ধ্বংসস্তূপ থেকে উঠে আসার গল্প

রেশমা কৃষি উদ্যোগ
সুরাইয়া ফারহানা রেশমা। ছবি: মোস্তফা সবুজ/স্টার

গোলাভরা ধান, গোয়ালভরা গরু, পুকুরভরা মাছ, উঠোন ভরা হাঁস মুরগি কবুতর, মাঠ ভরা শাকসবজি--কী নেই তার! অথচ এক সময় ভালোমতো খেতেও পেত না বাবা ও স্বামীর দ্বারা পরিত্যক্ত সুরাইয়া ফারহানা রেশমা।

রেশমার লড়াই আর সফলতা অনেকটা রূপকথার মতো। হার না মেনে নিজের পরিচয় তৈরি করেছেন বগুড়ার শেরপুর উপজেলার বংগা গ্রামের উদ্যোক্তা রেশমা (৩৭)। আশপাশের সবাই এখন তাকে এক নামে চেনে। কেউ তার স্বামী অথবা বাবার নাম জানতে চায় না।

রেশমার বয়স যখন ২ মাস তার বাবা তাদের ফেলে নতুন সংসার বাঁধেন। অতিকষ্টে রেশমাকে বড় করেন মা হোসেনরা বেগম। দারিদ্র্যের কারণে অষ্টম শ্রেণির পর পড়ালেখা আগায়নি। তার বাল্যবিয়ে হয়ে যায়।

মায়ের বাড়িতেই রেশমা নতুন সংসার শুরু করেন। তবে তার স্বামী ছিল জুয়াড়ি। সেবন করত মাদক। জুয়া আর মাদকের টাকার জন্য রেশমাকে মারধর করতেন। বাধ্য হয়ে স্বামীকে তালাক দেন রেশমা। এর পর বোঙ্গা গ্রামে আবার শুরু হয় মা-মেয়ে সংসার।

রেশমা বলেন, 'আমি এবং আমার মা পরিচয় দিতে গেলে সবাই বাবা আর স্বামীর কথা জিজ্ঞেস করত। বিষয়টি আমাকে কষ্ট দিত। সিদ্ধান্ত নেই আমি আমার নিজের পরিচয়ে বাঁচব। এমন কিছু করব যেন সবাই আমাকে আমার নামেই জানে-চেনে।'

'কিন্তু কি করব? টাকা নেই, প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষাও তেমন নেই। কী করব সেটা ভাবতে ভাবতেই চলে যায় অনেক সময়। পরে ২০১৪ সালে জেলা যুব উন্নয়ন অফিস থেকে প্রথমে মাছ চাষ এবং সেলাই প্রশিক্ষণ নিই।'

সেখান থেকেই 'রেশমা কৃষি উদ্যোগ'র শুরু।

যুব উন্নয়ন থেকে প্রাপ্ত ৫০ হাজার টাকা ঋণ এবং মায়ের জমানো ১৫ হাজার টাকা দিয়ে ২০১৪ সালে একটি গরু ও একটি ছাগল দিয়ে খামার শুরু করেন রেশমা। ২০১৬ সালে তার খামারে যোগ হয় ভার্মি কম্পোস্ট, ট্রাইকো কম্পোস্ট উৎপাদন।

২০১৮ শুরু করেন হাঁস-মুরগি-কবুতরের খামার। এর পরে শুরু করেন মাঠে নানা রকমের শাক-সবজি এবং ফসল চাষ। রেশমা এ বছর ৩ বিঘা জমি থেকে ১০০ মণ ভুট্টা পেয়েছেন।

রেশমা জানান, এখন খামার থেকে মাসে ২ লাখ টাকা আয় করেন। মাসে প্রায় ৪৫ টন ভার্মি কম্পোস্ট, ১০ টন ট্রাইকো কম্পোস্ট বিক্রি করেন। এর বাইরে নতুন উদ্যোক্তাদের কাছে কেঁচো বিক্রি করেন ৪০ থেকে ৫০ হাজার টাকার।

রেশমা কৃষি উদ্যোগ
সুরাইয়া ফারহানা রেশমা। ছবি: মোস্তফা সবুজ/স্টার

এর বাইরে হাঁস-মুরগি, দুধ-ডিম ও মাছ থেকে প্রতি মাসে যায় করেন আরও ৫০-৬০ হাজার টাকা। ২০১৪ সালের পরে তিনি জমি কিনেছেন ৬-৭ বিঘা।

অদম্য সাহসী এই নারী কাজের স্বীকৃতি হিসেবে পেয়েছেন অনেক পুরষ্কার। এর মধ্যে ২০২২ সালে পেয়েছেন জাতীয় যুব পুরস্কার। আর্থিক সাফল্য অর্জনকারী নারী হিসেবে একই বছর পেয়েছেন রাজশাহী বিভাগীয় জয়িতা পুরষ্কার।

চলতি বছরের মার্চে সংগ্রামী নারী কৃষক ক্যাটাগরিতে পেয়েছেন চ্যানেল আই অ্যাওয়ার্ড-২২। এছাড়া স্থানীয় পর্যায়েও আরও অনেক পুরষ্কার আছে তার ঝুলিতে।

রেশমা বলেন, 'আমি আমার নিজের পরিচয়ে বাঁচতে চেয়েছিলাম। এখানে আমি অনেকটাই সফল। সবাই এখন আমাকে রেশমা নামেই চেনে। কোথাও বাবা অথবা স্বামীর পরিচয় দিতে হয় না।'

এই পথ চলায় রেশমা স্থানীয় কৃষি অফিস, প্রাণিসম্পদ অফিস, যুব উন্নয়ন প্রশিক্ষণ কেন্দ্র, বগুড়া পল্লী উন্নয়ন একাডেমির প্রতি কৃতজ্ঞ। বিশেষ করে মায়ের প্রতি তার কৃতজ্ঞতা অশেষ।

বগুড়া সদর উপজেলার সহকারী কৃষি কর্মকর্তা আব্দুর রহিম দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, 'শূন্য থেকে একটা খামার শুরু করেছিলেন রেশমা। এখন ১৫-২০ জন নারী-পুরুষ তার খামারে কাজ করেন।'

প্রতিদিন সারাদেশ থেকে ৫-১০ জন তরুণ উদ্যোক্তা আসেন তার খামার দেখতে। এখানে এসে হাতে-কলমে কাজ শিখেন। সারা দেশ থেকে প্রায় ৬০০ জন এখানে প্রশিক্ষণ নিয়ে কৃষি উদ্যোক্তা হয়েছেন।

শেরপুর উপজেলা প্রাণিসম্পদ কর্মকর্তা মো. রায়হান ডেইলি স্টারকে বলেন, 'আত্মকর্মসংস্থানের অনন্য উদাহরণ রেশমা। তিনি নিজের চেষ্টায় প্রতিষ্ঠিত হয়েছেন, অর্থনৈতিক প্লাটফর্ম তৈরি করেছেন যা অন্যান্য নারীদের অনুপ্রেরণা যোগাচ্ছে। আমরা শুরু থেকেই রেশমার পাশে ছিলাম।'

বগুড়া-যুব-উন্নয়ন কেন্দ্রের উপ-পরিচালক তোছাদ্দেক হোসেন ডেইলি স্টারকে বলেন, 'রেশমার সীমাবদ্ধতা ছিল অনেক। ছোট বেলায় তার বাবা তাকে ছেড়ে যায়। এর পরে বাল্যবিবাহ হয়। স্বামীও ছেড়ে যায়। তার পরে সে নিজের চেষ্টায় নিজের পরিচয়ে বড় হতে চেয়েছিল। রেশমা আজ সমাজে একটা উদাহরণ।'

Comments

The Daily Star  | English

Jamaat welcomes polls timeline, criticises Yunus for skipping dialogue before announcement

Expected chief adviser to hold discussions with parties regarding announcing the election timeline, it says

3h ago