জোবায়েরকে পেটানোর ‘১ ঘণ্টার পরিকল্পনা’, প্রলয় গ্যাংয়ের বিরুদ্ধে ‘লিখিত অভিযোগ পেলে’ তদন্ত করবেন প্রক্টর

এরপর ওই গ্যাংয়ের সদস্য সিফরাত সাহিল শিক্ষার্থী জোবায়েরকে ফোন করে বিশ্ববিদ্যালয়ের হল পাড়ার দিকে যেতে বলেন। সে সময় জোবায়ের বিশ্ববিদ্যালয়ের সামাজিক বিজ্ঞান অনুষদের সামনে বন্ধুদের সঙ্গে আড্ডা দিচ্ছিলেন।
প্রলয় গ্যাং
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অপরাধ বিজ্ঞানের শিক্ষার্থী জোবায়ের ইবনে হুমায়ুনকে হাসপাতালে নেওয়ার পথে। ছবি: সংগৃহীত

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অপরাধ বিজ্ঞানের শিক্ষার্থী জোবায়ের ইবনে হুমায়ুনকে পেটানোর আগে 'প্রলয় গ্যাং'র সদস্যরা প্রথমে 'ঘণ্টাব্যাপী পরিকল্পনা' করেন।

এরপর ওই গ্যাংয়ের সদস্য সিফরাত সাহিল শিক্ষার্থী জোবায়েরকে ফোন করে বিশ্ববিদ্যালয়ের হল পাড়ার দিকে যেতে বলেন।

সে সময় জোবায়ের বিশ্ববিদ্যালয়ের সামাজিক বিজ্ঞান অনুষদের সামনে বন্ধুদের সঙ্গে আড্ডা দিচ্ছিলেন।

ফোন পেয়ে কবি জসিম উদ্দিন হলের গেটের সামনে যেতেই রড ও লাঠি দিয়ে পেটায় 'প্রলয় গ্যাংয়ের' সদস্যরা।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টর অধ্যাপক ড. একেএম গোলাম রব্বানী গতকাল দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, 'এ ধরনের একটি গ্যাং সম্পর্কে আমরা বিভিন্ন মাধ্যমে জানতে পেরেছি। এখন পর্যন্ত কোনো লিখিত অভিযোগ পাইনি৷ অভিযোগ পেলে আমরা তদন্ত করে ব্যবস্থা নেবো।'

কারো কাছে এ সংশ্লিষ্ট কোনো সুস্পষ্ট তথ্যপ্রমাণ থাকলে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষকে অবহিত করার অনুরোধ জানান তিনি।

গত শনিবার সন্ধ্যার এ ঘটনায় মাথা, চোখ, পা, পিঠ, চোয়ালে আঘাতপ্রাপ্ত হন জোবায়ের।

প্রথমে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে প্রাথমিক চিকিৎসার পর এভারকেয়ার হাসপাতালে চিকিৎসা নেন তিনি।

গতকাল রোববার রাতে টেলিফোনে দ্য ডেইলি স্টারের কাছে মারধরের ও তার আগের ঘটনার বর্ণনা দেন জোবায়ের।

তিনি বলেন, 'মুক্তিযোদ্ধা জিয়াউর রহমান হলের শিক্ষার্থী সিফরাত সাহিল শনিবার সন্ধ্যা ৭টা ৩১ মিনিটে বাংলালিংক নম্বর থেকে ফোন করেন। সেটির শেষ সংখ্যা ছিল ৫৬৩।'

'সিফরাতের ফোন পেয়ে ২ বন্ধুকে নিয়ে হল পাড়ায় যাই। যাওয়া মাত্রই প্রলয় গ্যাংয়ের সদস্যরা ঘিরে ধরে। পূর্ব পরিকল্পনা অনুযায়ী তাদের হাতে ছিল রড, লাঠি, কারো হাতে স্ট্যাম্প। কেউ কেউ প্যান্টের বেল্ট খুলেও পেটায়।'

ইফতারের পরপর এসব ঘটনা ঘটে উল্লেখ করে জোবায়ের আরও বলেন, 'আশপাশে তখন অনেক শিক্ষার্থী ছিলেন। ইফতারের পর তারা আড্ডা দিচ্ছিলেন। সবার সামনে প্রায় ৫ মিনিটের মতো এলোপাতাড়ি পেটায় প্রলয় গ্যাংয়ের সদস্যরা। এক পর্যায়ে রক্তাক্ত অবস্থায় আমাকে ফেলে তারা পালিয়ে যায়।'

পরে জোবায়েরকে হাসপাতালে নেওয়া হয়। ঘটনাস্থলে তখন একাত্তর হল ও জিয়া হলের অনেক শিক্ষার্থীর জটলা দেখা গিয়েছিল।

প্রলয় গ্যাং
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় চিকিৎসাকেন্দ্রে ‘প্রলয় গ্যাং’র সদস্যরা। ছবি: ফেসবুক থেকে নেওয়া

ঘটনার শুরু যেভাবে

শনিবার ইফতারের পর সামাজিক বিজ্ঞান অনুষদের সামনে কয়েকজন বন্ধুর সঙ্গে আড্ডা দিচ্ছিলেন জোবায়ের। হঠাৎ একটি প্রাইভেটকার বেপরোয়া গতিতে তাদের সামনে দিয়ে চলে যায়। গাড়ি যাওয়ার সময় কাদা-পানি ছিটে যায় জোবায়ের ও তার বন্ধুদের গায়ে। তখন তারা একটি মোটরসাইকেল নিয়ে ওই প্রাইভেটকারকে ধাওয়া করতে থাকে।

এক পর্যায়ে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের কাছে ৩ নেতার মাজারের সামনে গিয়ে প্রাইভেটকারটিকে তারা ধরতে। আরোহীদের কয়েকজনকে জোবায়ের চিনতে পারেন। তিনি তাদের গাড়ি জোরে চালানোর বিষয়ে জানতে চান এবং সে সময় তাদের মধ্যে বাগবিতণ্ডা হয়। পরে জোবায়ের আবার সামাজিক বিজ্ঞান চত্বরে চলে আসে।

এ ঘটনার প্রায় সোয়া ১ ঘণ্টা পর সিফরাত সাহিল ফোন দিয়ে জোবায়েরকে হল পাড়ার দিকে যেতে বলেন। এই সময়টা তারা পেটানোর পরিকল্পনা করেন বলে মনে করছেন জোবায়ের।

প্রাইভেটকারে যারা ছিলেন

যে প্রাইভেটকারটি জোবায়েরকে কাদা-পানি ছিটিয়ে চলে যায়, সেটির সামনে 'অ্যাডভোকেট' লেখা ছিল বলে জানান জোবায়ের। গাড়িতে জিয়া হলের ফয়সাল আহমেদ সাকিব, জগন্নাথ হলের প্রত্যয় সাহা, শহীদ সার্জেন্ট জহুরুল হক হলের আব্দুল্লাহ আল আরিফ ওরফে হাই, জসিম উদ্দিন হলের নাইমুর রহমান দুর্জয় ছিলেন বলেও জানান জোবায়ের।

তবে মারধরের সময় আরও ছিলেন শান্তি ও সংঘর্ষ বিভাগের শিক্ষার্থী তবারক মিয়া, ট্যুরিজম অ্যান্ড হসপিটালিটি ম্যানেজমেন্ট বিভাগের সিফরাত সাহিল, রাষ্ট্রবিজ্ঞানের সাদ, চাইনিজ ল্যাংগুয়েজের ফেরদৌস আলম ইমন, মার্কেটিং বিভাগের মোহাম্মদ শোভন, আন্তর্জাতিক বিজনেসের ফারহান লাবিব, ফিন্যান্স বিভাগের মোশাররফ হোসেন, দর্শন বিভাগের অর্ণব খান, সমাজকল্যাণ গবেষণা ইনস্টিটিউটের হেদায়েত নূর, গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের মাহিন মনোয়ার, তথ্যবিজ্ঞান ও গ্রন্থাগার ব্যবস্থাপনা বিভাগের সাদমান তাওহীদ বর্ষণ, ফারসি ভাষা ও সাহিত্য বিভাগের সৈয়দ নাসিফ ইমতিয়াজ সাইদ ও হাজী মুহম্মদ মুহসীন হলের আবু রায়হান।

জোবায়েরকে মারধরের ঘটনায় শাহবাগ থানায় গতকাল সন্ধ্যায় ১৯ শিক্ষার্থীর নাম উল্লেখ ও অজ্ঞাতনামা ৬-৭ জনের বিরুদ্ধে লিখিত অভিযোগ দেন তার মা সাদিয়া আফরোজ খান।

বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী সূত্রে জানা গেছে, অভিযুক্তরা সবাই 'প্রলয়' নামে একটি গ্যাংয়ের সদস্য। জোবায়েরকে মারধরের পর এই গ্যাংয়ের কর্মকাণ্ড নিয়ে কয়েকটি গণমাধ্যমে সংবাদ প্রকাশিত হয়েছে।

সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের শিশুপার্কসংলগ্ন এলাকায় নিয়মিত মাদক সেবনের অভিযোগ আছে এই গ্যাংয়ের সদস্যদের বিরুদ্ধে। ক্যাম্পাসে তারা সংঘবদ্ধভাবে চলাফেরা করেন। ফেসবুক গ্রুপের মাধ্যমে তারা ঐক্যবদ্ধ।

প্রতি রাতে ঢাবির শহীদ বুদ্ধিজীবী ডা. মোহাম্মদ মোর্তজা চিকিৎসাকেন্দ্রের তৃতীয় তলার একটি কক্ষে তারা আড্ডা দেন। সেখানে তোলা ছবি তারা ফেসবুকে পোস্ট করেন।

উদ্যানকেন্দ্রীক অপরাধে 'প্রলয় গ্যাং'

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় সংলগ্ন সোহরাওয়ার্দী উদ্যানকে কেন্দ্র করে 'প্রলয় গ্যাং'র আড্ডা ছিল বলে জানা গেছে। সেখানকার দোকানদাররা দ্য ডেইলি স্টারকে জানান, গ্যাংয়ের সদস্যরা সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে প্রায় নিয়মিত মাদক সেবন করেন। পাশাপাশি দর্শনার্থীদের ছিনতাই ও মারধরে তারা জড়িত।

গ্যাং সদস্যদের পানির ব্যবসা

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাস ও এর আশপাশে এ গ্যাংয়ের সদস্যরা খাবার পানির ব্যবসা করেন বলে জানা গেছে। দোকানগুলোয় একটি কোম্পানির পানি বিক্রির সঙ্গে তারা যুক্ত ছিলেন বলেও জানা যায়।

যা বলছেন অভিযুক্তরা

ঘটনা সম্পর্কে গত শনিবার রাতে 'প্রলয় গ্যাং'র সক্রিয় সদস্য হেদায়েত নূর ডেইলি স্টারকে বলেন, 'জোবায়ের আগে আমাদের সঙ্গেই ছিল। সে ক্যাম্পাসে ছিনতাইয়ের সঙ্গে জড়িত ছিল। তাই আমরা তার সঙ্গ ত্যাগ করি। এ নিয়ে সে আমাদের ওপর ক্ষুব্ধ ছিল। যখন সে আমাকে মারতে আসে, আমি নিজেকে রক্ষার জন্য তাকে আঘাত করি।'

সাদমান তাওহীদ বর্ষণ ডেইলি স্টারকে বলেন, 'আমি দেখলাম জোবায়ের আমার বন্ধু হেদায়েত নূরকে মারছে। তখন আমি জোবায়েরকে মারধর করি।'

'প্রলয় গ্যাং'র সঙ্গে তাদের কী সম্পর্ক, জানতে চাইলে তারা ২ জনই 'গ্যাং' সম্পর্কে ধারণা নেই বলে জানান।

 

Comments