ঢাকা-নারায়ণগঞ্জ রুটে ট্রেন চলাচল বন্ধ, যাত্রী ভোগান্তি
পদ্মা সেতু রেল সংযোগ ও ঢাকা-নারায়ণগঞ্জ রেলপথ উন্নয়ন প্রকল্পের কাজের জন্য আজ রোববার থেকে ঢাকা-নারায়ণগঞ্জ রুটে ট্রেন চলাচল অনির্দিষ্টকালের জন্য বন্ধ রাখা হয়েছে। রেল কর্তৃপক্ষ বলছে, প্রকল্পের কাজ শেষ হতে অন্তত তিন থেকে সাড়ে তিন মাস লাগবে।
এদিকে ট্রেন চলাচল বন্ধ থাকায় প্রথমদিনেই এই রুটে যাতায়াতকারী যাত্রীরা পড়েছেন বিপাকে। অনেকেই ট্রেন চলাচল বন্ধের আগাম খবর না পাওয়ায় স্টেশনে এসেও বিকল্প পথে গন্তব্যে পৌঁছাতে হয়েছে।
নারায়ণগঞ্জের যাত্রী অধিকার সংরক্ষণ ফোরাম বলছে, প্রতিদিন অন্তত ৪০ হাজার মানুষ ঢাকা-নারায়ণগঞ্জ রুটে চলাচল করা ট্রেনে যাতায়াত করেন। সময় ও অর্থ সাশ্রয়ের জন্য ঢাকায় যাতায়াতের জন্য ট্রেনকে বেছে নেন যাত্রীরা। প্রকল্পের কাজ দ্রুত শেষ করে রেলপথটি চালু করার দাবি জানান তারা।
সরেজমিনে নারায়ণগঞ্জ কেন্দ্রীয় রেলস্টেশন ও চাষাঢ়া স্টেশনে ট্রেন চলাচল বন্ধের নোটিশ সাঁটানো দেখা যায়। ট্রেন চলাচল বন্ধের খবর না পাওয়ায় অনেকেই স্টেশনে এসে পরে বিকল্প বাহন খুঁজতে থাকেন।
বেলা সাড়ে ১২টার দিকে কাপড় ও সবজিভর্তি দুটি ব্যাগ হাতে নারায়ণগঞ্জ কেন্দ্রীয় রেলস্টেশনে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখা যায় মুন্সীগঞ্জের আব্দুল খালেককে। থাকেন ঢাকার গেন্ডারিয়ায়। কথা হলে তিনি দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, 'ট্রেনে কম খরচে যাওয়া যায়। জ্যামেরও চিন্তা থাকে না। স্টেশনে এসে জানলাম ট্রেন বন্ধ। এখন ভেঙে ভেঙে বাসে-লেগুনায় যাওয়া লাগবে। ট্রেনে লাগতো ১৫ টাকা আর এখন লাগবে ৬০-৭০ টাকা। ব্যাগ-ট্যাগ নিয়ে বাসে ওঠা-নামার পরিশ্রম তো আছেই।'
ট্রেন চলাচল বন্ধের খবর জানতেন না আব্দুর রহিমও। ঢাকার মতিঝিলে বেসরকারি একটি প্রতিষ্ঠানের চাকরিজীবী রহিম যানজট এড়াতে অধিকাংশ সময়ই ট্রেনে যাতায়াত করেন বলে জানান। দ্য ডেইলি স্টারকে তিনি বলেন, 'বাসে বা সড়কপথে অন্য বাহনে যাওয়ার ক্ষেত্রে যানজট তো আছেই। তার উপর মানুষের অর্থনৈতিক অবস্থা এমনিতেই খারাপ। যাতায়াতে অতিরিক্ত খরচ করার সুযোগ নেই। ঢাকায় যাওয়া প্রতিটা বাসের ভাড়া ৫০ থেকে ৫৫ টাকা। যেই জায়গায় ৩০ টাকায় ঢাকায় যাওয়া-আসা যেত, সেইখানে এখন লাগবে একশো টাকারও বেশি।'
'পদ্মা সেতুর রেল লাইন বলেন আর ঢাকা-নারায়ণগঞ্জ রুটে ডাবল রেল লাইনের কাজ বলেন, এইটা তো আজকের প্রকল্প না। করোনার সময় সবকিছু বন্ধ ছিল। তখনই তো এই কাজ সেরে ফেলা যেত। এখন তো তিন মাস বলছে, এইরকম কত তিন মাস যে লাগবে কাজ শেষ করতে তার কোনো ঠিক নাই। এর মধ্যে মানুষ থাকবে চরম ভোগান্তিতে,' ক্ষোভ ঝাড়েন আব্দুর রহিম।
নারায়ণগঞ্জ কেন্দ্রীয় রেলস্টেশনের কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, ঢাকা-নারায়ণগঞ্জ রুটে আগে ১৬ জোড়া ট্রেন চলাচল করলেও শনিবার পর্যন্ত ১০ জোড়া ট্রেন চলেছে। নারায়ণগঞ্জ রেলস্টেশন থেকেই প্রতিদিন ১০ হাজার টিকিট বিক্রি হয়। এছাড়া ঢাকার কমলাপুর পর্যন্ত আরও পাঁচটি স্টেশন আছে। সবমিলিয়ে দৈনিক বিশ হাজারেও বেশি মানুষ ট্রেনে যাতায়াত করেন। ট্রেনে যাতায়াতকারীদের মধ্যে অধিকাংশই চাকরিজীবী ও শিক্ষার্থী। করোনা পরিস্থিতি লকডাউনের সময় ছাড়া দীর্ঘ বছরেও এই রুটে এতদিন ট্রেন চলাচল কখনও বন্ধ থাকেনি।
নারায়ণগঞ্জের পাগলা নয়ামাটি এলাকার বাসিন্দা বৃষ্টি আক্তার ও স্নেহা। এই দুই কলেজ শিক্ষার্থী নিয়মিত ট্রেনে যাতায়াত করতেন বলে জানান। চাষাঢ়া রেলস্টেশনে কথা হলে তারা দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, প্রতিদিনই পাগলা থেকে ট্রেনে উঠতেন। শিক্ষার্থী হওয়াতে ভাড়া লাগতো না। ট্রেন বন্ধ থাকায় ব্যাটারিচালিত রিকশায় ভেঙে ভেঙে কলেজে আসতে হয়েছে।
বৃষ্টি আক্তার বলেন, 'পাগলা থেকে ট্রেনে উঠলে সরাসরি এসে চাষাঢ়া নামতাম। সেখান থেকে হেঁটে কলেজে যেতাম। আজকে ট্রেন বন্ধ থাকায় অটোতে (ব্যাটারিচালিত রিকশা) প্রথমে পঞ্চবটি, তারপর চাষাঢ়ায় আসছি। যাবোও একইভাবে।'
এদিকে রেল কর্তৃপক্ষ জানিয়েছে, পদ্মা সেতু রেল সংযোগ প্রকল্পের আওতায় ঢাকা থেকে গেন্ডারিয়া অংশে তিনটি পৃথক রেললাইনের নির্মাণকাজ ও ঢাকা-নারায়ণগঞ্জ রেলপথ উন্নয়ন প্রকল্পের কাজের জন্য রোববার থেকে ঢাকা-নারায়ণগঞ্জ রুটের ট্রেন চলাচল অনির্দিষ্টকালের জন্য বন্ধ থাকবে। কবে নাগাদ কাজ শেষ হবে সে বিষয়ে নির্দিষ্ট করে কিছু না জানালও অন্তত তিন থেকে সাড়ে তিন মাস ট্রেন চলাচল বন্ধ থাকবে বলে জানাচ্ছেন রেলওয়ে কর্মকর্তারা।
নারায়ণগঞ্জ কেন্দ্রীয় রেলস্টেশনের স্টেশন মাস্টার কামরুল ইসলাম খান দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, 'হেড অফিস থেকে নির্দিষ্ট কোনো সময় বলেনি। তবে প্রকল্পকাজ শেষ হতে অন্তত তিন থেকে সাড়ে তিন মাস তো লাগবেই। ট্রেনে স্বল্প আয়ের মানুষ চলাচল করে বেশি। ট্রেন বন্ধ থাকায় তাদের তো বিপাকে পড়তে হবেই। তবে রেল কর্তৃপক্ষ দ্রুততার সাথে কাজ শেষ করতে পারবে বলেই আশা করছি।'
এদিকে দীর্ঘ সময় এই রুটে ট্রেন চলাচল বন্ধ রাখার সিদ্ধান্তে উদ্বেগ জানিয়েছে যাত্রী অধিকার সংরক্ষণ ফোরাম। কোনো বিলম্ব না করে দ্রুততার সাথে প্রকল্পকাজ শেষ করে ব্যস্ততম এই রেলপথটি দ্রুত চালু করে দেওয়ার দাবি জানান সংগঠনের নেতারা।
ফোরামের আহ্বায়ক রফিউর রাব্বি দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, 'ঢাকা-নারায়ণগঞ্জ পথে প্রতিদিন প্রায় চল্লিশ হাজারের অধিক মানুষ যাতায়াত করেন। বাসের ভাড়া বৃদ্ধির ফলে ট্রেনকেই সাধারণ মানুষ এখন যাতায়াতের প্রধান বাহন হিসেবে বেছে নিয়েছেন। আজকে মানুষের জীবন-জীবিকা যখন চরম সংকটে, তখন রেল কর্তৃপক্ষের এ সিদ্ধান্ত মানুষের সংকটকে আরও বাড়িয়ে তুলবে। আমরা চাই, সাড়ে তিন মাসের পরিবর্তে আরও কম সময়ে কাজ সম্পন্ন করা হোক।'
Comments