তরুণ মজুমদার: চলচ্চিত্রই যার ভালোবাসার বাড়ি

চলচ্চিত্রের শুটিংয়ে তরুণ মজুমদার। ছবি: সংগৃহীত

কেবল বাংলা চলচ্চিত্রই নয়, বিংশ শতকে উপমহাদেশের চলচ্চিত্রের সবচেয়ে স্বর্ণালী অধ্যায়ের জন্ম হয়েছিল কয়েকজন কিংবদন্তি বাঙালি চলচ্চিত্রকারের হাত ধরেই। সেই অধ্যায়ে ছিলেন সত্যজিৎ রায়, ঋত্বিক ঘটক, মৃণাল সেন, তপন সিংহ, অজয় কর, অরবিন্দ মুখোপাধ্যায়, রাজেন তরফদার, নীরেন লাহিড়ী, অসিত সেনের মতো প্রখ্যাত চলচ্চিত্রকারেরা। সেই অধ্যায়টির একটি বড় অংশ জুড়ে ছিলেন আরেক প্রখ্যাত চলচ্চিত্রকার তরুণ মজুমদার। কেবল বাংলা কিংবা উপমহাদেশের চলচ্চিত্রই নয়, বিশ্ব চলচ্চিত্রেও এক অনন্য স্থান দখল করে নিয়েছেন উল্লেখিত চলচ্চিত্রকারেরা। সেই প্রজন্মের সর্বশেষ প্রতিনিধি ছিলেন তরুণ মজুমদার। পর্দায় জীবনের গল্পকে ফুটিয়ে তোলার মুন্সিয়ানা, চিত্রনাট্যের অভিনবত্ব, কাহিনীর চমৎকার সাদৃশ্য, বাস্তবতার নিপুণ চিত্রণ চলচ্চিত্রকার তরুণ মজুমদারকে করে তুলেছে অনন্য।

তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়ের কালজয়ী উপন্যাস গণদেবতাকে কী অবিশ্বাস্যভাবে তিনি ফুটিয়ে তুলেছেন চলচ্চিত্রে। যেখানে আমরা দেখি বিংশ শতাব্দীর দ্বিতীয় দশকে শিল্পায়নের চরম প্রভাব আর ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলনের প্রেক্ষিতে ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে যাওয়া গ্রামবাংলার চিত্র। তারাশঙ্করের উপন্যাস কিংবা গল্প থেকে চিত্রনাট্য রচনা করা একদিকে যেমন ভীষণ পরিশ্রমী কাজ ঠিক তেমনিভাবে পর্দায় ফুটিয়ে তোলাও একপ্রকার রীতিমতো চ্যালেঞ্জ। সত্যজিৎ রায় নিজেই বলেছিলেন, 'তারাশঙ্করের গল্প অতি নির্মম। গ্রামীণ জীবনকে আমরা দৈনন্দিন জীবনের আয়নায় দেখলেও তিনি দেখেছেন অভিঘাত সাদৃশ্য দৃষ্টিতে।'

চলচ্চিত্রকার হিসেবে তরুণ মজুমদারের অভিষেক হয়েছিলো ১৯৫৯ সালে মুক্তি পাওয়া 'চাওয়া পাওয়া' চলচ্চিত্রের মধ্য দিয়ে। তবে সেটি ছিল তিন চলচ্চিত্রকারের সম্মিলনে 'যাত্রিক' গোষ্ঠীর ব্যানারে। যেখানে তরুণ মজুমদার ছাড়াও ছিলেন শচীন মুখোপাধ্যায় ও দিলীপ মুখোপাধ্যায়।

একক পরিচালক হিসেবে তরুণ মজুমদারের যাত্রা শুরু হয়েছিল আলোর পিপাসা চলচ্চিত্রের মধ্য দিয়ে। বনফুলের উপন্যাস 'আলোর পিপাসা' ছিল এই চলচ্চিত্রের মুল পটভূমি। একে একে 'শহর থেকে দূরে', 'বালিকা বধূ', 'নিমন্ত্রণ', 'পরশমণি', 'নিমন্ত্রণ', 'ফুলেশ্বরী'র মতো অসামান্য সব চলচ্চিত্রের জন্ম হলো তার হাতে।

চলচ্চিত্রকার হিসেবে তরুণ মজুমদার অনেকটাই খুঁতখুঁতে ছিলেন। নিজের প্রথম চলচ্চিত্র 'চাওয়া পাওয়া'তে উত্তম সুচিত্রা জুটিকে দিয়ে অভিনয় করালেও পরবর্তীতে আর কোন চলচ্চিত্রে উত্তম সুচিত্রার সঙ্গে কাজ করেননি তরুণ মজুমদার। অথচ তখন উত্তম সুচিত্রা জুটি মানেই চলচ্চিত্রের সাফল্য যেন হাতের মোয়া। কেন আর নেননি তাঁদের এমন প্রশ্নের জবাবে এক সাক্ষাৎকারে তরুণ মজুমদার বলেছিলেন, 'আমার মনে হলো এঁদের নিয়ে কাজ করার যেমন অনেকগুলো সুবিধে আছে, তেমন অসুবিধেও আছে। অসুবিধে মানে হচ্ছে যে, আমি যেরকম ছবি করতে চাই, এতে যেহেতু ওঁরা Stars, আমি যদি খুব সাতসকালে আউটডোর লোকেশনে এঁদের চাই তা হবে না। তারপর এঁদের নিয়ে অনেক টানাটানিও হয়, সবাই চায় এঁদের। আমি চাই ফ্রি আর্টিস্ট। কিন্তু একটি মজার ব্যাপার হলো, ওঁদের জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত আমার সঙ্গে ওঁদের সম্পর্ক ছিল।'

জন্মেছিলেন পূর্ববঙ্গের বগুড়ায়। সালটা ১৯৩১। বাবা বীরেন্দ্রনাথ মজুমদার ছিলেন ঘোর স্বদেশী। বগুড়াতে তাঁরা যেখানে থাকতেন তাঁর পাশেই ছিল দুটি সিনেমা হল। সেই হলে নিয়মিতই আসতো নিউ থিয়েটার্স, বোম্বে টকিজের ছবি। স্কুল পালিয়ে নিয়মিতই সিনেমা দেখতে যেতেন তরুণ মজুমদার।

চলচ্চিত্র দেখতে গিয়ে একটি মজার বিষয়ই পরবর্তীতে চলচ্চিত্রকার হওয়ার ইচ্ছে বুনে দিয়েছিলো তরুণ মজুমদারকে। এক সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন, 'যখন অন্ধকার হলে পর্দায় ছবি দেখছি তখন আমার অজান্তেই ওই পাত্রপাত্রীদের নিয়ে আমি অন্য একটা গল্প বুনতে শুরু করতাম। অনেকক্ষণ পরে আমার খেয়াল হতো, আরে! আমি তো মূল সিনেমা থেকে সরে এসেছি। পুরোটাই নিজের মতো করে ভাবছি।'

চৌদ্দ বছর বয়সেই পরিবারের সঙ্গে বগুড়া ছেড়ে কলকাতায় চলে আসেন তরুণ মজুমদার। ভর্তি হন স্থানীয় এক স্কুলে। পরবর্তীতে স্কটিশ চার্চ কলেজ থেকে রসায়নে স্নাতক।

স্নাতক পাশের কিছুদিন পর একদিন হঠাৎ তরুণ মজুমদার খবর পেলেন মেট্রো সিনেমার গলিতে সাইক্লোস্টাইলে ছাপানো চলচ্চিত্রের স্ক্রিপ্ট বা চিত্রনাট্য বিক্রি হয় খুব সস্তায়। একদিন তিনি গিয়েও দেখলেন রাস্তার ধারে কিছু ছেলেপেলে স্ক্রিপ্ট ঢেলে অবহেলায় বিক্রি করছে। দুই আনায় কেনা প্রতিটি চিত্রনাট্য আর সে সময়কার পত্রিকা ও ম্যাগাজিন পড়তে গিয়েই চলচ্চিত্র সম্পর্কে বেশ জানাশোনা হয় তরুণ মজুমদারের। চিত্রনাট্য লেখার কৌশল ও রপ্ত করে ফেললেন ধীরে ধীরে।

তাঁর মামা ছিলেন চলচ্চিত্রের লাইনের। একদিন মামাকে তিনি বললেন, 'আমি ফিল্মি লাইনে যোগ দিতে চাই।'তাঁর পরিবার উদারতান্ত্রিক হওয়ায় পরিবারের সায় ছিল। তাঁর বাবা শুনে বলেছিলেন, 'মন যেদিকে চায় তুমি সেদিকে কাজ করো। আমরা ঠিক চালিয়ে নেব।' সেই মামাই তাঁকে এক পরিচিত ফিল্ম স্টুডিওর মালিকের কাছে নিয়ে গেলেন।

প্রথম পরিচয়ের পর সেই স্টুডিওর মালিক বলেছিলেন, মাইনে দিতে পারব না তবে তুমি ক্যামেরা ডিপার্টমেন্টে অবজারভার হয়ে থাকতে পারো। যদিও কেননা ডিরেকশন ডিপার্টমেন্টে বাইরের ডিরেক্টর এসে কাজ করেন, সেখানে আমার কোনো কথা খাটবে না।' তাঁকে ক্যামেরা স্টুডিও থেকে নেওয়া হয়।

প্রথম দিকে সংকোচ আর লজ্জায় এক কোণে দাঁড়িয়ে থাকতেন তিনি। যখন খাবার সময় হতো তখন তিনি আস্তে সরে যেতেন। কদিন পরে দেখা গেল তাঁকে নিয়ে বেশ চাঞ্চল্যের সৃষ্টি হয়েছে। স্টুডিওর এক সাউন্ড রেকর্ডিস্ট এসে বলেছিলেন, 'আপনি এখানে কেন ঘোরাফেরা করছেন, আপনি তো আমাদের অ্যাসোসিয়েশনের মেম্বার নন। ফলে এখানে খুব একটা সুবিধে হবে না।'

তখন সিটিএবি নামের চলচ্চিত্রের টেকনেশিয়ানদের একটি সংস্থা ছিল। তরুণ মজুমদার বললেন,

'আচ্ছা আমি যদি মেম্বার হই তবে হবে?' লোকটি বলল 'এখন আর মেম্বার নেওয়া হচ্ছে না, কারণ এমনিতেই চারদিকে অনেক বেকার ঘুরে বেড়াচ্ছে। সুতরাং আপনার কাজ করা চলবে না।'

সে দফা স্টুডিও মালিকও বিরস বদলে এসে বললেন, 'দেখতেই তো পাচ্ছেন কী অবস্থা! এখন আর আমার কিছু করার নেই।' অগত্যা অপমানবোধে স্টুডিও ছেড়ে বেরিয়ে এলেন তরুণ মজুমদার। কিন্তু হাল ছাড়লেন না তরুণ মজুমদার।

পাছে চাকরিতে ঢুকলে চলচ্চিত্রের সঙ্গে চিরকালের জন্য বিচ্ছিন্ন হয়ে যাবেন এই ভয়ে চাকরিতেও ঢুকতে পারছেন না তিনি। অথচ তাঁর কাছে বড় বেতনের চাকরির প্রস্তাবও ছিল। কেবল চলচ্চিত্রের সঙ্গে যোগাযোগটা রাখা যাবে তাই অল্প বেতনে একটি চলচ্চিত্র প্রচারণা কোম্পানিতে ঢুকলেন তরুণ মজুমদার।

চলচ্চিত্রের প্রচারণার জন্য সেই কোম্পানিতে নিয়মিতই আসতেন কানন, দেবী দেবকী বসুর মতো অভিনয়শিল্পীরা।

এরপর ধীরে ধীরে তাঁদের সঙ্গে আলাপ হয় তরুণ মজুমদারের। শেষ পর্যন্ত একদিন কানন দেবীই তরুণ মজুমদারকে বললেন, 'আমি শুনেছি যে, আপনার ফিল্মে আসার ইচ্ছে আছে। আপনি আমার অর্গানাইজেশন শ্রীমতী পিকচার্সে অ্যাপ্রেন্টিস হিসেবে জয়েন করুন। আমার দুজন অ্যাসিস্ট্যান্ট আছে। আমি তো মাইনে দিয়ে রাখতে পারব না, কিন্তু আপনি অ্যাপ্রেন্টিস হিসেবে কাজ করুন।'

এরপর শ্রীমতী পিকচার্সে অ্যাপ্রেন্টিস হিসেবে যোগ দিলেন তরুণ মজুমদার। পরের দিকে সেই কোম্পানিটি পারিশ্রমিক দিতে চাইলেও প্রথমে নেননি তরুণ মজুমদার। তাঁর শঙ্কা ছিল, যদি এই সুন্দর সম্পর্কের মধ্যে টাকা পয়সা এসে পড়ে তা নষ্ট করে দেয়।

শ্রীমতী পিকচার্সে শিক্ষানবিশ হিসেবে বাকি যে দুজন ছিলেন তারা হলেন শচীন মুখোপাধ্যায় ও দিলীপ মুখোপাধ্যায়। তিনজনই মনে মনে সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন, তাঁরা চলচ্চিত্র বানাবেন। আর তাই তরুণ মজুমদার সহ তিনজনে গড়লেন যাত্রিক গোষ্ঠী। কানন দেবীকে এই ভাবনার কথা বলতে শুভকামনা জানিয়েছিলেন কানন দেবীও।

১৯৫৮ সালে শ্রীমতী পিকচার্সের প্রযোজনায় মুক্তি পেয়েছিলো 'রাজলক্ষ্মী চলচ্চিত্র'। এই চলচ্চিত্রে জুটি বেঁধেই অভিনয় করেছিলেন উত্তম-সুচিত্রা জুটি। সেই চলচ্চিত্রের শুটিংয়ে সুচিত্রা সেন ও উত্তম কুমারের সঙ্গে দারুণ সম্পর্ক গড়ে উঠেছিলো তরুণ মজুমদারের। দুজনেই আলাদাভাবে তরুণ- শচীন-দিলীপকে ডেকে বলেছিলেন, 'আপনারা যদি কখনো নিজের ছবি ডিরেকশন দেন আর আমাদের প্রয়োজন হয়, তবে আমরা আছি।'

তরুণ মজুমদার ভেবেছিলেন এটি হয়তো কথার কথা। কিন্তু সেদিন রাতে উত্তম কুমার তাঁদের ডেকে বলেছিলেন, 'আমি কিন্তু তখন এমনি এমনি বলিনি। সত্যি সত্যি বলেছি। যদি দরকার হয় তো বলবেন।'

ঠিক তাদের কথাই রইলো সর্বশেষ। পরের বছরই টাইম ফিল্মসের প্রযোজনায় মুক্তি পেল যাত্রিক গোষ্ঠীর প্রথম চলচ্চিত্র 'চাওয়া পাওয়া' । যেখানে মুখ্য অভিনেতা অভিনেত্রীর ভূমিকায় অভিনয় করলেন উত্তম কুমার এবং সুচিত্রা সেন। আর ফলাফল চলচ্চিত্রটি ছিল সুপারহিট। আর এর পরে তরুণ মজুমদার একাই যা করলেন তা তো ইতিহাসই বলা চলে।

মৃণাল সেনের পর বাংলা চলচ্চিত্রের চলচ্চিত্রকারদের মধ্যে সবচেয়ে দীর্ঘায়ু জীবন পেয়েছিলেন তরুণ মজুমদার। একক চলচ্চিত্রকার হিসেবে তাঁর চলচ্চিত্রের কর্মজীবন ছিল মৃণাল সেনের চেয়েও বেশী, তথা ৫৩ বছর। বলা বাহুল্য যে বাংলা চলচ্চিত্রে তাঁর চলচ্চিত্রের কর্মময় জীবনের সমান আয়ু ও অনেক প্রখ্যাত চলচ্চিত্রকার পাননি। তাইতো মৃত্যুর চার বছর আগে ৮৭ বছর বয়সেও তিনি নির্মাণ করেছেন চলচ্চিত্র 'ভালোবাসার বাড়ি'। আদতে তরুণ মজুমদারের মনপ্রাণ, অন্তরাত্মার পুরোটা জুড়ে কেবলই ছিল চলচ্চিত্র নামের ভালোবাসার বাড়িটি।

গত বছরের আজকের দিনে চলে গিয়েছিলেন বাংলা চলচ্চিত্রের স্বর্ণালী অধ্যায়ের শেষ প্রতিনিধি তরুণ মজুমদার। প্রয়াণ দিবসে তাঁর প্রতি রইলো বিনম্র শ্রদ্ধা।

সূত্র- সিনেমাপাড়া দিয়ে/ তরুণ মজুমদার

তরুণ মজুমদারের সাক্ষাৎকার: মুখোমুখি তরুণ মজুমদার/ কালি ও কলম। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন সুশীল সাহা ও শৌভিক মুখোপাধ্যায়।

[email protected]

Comments

The Daily Star  | English

Rampal fouling 2 Sundarbans rivers

The Rampal power plant began operation in late 2022 without an effluent treatment plant and has since been discharging untreated waste into the Pasur and Maidara rivers next to the Sundarbans.

4h ago