যে কারণে ফেরারি এত দামি

যে কারণে ফেরারি এত দামি

বিশ্বব্যাপী বিত্তবানদের কাছে ফেরারি নামটি স্বপ্নের নাম। ক্রিকেট-ফুটবলে বিশ্বকাপ যেমন জনপ্রিয়, গাড়ি প্রতিযোগীদের কাছে ফর্মুলা ওয়ান ঠিক ততখাটাই জনপ্রিয়। আর এই ফর্মুলা ওয়ান প্রতিযোগিতার সঙ্গে যারা জড়িত, তাদের কাছে ফেরারি যেন এক দেবদূতের নাম।

ফেরারি কোনো সাধারণ গাড়ি না, যা একাধিক যাত্রীকে নিয়ে নিয়মিত চলাচলের জন্যে সচরাচর ব্যবহার করা হয়। ফেরারি একটি সুপারকার, যেটি তৈরির মূল উদ্দেশ্য থাকে সুপার-স্পিডে চলা। বর্তমানের ৭ দশমিক ৮ বিলিয়ন মার্কিন ডলার মার্কেট ভ্যালুর কোম্পানিটি মূলত রেসিংয়ের উদ্দেশ্যেই গাড়ি তৈরি করে। আর এই প্রতিষ্ঠানটি প্রতিষ্ঠার ইতিহাসের সঙ্গেও জড়িয়ে আছে রেসিং।

ঢাকার রাস্তায় প্রতিদিন অন্তত ৪০টি নতুন প্রাইভেটকার নামছে, বছর এই সখ্যা দাঁড়ায় ১৪ হাজারের মতো। অথচ ইতালির জনপ্রিয় সুপারকার নির্মাতা ফেরারি বছরে ৭ থেকে ৮ হাজারের মতো গাড়ি উৎপাদন করে। প্রায় ৭ দশকে কোম্পানিটি বিক্রি করেছে মোট আড়াই লাখেরও কম সংখ্যক গাড়ি। তবে ফেরারির কাছাকাছি সময়ে প্রতিষ্ঠিত জাপানি কোম্পানি টয়োটা মাত্র ৪ দশকে বিক্রি করেছে ৪ কোটি ৭০ লাখের বেশি গাড়ি।

ছবি: ফেরারির ওয়েবসাইট থেকে

ফেরারির ইতিহাস
 
গত শতাব্দীর ত্রিশের দশকে ইতালির বিখ্যাত রেসার এনজো ফেরারি সে সময়কার সুপারস্টার রেসারদের নিয়ে 'স্কুডেরিয়া ফেরারি' নামে একটি রেসিং টিম গঠন করেন। সালটা ছিল ১৯২৯, যাকে ফেরারির জন্মসাল হিসেবে ধরা হয়, যদিও আনুষ্ঠানিক আত্মপ্রকাশে আরও এক দশক সময় লেগে যায়।

১৯৩৯ সালের দিকে এনজো ফেরারি 'অটো এভিও কসস্ত্রুজিওনি' নামে গাড়ির বিভিন্ন যন্ত্রাংশ সরবারহের একটি কোম্পানি প্রতিষ্ঠা করে। পরবর্তীতে যে কোম্পানিটি 'ফেরারি' নামে পরিচিতি পায়। ১৯৪০ সালে কোম্পানিটির 'এএসি ৮১৫' মডেলের একটি গাড়ি তৈরি করলেও সেটাকে প্রথম ফেরারি হিসেবে ধরা হয় না।

তারও কয়েক বছর পর, ১৯৪৭ সালে ভি১২ ইঞ্জিন বিশিষ্ট 'ফেরারি ১২৫এস' নামে কোম্পানিটির প্রথম গাড়িটি তৈরি হয়। যা ওই বছরের রেসিংয়ে অংশ নিয়ে বিশ্বে গতিদানব এই ব্র্যান্ডটির আগমনী বার্তা ছড়িয়ে দিয়েছিল। এরপর থেকে ৭ দশকের বেশি সময় ধরে বিশ্ব বাজারে বিলাসবহুল সব গাড়ি উপহার দিয়ে আসছে ইতালির জনপ্রিয় এই ব্র্যান্ড।

ছবি: ফেরারির ওয়েবসাইট থেকে

বিশ্বব্যাপী বিত্তবানদের ব্যাপক আগ্রহে থাকলেও সবার ভাগ্যে এই গাড়িটি সংগ্রহের সুযোগ হয় না। রুচির পাশাপাশি একটি ফেরারি কিনতে হলে অস্বাভাবিক পরিমাণের অর্থের প্রয়োজন। বর্তমান বিশ্বের সবচেয়ে দামি সুপারকারটির নির্মাতা ফেরারি, যার দাম আকাশছোঁয়া। '১৯৬৩ ফেরারি ২৫০ জিটিও' মডেলের এই গাড়িটির দাম ৭০ মিলিয়ন ডলার। যা বর্তমান বাংলাদেশি মুদ্রায় ৭২৫ কোটি টাকার বেশি।

বাংলাদেশে যদিও এর অনুমোদন মিলবে কিনা সন্দেহ আছে, তবে সব ঠিক থাকলেও শুল্ক, করসহ সব খরচের পরে এর দাম কয়েক হাজার কোটি ছাড়িয়ে যেতে পারে। এমন দাম দিয়ে একটি গাড়ি কেনার সামর্থ্য বিশ্বের খুব কম মানুষের আছে। ফেরারির আকাশচুম্বী দাম নির্ধারণের পেছনে বেশ কিছু কারণ আছে, তা নিয়েই হবে আজকের আলোচনা।

সীমিত সরবরাহ ও উচ্চ চাহিদা

যত্রতত্র ফেরারি ঘুরে বেড়ালে ব্র্যান্ড ভ্যালু যে থাকবে না সেটা কোম্পানিটি খুব ভালো করেই জানে। তাদের নীতিগুলোর মধ্যে তাই সীমিত সরবারহ অন্যতম একটা। যত কম গাড়ি রাস্তায় দেখা যাবে, তত বেশি দাম বাড়বে। পৃথিবীতে যেসব জিনিস অপ্রতুল তার দামটা একটু বেশিই হয়।

১৯৪৭ সালে প্রতিষ্ঠার পর থেকে আজ পর্যন্ত ফেরারির নির্মিত গাড়ির সংখ্যা ২ লাখ ২০ হাজারের কিছু বেশি। অথচ, স্ট্যাটিস্টার মতে, ২০২১ সালে টয়োটা তাদের করোলা মডেলের অন্তত ১১ লাখ গাড়ি বিক্রি করে। সিএনবিসির ২০১৮ সালের প্রতিবেদন অনুযায়ী, যুক্তরাষ্ট্রের বিখ্যাত গাড়ি উৎপাদনকারী ফোর্ড ১৯৬৬ থেকে ২০১৮ সালের মধ্যে তাদের মাস্টাং মডেলের গাড়িটি বিক্রি হয়েছিল ১ কোটির বেশি।

ছবি: ফেরারির ওয়েবসাইট থেকে

বিলিয়নিয়ারদের কাছে ফোর্ড কিংবা টয়োটার চেয়ে নির্দ্বিধায় ফেরারি এগিয়ে থাকবে, কোম্পানিটি মূলত এই শ্রেণির ক্রেতাদের উদ্দেশেই গাড়ি তৈরি করে থাকে। আকাশচুম্বী দাম দিয়ে কেনার জন্যে বিশ্বে বিত্তবানদের সংখ্যা বাড়ার পাশাপাশি ফেরারির চাহিদাও বাড়ছে সমানহারে।

মহামারি ও যুদ্ধের প্রভাব থাকা সত্বেও এই প্রতিষ্ঠানটির বিলাসবহুল গাড়ি বিক্রি তাই রেকর্ড ছাড়িয়ে যাচ্ছে। চলতি বছরের শুরুর দিকে কোম্পানিটির প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা বেনেদেত্তো ভিনা বার্তা-সংস্থা রয়টার্সকে জানায়, 'আমাদের ইতিহাসে সবচেয়ে বেশি ক্রয়াদেশ রয়েছে এখন'।

ফেরারির নকশা

বিলাসবহুল সুপারকারের দুনিয়ায় নকশা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। অস্বাভাবিক গতি বজায় রেখে নান্দনিক নকশার জন্য প্রতিটি কোম্পানি হাজার হাজার মিলিয়ন ডলার ব্যয় করে। ফেরারির ক্ষেত্রেও এর ব্যতিক্রম নেই। প্রতিষ্ঠানটির বিলাসবহুল গাড়িগুলোর জন্য বর্তমানে কাজ করছে ইতালির স্থপতি এবং অটোমোবাইল ডিজাইনার ফ্লাভিও মানজোনির নেতৃত্বে একটি ডিজাইনিং টিম।

এই দলটির নকশা করা 'ফেরারি ডেটোনা এসপি৩' মডেলের গাড়িটি প্যারিস আন্তর্জাতিক অটোমোবাইল ফেস্টিভালের 'গ্র্যান্ড প্রাইজ: দ্য মোস্ট বিউটিফুল সুপারকারের' খেতাব অর্জন করে। এমন মর্যাদাপূর্ণ পুরস্কার অর্জনের জন্যে নকশাকারী দলের পেছনে বিপুল পরিমাণ অর্থ ব্যয় করাটাই স্বাভাবিক।

ছবি: ফেরারির ওয়েবসাইট থেকে

ফেরারির প্রযুক্তি ও গতি
 
সুপারকারের জন্যে পারফরম্যান্স অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ, ফেরারিও সেক্ষেত্রে অনেক এগিয়ে। আধুনিক সব প্রযুক্তিতে পূর্ণ থাকে একেকটি গাড়ি। ব্রান্ডটির অন্যতম জনপ্রিয় একটি মডেল হচ্ছে ফেরারি এফ৮ স্পাইডার, যা ৭২০ হর্স-পাওয়ারের। মাত্র ২ দশমিক ৯ সেকেন্ডের মধ্যে ঘণ্টাপ্রতি ৬০ মাইল গতিবেগ তুলতে সক্ষম।

ফর্মুলা ওয়ান থেকে অনুপ্রাণিত হয়ে নির্মিত লা ফেরারি মডেলের গাড়িটিতে উচ্চতর দক্ষতার জন্য কাইনেটিক এনার্জি রিকভারি সিস্টেম (কেইআরএস) অন্তর্ভুক্ত করে নকশা করা হয়েছিল। এই গাড়িটি অত্যাধুনিক প্রযুক্তি ও নকশার সঙ্গে আছে ৯৫০ হর্স পাওয়ার।

অন্যদিকে ভি১২ ইঞ্জিনের ৮১০ হর্স-পাওয়ার সম্পন্ন গাড়িটির গতি ঘণ্টায় ১৮৬ মাইলের বেশি। ২০১৩ সালে প্রতিষ্ঠানটি সুপারকার ইন্ডাস্ট্রিতে হাইব্রিড গাড়ির প্রচলন শুরু করে। এই প্রতিষ্ঠানের পাশাপাশি ম্যাকলরেন ও পোর্শেও হাইব্রিড মডেলে নিয়ে আসে উইন্ডশেল-বিহীন স্পোর্টস কার।

ছবি: ফেরারির ওয়েবসাইট থেকে

তবে, গাড়ির দুনিয়ায় সবচেয়ে দ্রুত গতির হাইব্রিড গাড়িটি রয়েছে ফেরারির দখলে। ফেরারি 'লা স্ত্রাদালে' মডেলের গাড়িটি মাত্র আড়াই সেকেন্ডের মধ্যে ৬০ মাইল গতিবেগে তুলতে পারে। এমন বিশেষ সুপারকার তৈরির জন্য ফেরারির রয়েছে অত্যাধুনিক গবেষণা ও প্রযুক্তিবিদদের একটি চৌকস টিম। যাদের পেছনে বিশাল অঙ্কের বিনিয়োগ করে চলেছে প্রতিষ্ঠানটি।

ফ্যাক্টরি ও নির্মাণ কৌশল

বিশ্বের শীর্ষস্থানীয় সুপারকার কোম্পানি হিসেবে ফেরারি তার গাড়িগুলো ইতালির মারানেলোতেই তৈরি ও অ্যাসেম্বলি করে থাকে। এই মারানেলোই ফেরারির সদর দপ্তর। যেখানে এনজো ফেরারি তৈরি করেছিলেন প্রতিষ্ঠানটির প্রথম গাড়ি। এখন পর্যন্ত যতগুলো ফেরারি তৈরি হয়েছে তা এই কারখানাতেই অ্যাসেম্বল করা।

অর্থের পাশাপাশি সব ধরনের যোগ্যতা থাকার পরেও কেউ চাইলেই একটি ফেরারি গাড়ির মালিক হতে পারে না। একটি ফেরারি তৈরিতে সর্বনিম্ন ৩ মাস সময় লাগে, অনেক ক্ষেত্রে আরেও বেশি সময়ও লাগতে পারে। এর পেছনে রয়েছে বিশেষ কিছু কারিগরদের ভূমিকা। অ্যাসেম্বলের কাজটি আংশিক স্বয়ংক্রিয়ভাবে করা হলেও দুর্দান্ত নকশা ও প্রযুক্তিগতকাজগুলো সম্পন্ন হয় দক্ষ কারিগরদের নিজ হাতে, যা সময়সাপেক্ষ।

এসব দক্ষ কারিগরের সংখ্যাও খুব বেশি না, তাদের বিপুল পরিমাণে পারিশ্রমিকের পাশাপাশি দিতে হয় সময়। এ ছাড়া গাড়ির অভ্যন্তরীণ নকশা, অ্যাসেম্বলের জন্যও রয়েছে বিশেষ একদল কারিগর। বিশেষ করে ইঞ্জিনের কাজটা সম্পূর্ণ হাতে করতে হয়। সুতরাং, মিলিয়ন ডলার পকেটে করে আজকে গিয়ে কালকেই একটা ফেরারি কিনে বাড়ি ফেরার স্বপ্নটা অবাস্তব।

ছবি: সংগৃহীত

ফেরারির ইন্টেরিওর

একটি মিলিয়ন ডলারের ফেরারির ইন্টেরিওর যে বিলাসবহুল হবে তা বলা বাহুল্য। ভেতরের সিট থেকে শুরু করে অনেক কাঠামো তৈরিতে বিশেষ প্রযুক্তির ফাইবার, কাপড়, চামড়া ও অন্যান্য পদার্থ ব্যবহার করা হয়। যারমধ্যে আছে কেবলার, আলকানতারা ও আলট্রাসুয়েডের মতো উচ্চ মানের মজবুত তাপ ও পানিরোধী পদার্থ।

এ ছাড়া ড্যাশ-বোর্ড, স্টিয়ারিং হুইল, সিট ফ্রেম এবং অন্যান্য অভ্যন্তরীণ কাঠামোর অনেক কিছুই ক্রেতার চাহিদা অনুযায়ী বানানো হয়ে থাকে। এই সমস্ত উপকরণ যেমন নান্দনিক, আরামদায়ক, মজবুত, ঠিক তেমনই ব্যয়বহুল।

ছবি: ফেরারির ওয়েবসাইট থেকে

রক্ষণাবেক্ষণ

ক্রয় সামর্থ্যের পাশাপাশি একটা ফেরারি রক্ষণাবেক্ষণের জন্যে মালিককে গুণতে হবে বিপুল পরিমাণ টাকা। অনেক ক্ষেত্রে একটা ফেরারির বাৎসরিক রক্ষণাবেক্ষণে যে পরিমাণ অর্থ ব্যয় করতে হয় তা দিয়ে একটা মধ্যম মানের গাড়ি কেনা সম্ভব। কোনো ধরনের মেরামত ছাড়াই শুধু রুটিন পরীক্ষার জন্য ফেরারি মালিককে গুণতে হবে প্রায় ৭ হাজার ডলার।
 
যদি ইঞ্জিনের কোনো সার্ভিসিং প্রয়োজন হয় বা কোনো যন্ত্রাংশ পাল্টাতে হয়, সেক্ষেত্রে খরচটা ২৫ থেকে ৩০ হাজার ডলার ছাড়িয়ে যেতে পারে। যা দিয়ে সহজেই মিলবে বিখ্যাত জার্মান ব্র্যান্ড বিএমডব্লিউয়ের বিলাসবহুল সেডান কার। সাধারণ একটি গাড়ির যে যন্ত্রাংশ ৫ ডলারে পাওয়া যায়, ফেরারির ঠিক সেই যন্ত্রটির জন্যে গুণতে হতে পারে অন্তত ৪০ ডলার। অর্থাৎ ৭ থেকে ৮ গুণ রক্ষণাবেক্ষণ খরচ মাথায় নিয়েই ফেরারি কেনার পরিকল্পনা হাতে নেওয়া উচিত।  

ফেরারি গাড়ির দাম

কারপ্রাইজ.কম.বিডির তথ্য অনুসারে, ফেরারি ২৯৬ জিটিএস ২০২৩ মডেলটির মূল্য বাংলাদেশি টাকায় প্রায় ৪ কোটি ১৬ লাখ, ফেরারি ৮১২জিটিএস ২০২২ মডেলটির দাম পড়বে ৪ কোটি ৮৮ লাখ ৮ হাজার ২৪০ টাকা এবং ফেরারি ডেটোনা এসপি-থ্রি ২০২২ মডেলটির দাম পড়বে ২৩ কোটি ৪০ লাখ টাকার মতো। তবে ফেরারির বেশিরভাগ মডেলের দাম বাংলাদেশি টাকায় ৩ কোটি থেকে ২০ কোটি টাকার মধ্যে।

তবে, বিদেশি গাড়ি আমদানিতে সিসিভেদে ৫০০ থেকে ৮০০ শতাংশ পর্যন্ত শুল্ক হার নির্ধারিত হওয়ায় বাংলাদেশি টাকায় এসব গাড়ির মূল্য আরও অন্তত ৫ থেকে ৮ গুণ বেড়ে যায়।
   
তথ্যসূত্র: বিজনেস ইনসাইডার, রয়টার্স, সিএনবিসি, ফেরারি, ফোর্বস, দ্য ভার্জ, স্ট্যাটিস্টা

 

 

Comments

The Daily Star  | English
Chattogram port Imports

Reducing penalty on false declarations will encourage smuggling: experts

In the Finance Ordinance 2025–26, presented on Monday, the government proposed amending the Customs Act 2023 and revising the penalty structure for tax evasion related to intentional false declarations during import clearance, reducing the minimum fine from twice the evaded amount to an equivale

58m ago