা রাশিয়ার কাছে মজুদ পারমাণবিক অস্ত্রের সংখ্যাই ছিল বর্তমান বিশ্বের মোট পারমাণবিক অস্ত্রের সংখ্যার চেয়ে অনেক বেশি। সে সময় এই ২ দেশের কাছে ছিল প্রায় ৬৫ হাজার পারমাণবিক অস্ত্র।

তবে এ কথা ঠিক যে, ৩০-৪০ বছর আগের চেয়ে এখন অনেকে বেশি সংখ্যক দেশের কাছে পারমাণবিক অস্ত্র আছে। আগে মোট অস্ত্রের সংখ্যা বেশি থাকলেও বর্তমানে অস্ত্রধারী দেশের সংখ্যা বেড়েছে এবং বর্তমান বিশ্বের মোট পারমাণবিক অস্ত্রের প্রায় ৯০ শতাংশ আছে যুক্তরাষ্ট্র ও রাশিয়ার কাছে।

বর্তমান বিশ্বে পারমাণবিক শক্তিধর দেশগুলো নিয়ে আজকের আলোচনা।

রাশিয়ার কাছে বর্তমানে ৫ হাজার ৯৭৭ পারমাণবিক অস্ত্র আছে। ছবি: রয়টার্স

রাশিয়া

পারমাণবিক অস্ত্রের হিসাব সব সময় অনুমানভিত্তিক হয়ে থাকে। তবে ফেডারেশন অব আমেরিকান সায়েন্টিস্টের তথ্য অনুসারে, রাশিয়ার কাছে বর্তমানে ৫ হাজার ৯৭৭ পারমাণবিক অস্ত্র আছে, যা যে কোনো দেশের চেয়ে বেশি। এই অস্ত্রগুলোর মাধ্যমে বিশাল আকারের বিস্ফোরণ ঘটানো সম্ভব।

তবে এগুলোর মধ্যে ১ হাজার ৫০০ অস্ত্র বর্তমানে অকার্যকর এবং দ্রুতই হয়তো সেগুলো ধ্বংস করা হতে পারে। বাকি ৪ হাজার ৫০০ অস্ত্রের মধ্যে বেশিরভাগই ব্যালিস্টিক মিসাইল বা রকেট। যেগুলো দিয়ে অনেক দূর পর্যন্ত নিশানা করা সম্ভব।

এগুলোর মধ্যে ১ হাজার ৫৮৮ অস্ত্র বর্তমানে নানান স্থানে মোতায়েন রাখা রয়েছে। এই অস্ত্রগুলো রাখা হয়েছে মূলত সম্ভাব্য পারমাণবিক যুদ্ধের প্রস্তুতি হিসেবে।

রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন একাধিকবার বলেছেন, কখনো আক্রান্ত হলে রাশিয়া যথাসাধ্য উপায়ে নিজের সীমানা রক্ষা করবে এবং এতে পারমাণবিক অস্ত্রও অন্তর্ভুক্ত থাকবে।

পারমাণবিক অস্ত্রের সংখ্যায় বিশ্বে দ্বিতীয় অবস্থানে রয়েছে যুক্তরাষ্ট্র। ছবি: সংগৃহীত

যুক্তরাষ্ট্র

বিশ্বের যেকোনো ধরনের সক্ষমতার কথা বলা হলে তালিকার শীর্ষে থাকে যুক্তরাষ্ট্র। সামরিক ক্ষেত্রে, বিশেষ করে পারমাণবিক সক্ষমতার ক্ষেত্রেও এর ব্যতিক্রম নয়।

২০১০ থেকে ২০১৮ সালের মধ্যে যুক্তরাষ্ট্র মজুদ করা পারমাণবিক অস্ত্রের কথা জনসমক্ষে প্রকাশ করলেও ট্রাম্প সরকার আসার পর এ চর্চা থেমে যায়। পরবর্তীতে জো বাইডেন রাষ্ট্রপতি হওয়ার পর পারমাণবিক অস্ত্র সংক্রান্ত স্বচ্ছতা পুনর্বহাল করা হয়।

বিবিসির প্রতিবেদনে জানা যায়, বর্তমানে যুক্তরাষ্ট্রের পারমাণবিক অস্ত্রের সংখ্যা ৫ হাজার ৪২৮ এবং সংখ্যার দিক থেকে এ দেশে বিশ্বের দ্বিতীয় সর্বোচ্চ সংখ্যক অস্ত্র আছে।

বর্তমানে পারমাণবিক অস্ত্রের হিসাবে রাশিয়ার চেয়ে কিছুটা নিচে যুক্তরাষ্ট্র। দেশটি পারমাণবিক অস্ত্র মজুদ কমানোর প্রবণতা দেখালেও নানানভাবে নিজেদের শক্তি বৃদ্ধিতে থেমে নেই। যুক্তরাষ্ট্রের পারমাণবিক অস্ত্রের মজুদে এফ-৩৫, বি১-১২ বোমা ও ক্রুজ মিসাইল আছে। এগুলোর মাধ্যমে দেশটি প্রতিরোধ ব্যবস্থা আরও শক্তিশালী করেছে। এই অস্ত্রগুলো নতুন সংযুক্তি।

এ বিষয়ে রাশিয়ার উপপররাষ্ট্রমন্ত্রী আলেক্সান্ডার গ্রুশকো রয়টার্সকে জানিয়েছেন, এই উদ্যোগের মাধ্যমে যুক্তরাষ্ট্র নিজেদের পারমাণবিক শক্তির পরিমাণ কমিয়ে এনে সেগুলোকে যুদ্ধক্ষেত্রের অস্ত্রে পরিণত করছে।

চীনের কাছে রয়েছে ৩৫০টি পারমাণবিক অস্ত্র। ছবি: এপি

চীন

১৯৫১ সালে মস্কোর সঙ্গে গোপন চুক্তি স্বাক্ষরের মাধ্যমে পারমাণবিক অস্ত্রের পথে যাত্রা শুরু করে চীন। সে সময় চীনকে পারমাণবিক প্রযুক্তিতে সহায়তা করে সোভিয়েত ইউনিয়ন। এর বদলে চীন রাশিয়াকে ইউরেনিয়ামের আকরিক সরবরাহ করে।

ওই দশকের শেষের দিকে চীন বেশ সক্রিয়ভাবে পারমাণবিক অস্ত্র তৈরি শুরু করে। তবে আপাতত চীনে কোনো মোতায়েন করা ক্ষেপণাস্ত্র নেই। চীনের কাছে থাকা ৩৫০ অস্ত্রই সংরক্ষিত আছে। এই অস্ত্রগুলো সরাসরি যুক্তরাষ্ট্রের মতো ক্ষমতাধর রাষ্ট্রের জন্য হুমকি না হলেও বিশ্ব নিরাপত্তাকে ঝুঁকিতে ফেলতে সক্ষম।

বিশ্বের চতুর্থ পারমাণবিক শক্তিধর রাষ্ট্র ফ্রান্স। ছবি: এএফপি

ফ্রান্স

ফেডারেশন অব আমেরিকান সায়েন্টিস্টের সবশেষ হিসাব অনুসারে, ফ্রান্সের কাছে বর্তমানে সক্রিয় পারমাণবিক অস্ত্র রয়েছে ২৮০ ও অকার্যকর ১০টি। সব মিলিয়ে মোট ২৯০ অস্ত্র মজুদ আছে ফ্রান্সের কাছে। ২০১৮ সালেও এই সংখ্যা ছিল ৩০০।

চলতি বছরের শুরুতে রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট পুতিন যখন পারমাণবিক শক্তি প্রদর্শনে বিশ্ববাসীকে একপ্রকার হুমকি দেন, ফ্রান্সের পররাষ্ট্রমন্ত্রী তখন এর জবাবে বলেন, পুতিনকে খেয়াল রাখতে হবে ন্যাটোর কাছেও পারমাণবিক অস্ত্র আছে। এ থেকে অনুমেয়, নিজেদের পারমাণবিক অস্ত্রের মজুদ নিয়ে ফ্রান্স বেশ আত্মবিশ্বাসী অবস্থানে আছে।

যুক্তরাজ্যের পারমাণবিক অস্ত্রের সংখ্যা ২২৫টি।

যুক্তরাজ্য

পারমাণবিক অস্ত্র বিস্তার রোধ (এনপিটি) যুক্তির অধীনে থাকা ৫ রাষ্ট্রের একটি যুক্তরাজ্য। এই রাষ্ট্রের কাছে বর্তমানে ৪ ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্রযুক্ত সাবমেরিন আছে। তাদের সমুদ্রে পারমাণবিক অস্ত্র স্থাপনের যাত্রা ১৯৬৯ সাল থেকে অব্যাহত আছে। এ ছাড়াও, যুক্তরাজ্যের মোট মজুদকৃত পারমাণবিক অস্ত্রের সংখ্যা ২২৫, এর মধ্যে ১৮০টিই সামরিক।

গত ৭ নভেম্বর প্রকাশিত এক গবেষণাপত্রে ডেভিড ডি ক্লার্ক জানান, গ্রেট ব্রিটেনের প্রায় ৪২ শতাংশ নাগরিক তাদের ত্রিমুখী পারমাণবিক অস্ত্র ব্যবস্থাকে সমমানের শক্তিশালী অন্য ব্যবস্থা দিয়ে প্রতিস্থাপন করতে চায়। অন্যদিকে ১৬ শতাংশ নাগরিক সম্পূর্ণভাবে পারমাণবিক অস্ত্র থেকে মুক্তি চায়।

পাকিস্তানের কাছে মোট ১৬৫ পারমাণবিক অস্ত্র মজুদ আছে
পাকিস্তানের কাছে মোট ১৬৫ পারমাণবিক অস্ত্র মজুদ আছে।

পাকিস্তান

যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক অস্ত্র নিয়ন্ত্রণ সংস্থা বা এসিএর মতে, পাকিস্তানের পারমাণবিক অস্ত্রের মধ্যে অন্তত ৪টি স্বল্প পাল্লার ও ২টি মাঝারি পাল্লার ক্ষেপণাস্ত্র আছে।

এ ছাড়া, ৭ হাজার কিলোমিটার পাল্লার একটি আন্তঃমহাদেশীয় ক্ষেপণাস্ত্রসহ আরও কয়েকটি ক্ষেপণাস্ত্র তৈরির কাজ চলমান।

স্টকহোম আন্তর্জাতিক শান্তি গবেষণা অনুষদের ধারণা, পাকিস্তানের কাছে বর্তমানে প্রায় ১০০-১২০টি পারমাণবিক অস্ত্র রয়েছে যেগুলো স্থল ও আকাশ পথে ব্যবহার করা সম্ভব।

তবে ফেডারেশন অব আমেরিকান সায়েন্টিস্টের সবশেষ হিসাব অনুযায়ী, পাকিস্তানের কাছে মোট ১৬৫ পারমাণবিক অস্ত্র মজুদ আছে।

ভারতে মজুদ আছে ১৬০ পারমাণবিক অস্ত্র
ভারতে মজুদ আছে ১৬০ পারমাণবিক অস্ত্র

ভারত

পারমাণবিক অস্ত্রশক্তি বৃদ্ধি করে চলেছে—এমন দেশগুলোর মধ্যে ভারত অন্যতম। ফেডারেশন অব আমেরিকান সায়েন্টিস্টের সবশেষ হিসাব অনুযায়ী, ভারতে মজুদ আছে ১৬০ পারমাণবিক অস্ত্র।

প্রতিবেশী পাকিস্তানের সঙ্গে এর পার্থক্য খুব একটা বেশি নয়। ইতোমধ্যে ভারত ২টি আন্তঃমহাদেশীয় ক্ষেপণাস্ত্র তৈরি করেছে।

এ ছাড়াও, তাদের কাছে একটি মাঝারি পাল্লার ক্ষেপণাস্ত্র আছে। এসিএর তথ্য অনুসারে এর পাল্লা ৩ হাজার কিলোমিটারেরও বেশি।

পারমাণবিক অস্ত্রধারী মধ্যপ্রাচ্যের একমাত্র দেশ হচ্ছে ইসরায়েল
পারমাণবিক অস্ত্রধারী মধ্যপ্রাচ্যের একমাত্র দেশ ইসরায়েল।

ইসরায়েল

পারমাণবিক অস্ত্রধারী মধ্যপ্রাচ্যের একমাত্র দেশ হচ্ছে ইসরায়েল। বর্তমানে এই দেশের কাছে ৯০ পারমাণবিক অস্ত্র মজুদ আছে। বিমান থেকে নিক্ষেপ ছাড়াও অন্য পদ্ধতিতেও এই অস্ত্রগুলো ব্যবহার করা সম্ভব। এর মধ্যে সাবমেরিন থেকে ছোড়া যায় এমন ক্রুজ ক্ষেপণাস্ত্রও আছে।

ইসরায়েলের কাছে থাকা সব পারমাণবিক অস্ত্র ধ্বংস করে ফেলার পক্ষে জাতিসংঘের একটি অনুসিদ্ধান্তে ইসরায়েলের পক্ষে ভোট দেয় মাত্র ৫ দেশ। যেখানে ১৫২ দেশই ছিল এর বিরুদ্ধে।

এ ছাড়া, ইসরায়েলকে আন্তর্জাতিক পরমাণু শক্তি সংস্থা আইএইএর অধীনে আনার বিষয়েও আলোচনা হয়।

উত্তর কোরিয়ার কাছে আছে ২০ পারমাণবিক অস্ত্র।

উত্তর কোরিয়া

এই দেশটির কাছে আছে ২০ পারমাণবিক অস্ত্র। তবে কোনোটিই বর্তমানে মোতায়েন করা হয়নি। বর্তমানে দেশটি পরীক্ষা-নিরীক্ষা চালিয়ে পারমাণবিক অস্ত্রের মজুদকে সমৃদ্ধ করার চেষ্টা করছে।

উত্তর কোরিয়া এ বছর ৩৪ অস্ত্র পরীক্ষা করেছে। এর মধ্যে আছে ব্যালিস্টিক ও ক্রুজ ক্ষেপণাস্ত্র। চলতি নভেম্বরের একই দিনে উত্তর কোরিয়া অন্তত ২৩ ক্ষেপণাস্ত্র নিক্ষেপ করে। এর মধ্যে একটি দক্ষিণ কোরিয়ার পূর্ব উপকূল থেকে ৩৫ মাইল দূরে সমুদ্রে গিয়ে পড়ে। এর ফলে দ্বীপবাসীরা ভূগর্ভে আশ্রয় নিতে বাধ্য হন।

পারমাণবিক অস্ত্র তৈরির ক্ষমতা ও সম্ভাব্যতা আছে ইরানের।

ইরান

এ তালিকায় সবশেষ যে দেশের কথা এসেছে, সেটি হলো ইরান। উপসাগরীয় এই দেশটি অন্য ৯ দেশের মতো প্রতিষ্ঠিত পারমাণবিক শক্তিধর নয়। তবে তাদের কাছে পারমাণবিক অস্ত্র তৈরির ক্ষমতা ও সম্ভাব্যতা আছে।

দেশটির আণবিক শক্তি বিভাগের প্রধানের বক্তব্য অনুযায়ী, ইরানের অস্ত্র তৈরির কোনো পরিকল্পনা নেই। কিন্তু, এ কথা খুব একটা বিশ্বাসযোগ্য বলে মনে করে না অন্য রাষ্ট্রগুলো। অনেকের আশঙ্কা, ইরান যেকোনো সময় পারমাণবিক অস্ত্রের পথে যাত্রা শুরু করতে পারে।

ইরানে থাকা পরমাণু চুল্লিগুলোর কারণে পশ্চিমের গোয়েন্দারা সন্দেহ করছেন যে খুব শিগগিরই হয়তো ইরান পরমাণু অস্ত্রের মালিক হতে যাচ্ছে। এই সন্দেহের পালে বাতাস দেয় আন্তর্জাতিক পারমাণবিক শক্তি সংস্থার সদ্য প্রকাশিত এক প্রতিবেদন।

এ থেকে জানা যায়, ইরান ২০১৫ সালের পরমাণু চুক্তির মাধ্যমে নির্ধারিত ইউরেনিয়াম সংরক্ষণের সীমা পেরিয়ে গেছে। ইরানে ইউরেনিয়ামের মজুদ আনুমানিক ৩ হাজার ৯৪০ কিলোগ্রাম–যা কিনা চুক্তিতে নির্ধারিত সীমার ১৯ গুণ বেশি।

 

তথ্যসূত্র: বিবিসি, রয়টার্স, অ্যাটোমিক আর্কাইভ, স্ট্যাটিসটা ও ডয়চে ভেলে

 

Comments

The Daily Star  | English
cyber security act

A law that gagged

Some made a differing comment, some drew a political cartoon and some made a joke online – and they all ended up in jail, in some cases for months. This is how the Digital Security Act (DSA) and later the Cyber Security Act (CSA) were used to gag freedom of expression and freedom of the press.

7h ago