সীতাকুণ্ড কি তবে বিস্ফোরণের জনপদ
সীতাকুণ্ডে বিএম ডিপোর ভয়াবহ বিস্ফোরণের ক্ষত এখনো মোছেনি। এর মধ্যে একটি অক্সিজেন প্ল্যান্টে আবারও বিস্ফোরণে নিহত হয়েছেন ৬ জন। আগের ঘটনায় অর্ধশতাধিক মানুষ প্রাণ দিলেও সীতাকুণ্ড অঞ্চলের কল-কারখানা, জাহাজভাঙা ইয়ার্ড, রাসায়নিক মজুতের ডিপো, রি-রোলিং মিল, সিমেন্ট কারখানাগুলোতে শ্রমিকের নিরাপত্তায় কি আয়োজন আছে, সেটার পরিদর্শন করারও প্রয়োজন বোধ করেনি সংশ্লিষ্ট সরকারি সংস্থাগুলো।
কেবল শ্রমিকের মৃত্যু হলে পরিবেশ অধিদপ্তর, কল-কারখানা পরিদর্শন অধিদপ্তর ও বিস্ফোরক অধিদপ্তরের কর্তাদের ঘটনাস্থলে দেখা যায়। শনিবারের ঘটনায় আবারও আশ্বাস আর দায়ীদের কঠোর শাস্তির হুঁশিয়ারি আসবে। ভেতরে ভেতরে চলবে দর কষাকষি। রক্তের দাগ শুকানোর আগে এসব সরকারি কর্তারা আরও একবার শীতনিদ্রায় চলে যাবেন। অপেক্ষা করবেন পরবর্তী কোনো দুর্ঘটনার।
এ দেশে সাধারণ মানুষের জন্য চারপাশে নানা ধরনের মৃত্যুফাঁদ। শ্রমিকের জন্য এ ফাঁদটা আরও গভীর ও বিস্তৃত। কর্মক্ষেত্রে শ্রমিকের নিরাপত্তা নিশ্চিতে প্রতিষ্ঠান মালিকের আইনি বাধ্যবাধকতা আছে। আর মালিক সেই নিরাপত্তা নিশ্চিত করেছে কি না, তা দেখভালের দায়িত্ব কলকারখানা পরিদর্শন অধিদপ্তরের। বিস্ফোরক দ্রব্যের ক্ষেত্রে সেই তদারকিতে যুক্ত হওয়ার কথা বিস্ফোরক অধিদপ্তর ও পরিবেশ অধিদপ্তরের।
বাস্তবে নিরাপত্তা দেখাশোনা করার সংস্থা যত বেড়েছে, শ্রমিকদের নিরাপত্তাহীনতাও পাল্লা দিয়ে ততই বেড়েছে। তদারকি সংস্থাগুলোর গাফিলতিতে সীতাকুণ্ড অঞ্চলে সব সময় বড় ধরনের দুর্ঘটনার ঝুঁকির মধ্যে বসবাস করছেন সাধারণ মানুষ।
ভৌগোলিকভাবে সমুদ্র সংলগ্ন অঞ্চল, ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়ক ও চট্টগ্রাম বন্দরের কাছাকাছি হওয়ায় সীতাকুণ্ডে শিল্পপ্রতিষ্ঠান গড়ে উঠছে। কিন্তু এসব কারখানার বড় একটি অংশই শ্রমিকদের জন্য অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ। যেসব কারখানা শ্রমিকদের জন্য ঝুঁকিপূর্ণ বলে বিবেচিত, তার অধিকাংশেরই হদিস পাওয়া যাবে এ সীতাকুণ্ডে।
রাসায়নিকের কারখানা, জাহাজভাঙা শিল্প ও রি-রোলিং মিল কর্মক্ষেত্রে দুর্ঘটনায় শ্রমিকের মৃত্যুর জন্য কুখ্যাত। এখন সেই তালিকায় যুক্ত হয়েছে কনটেইনার ডিপো ও গ্যাস সিলিন্ডার প্রক্রিয়াজাতকরণ প্ল্যান্ট। এসব কারখানা পরিবেশ আইনে লাল-ক্যাটাগরির শিল্পপ্রতিষ্ঠান। তার মানে এগুলোতে উচ্চঝুঁকি আছে। এ ঝুঁকি মোকাবিলায় পরিবেশ ও শ্রম আইনে বিভিন্ন নিরাপত্তা ব্যবস্থা নেওয়ার কথা বলা থাকলেও সেগুলো মানার বা মানানোর কারও কোনো গরজ নেই।
পুলিশসহ সরকারি কর্মকর্তারা যারা সীতাকুণ্ড অঞ্চলের এসব শিল্প-কারখানা তদারকির দায়িত্বে থাকেন, তাদের জন্য শ্রমিকের মৃত্যু অনেকটা আশীর্বাদের মতো। প্রতিটি মৃত্যু প্রতিষ্ঠানের মালিকের সঙ্গে তাদের দর কষাকষির সুযোগ তৈরি করে দেয়।
কমপক্ষে ৫০ জন শ্রমিক থাকলে যেকোনো কারখানা বা প্ল্যান্টে সেফটি কমিটি থাকার কথা। সেফটি নিয়মিত জরুরি নির্গমন মহড়া দেওয়া, বিপৎকালীন নিরাপত্তা সরঞ্জাম সরবরাহ করা, নিরাপত্তা ঝুঁকি তৈরি করছে এমন কী কী উৎস আছে সেগুলো তদারকি করার কথা। সেফটি কমিটি ঠিকমতো কাজ করতে পারছে কি না, সেটা তদারকির দায়িত্ব কলকারখানা পরিদর্শন অধিদপ্তরের। অথচ সরকারি কর্মকর্তা ও শিল্পমালিক যোগসাজশে শ্রমিকের জন্য মৃত্যুর জমিন তৈরি হয়েছে। সীতাকুণ্ড আজ সেই জমিনের সমার্থক হয়ে উঠেছে।
বিএম ডিপোতে বিস্ফোরণের ৯ মাসের মাথায় সীতাকুণ্ডের কদমরসুল এলাকায় গ্যাস প্ল্যান্টে বিস্ফোরণ হলো। এই ঘটনায় ৬ জনের মৃত্যুর তথ্য পাওয়া গেছে। বিস্ফোরণের মাত্রা দেখে শঙ্কা করা হচ্ছে হতাহতের সংখ্যা আরও বাড়তে পারে। কেন বার বার ভয়াবহ বিস্ফোরণের ঘটনা ঘটছে? কারণ, কোনো কারখানা বা শিল্পমালিককে শ্রমিকের মৃত্যুর ঘটনায় বিচারের আওতায় আনা হয় না।
নির্মম সত্য হলো সংশোধিত শ্রম আইনে দুর্ঘটনায় শ্রমিকের মৃত্যু হলে ২ লাখ টাকা ক্ষতিপূরণ দিয়ে মালিকের দায়মুক্তির ব্যবস্থা করা হয়েছে।
মোস্তফা ইউসুফ: সাংবাদিক, দ্য ডেইলি স্টার
Comments