ফেলে দেওয়া উচ্ছিষ্ট যখন জীবিকার উৎস

ফেলে দেওয়া উচ্ছিষ্ট যখন জীবিকার উৎস
আবদুল খালেক ও রুকসানা বেগম। ছবি: রাফিউল ইসলাম/স্টার

আর্থিক সংকটের কারণে ১৫ বছর বয়সে মোহাম্মদপুরের একটি কসাইয়ের দোকানে চাকরি নিতে বাধ্য হন আবদুল খালেক। তবে, শিগগিরই বুঝে যান, ওই পেশার প্রতি তার কোনো আগ্রহ নেই।

জেনেভা ক্যাম্পে বসবাসকারী বিহারি সম্প্রদায়ের ছেলে খালেকের কাছে কোনো অর্থও ছিল না যে নতুন কোনো ব্যবসা শুরু করবেন।

তবে পশুর চর্বি সংগ্রহ করে বিক্রির ধারণা মাথায় আসার পর সবকিছু বদলে যেতে শুরু করে তার।

৬৫ বছর বয়সী খালেক গত ৫০ বছর ধরে এই ব্যবসা পরিচালনা করে আসছেন।

মোহাম্মদপুরের জেনেভা ক্যাম্পে ৩ তলা ভবনে তার এক কক্ষের বাসা থেকে এই প্রতিবেদককে বলেন, 'মানুষ আমাকে কসাই বলুক সেটা আমি পছন্দ করি না। তাই কাজ ছেড়ে দিয়ে প্রাণীজ চর্বি সংগ্রহ শুরু করি।'

ওই বাড়ি থেকেই ব্যবসাটি চালাচ্ছেন খালেক। তার ৪ ছেলের মধ্যে ২ ছেলে এখন তার সঙ্গেই কাজ করেন।

খালেক স্মৃতি হাতড়ে বলেন, 'যখন আমি ব্যবসা শুরু করি, সে সময় কসাইয়ের দোকান এবং মানুষের কাছ থেকে এসব চর্বি বিনামূল্যে পেতাম। মাঝে মাঝে কিনেও নিতাম।'

সময়ের সঙ্গে সঙ্গে পরিস্থিতির অনেক পরিবর্তন হয়েছে। এখন, খালেককে এসব চর্বি সংগ্রহের জন্য কসাইকে ২ থেকে ৫ হাজার টাকা পর্যন্ত অগ্রিম দিতে হয়।

তার ২ ছেলে রানা ও শোয়েব প্রতিদিন বিকেলে মিরপুর, তালতলা, আগারগাঁও, কল্যাণপুর ও আশেপাশের এলাকার অন্তত ৫০টি কসাইয়ের দোকান থেকে এসব চর্বি সংগ্রহ করেন।

কসাইয়ের দোকান থেকে সংগ্রহ করা চর্বি তারা বাড়িতে নিয়ে যান। এভাবে প্রতিদিন ৫০ টাকা দরে প্রায় ২০০ কেজি পর্যন্ত চর্বি সংগ্রহ করতে পারেন।

প্রতিদিন সন্ধ্যায় বিভিন্ন এলাকার ক্রেতারা তার বাড়িতে গিয়ে বিভিন্ন শিল্প প্রতিষ্ঠানে সরবরাহের জন্য এসব চর্বি কিনে নিয়ে যান। ট্যালো নামে পরিচিত এসব পশুর চর্বি সাধারণত সাবান তৈরিতে ব্যবহৃত হয়।

খালেক বলেন, 'বর্তমানে চর্বির বাজার খুব একটা ভালো চলছে না।'

'গরুর মাংসের দাম বেড়ে যাওয়ার কারণে কসাইরা ক্রেতাদের কাছে মাংসের সঙ্গে মিশিয়ে চর্বিও বিক্রির চেষ্টা করেন। তা ছাড়া, আগে একজন কসাই প্রতিদিন ৪-৫টি পশু জবাই করলেও এখন শুধু একটি বিক্রি করতে পারেন। দাম বৃদ্ধির কারণে মাংসের চাহিদাও উল্লেখযোগ্যভাবে কমে গেছে', বলে জানান তিনি।

তিনি আরও জানান, বর্তমানে অনেক মানুষ এই ব্যবসার সঙ্গে জড়িয়ে পড়ায় প্রতিযোগিতারও সৃষ্টি হয়েছে।

খালেক জানান, এ ব্যবসা করতে গিয়ে তিনি একাধিকবার চাঁদাবাজ ও অপরাধী চক্রের শিকার হয়েছেন। আবার এমনও হয়েছে যে, তার কাছ থেকে চর্বি কেনার পর অনেক অসৎ ব্যবসায়ী তাকে টাকা পরিশোধ করেননি।

বহু বছর ধরে তিনি দেখে আসছেন, অনেক প্রতিবেশী দ্রুত অর্থ উপার্জনের জন্য মাদক ব্যবসাসহ বিভিন্ন অপরাধে জড়িয়ে পড়েছেন। তবে নানা ঘাত-প্রতিঘাত পেরিয়ে তিনি পশুর চর্বি বিক্রিতেই আটকে গেছেন।

তিনি বলেন, 'আমি সব সময় চাই, আমার পরিবারের সদস্যরা সৎপথে জীবনযাপন করুক।'

খালেক জানান, একটি মসজিদ নির্মাণের জন্য তার সঞ্চয় থেকে ২০২২ সালে হেমায়েতপুরে ১৫ লাখ টাকায় ১০ দশমিক ৫ দশমিক ৫ শতাংশ জমি কিনেছেন।

তার স্ত্রী রুকসানা বেগম তাকে এসব কাজে মানসিক ও শারীরিকভাবে সমর্থন দিয়ে আসছেন।

রুকসানা দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, 'আমরা কোনো অপরাধ করছি না, পরিশ্রম করে জীবিকা নির্বাহ করছি, এতেই আমি খুশি।'

রুকসানা অবশ্য জানান, ব্যবসায় আর আগের মতো লাভ নেই। এ ব্যবসা করে যে আয় হয়, তা দিয়ে সংসার চালানো কঠিন।

তাদের ভবনের নিচতলায় দুটি দোকান থেকে পরিবার ভাড়া পায় ২০ হাজার টাকা। এ ছাড়া জেনেভা ক্যাম্পে তারা বিনামূল্যে বিদ্যুৎ ও পানি পান।

খালেক জানান, প্রতি বছর ঈদুল আজহায় তারা ঘরে ঘরে গিয়ে পশুর চর্বি কেনেন। গত বছর প্রায় ৫০ মণ চর্বি পেয়েছিলেন বলেও জানান তিনি।

তবে, মূল্যস্ফীতি ও নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যের মূল্যবৃদ্ধির কারণে অনেকেই পশু কোরবানি না করায় এ বছর হয়তো তেমন লাভ হবে না বলে আশঙ্কা করছেন তিনি।

 

Comments

The Daily Star  | English

Air purifiers for Dhaka: hope or hype?

DNCC to set up 25-30 such industrial devices in public places to curb pollution; experts skeptical

18h ago