গল্প নয় বাস্তব: ধোঁয়াশায় ঘেরা ‘মোসাদ’

স্পাইদের জীবন এতটাই রহস্যজনক যে, তাদের নিয়ে নিত্যনতুন ‘ফ্যান থিওরি’ কিংবা বারোমাসেই চলতে থাকে আষাঢ়ে গল্প বোনা। এমনই এক স্পাই এজেন্সি (গোয়েন্দা সংস্থা) ইসরায়েলের ‘মোসাদ’। যার নাম শুনলেই ইন্টেলিজেন্স জগতের লোকজন নড়েচড়ে বসেন, সাধারণ মানুষের চোখেও আগ্রহের ঝিলিক ফুটে ওঠে।
ইসরায়েলের গোয়েন্দা সংস্থা মোসাদের লগো। ছবি: সংগৃহীত

'স্পাই' শব্দটি গল্প-সাহিত্যে হোক কিংবা বাস্তবে, রহস্যের ধোঁয়াজাল বিস্তৃত থাকে অনেকখানি। সাধারণ মানুষদের ভিড়ে স্পাইদের একটু অসাধারণের মাপকাঠিতেই মাপা হয়। এর অন্যতম কারণ তাদের ঘিরে থাকা গোপন জীবনের আভাস। স্পাইদের জীবন এতটাই রহস্যজনক যে, তাদের নিয়ে নিত্যনতুন 'ফ্যান থিওরি' কিংবা বারোমাসেই চলতে থাকে আষাঢ়ে গল্প বোনা।

এমনই এক স্পাই এজেন্সি (গোয়েন্দা সংস্থা) ইসরায়েলের 'মোসাদ'। যার নাম শুনলেই ইন্টেলিজেন্স জগতের লোকজন নড়েচড়ে বসেন, সাধারণ মানুষের চোখেও আগ্রহের ঝিলিক ফুটে ওঠে।

মোসাদ কী এবং কেন

বিশ্বের বিভিন্ন দেশে সরকারি গোয়েন্দা সংস্থার কাজ যা হয়, ইসরায়েলের ক্ষেত্রেও মোসাদের ভূমিকা তাই। সহজ কথায়, রাষ্ট্রের বুদ্ধিবৃত্তিক সুরক্ষা প্রদান এবং সে অনুযায়ী সর্বত্র ব্যাঙের ছাতার মতো নজর বিছিয়ে রাখার মাধ্যমে ইসরায়েলের স্বার্থরক্ষা করে মোসাদ।

বিভিন্ন গুপ্তচরবৃত্তিক অপারেশন, গোপন তথ্য সংগ্রহ, সেসব তথ্য বিশ্লেষণ এবং উগ্রপন্থা প্রতিরোধে ভূমিকা রাখে সংস্থাটি। ধারণা করা হয়, মোসাদে নিযুক্ত কর্মীর সংখ্যা ৭ হাজারের আশপাশে। তবে সংস্থাটির গোপনীয়তা রক্ষায় সাফল্য আছে বলেই সংখ্যা নিশ্চিত হওয়া সম্ভব নয়। এমনকি, মোসাদের সদরদপ্তর কোথায় জানা যায় না, যোগাযোগের জন্যও নেই কোনো টেলিফোন নম্বর।

ইসরায়েলের আইন অনুযায়ী মোসাদের প্রধানের নামই শুধু জানা যায়। বর্তমানে এই সংস্থার প্রধান হলেন ডেভিড বার্নিয়া। ২০২১ সাল থেকে তিনি এই পদে আসীন রয়েছেন।

ডেভিড মেইডান নামে অবসরপ্রাপ্ত এক স্পাইমাস্টার তার মোসাদকালীন অভিজ্ঞতা থেকে বলেন, 'মোসাদে নিয়োগকৃত সব কর্মীকেই নিজের সবল স্নায়ুর পরিচয় দিতে হবে এবং এই সবলতা নিঃসন্দেহে সাধারণের মাপকাঠির বহু উঁচুতে। উচ্চপর্যায়ের ভয় ও মানসিক চাপেও স্বাভাবিক থাকতে পারা মোসাদের কর্মী হওয়ার অন্যতম শর্ত।'

মোসাদ কোনো অপরাধীকে তাদের কর্মী হিসেবে স্থান দেয় না। কিন্তু একইসঙ্গে শুধু মোসাদ এজেন্ট হতে গেলেই একজন ব্যক্তিকে ভীষণ লুকোছাপার জীবন কাটাতে হয়, ব্যক্তি পরিসরে আশ্রয় নিতে হয় বহু প্রতারণারও।

সেক্ষেত্রে 'অপরাধ' এর সংজ্ঞায়ন কিছুটা ধোঁয়াটে মনে হতে পারে বৈকি। ব্যক্তিজীবন বলে কিছু থাকবে না, এমনটা ধরে নিয়েই যারা এগিয়ে যান, হয়তো তারাই কাজ করে চলেছেন মোসাদ কিংবা এমন সব গোপন গোয়েন্দা সংস্থার কর্মী হিসেবে।

মোসাদ-ইহুদি সমীকরণ

মোসাদে কারা নিয়োগ পায় বা পেতে পারে, এ বিষয়টি নিয়ে অনেকেরই অনেক তত্ত্বকথা থাকতে পারে। তবে মোসাদের ওয়েবসাইটে ঢুঁ মারলে মনে হয় এর নিয়োগ প্রক্রিয়া অত্যন্ত 'উদার', কেননা সেখানে লেখা রয়েছে- 'ধর্ম-বর্ণ, জাতীয়তা ও পেশা নির্বিশেষে আমাদের সংস্থা মোসাদে যোগাযোগ করতে এবং ব্যক্তিগত লাভ অর্জনের জন্য ইসরায়েলি কর্মকাণ্ডে যুক্ত হতে সবাইকে স্বাগত'।

কিন্তু এত উদার আহ্বান কি প্রকৃতার্থেই সত্যি, নাকি এর ভেতরেও আছে রহস্যের বাড়তি পরত? যে রহস্যের গন্ধ থেকেই জন্ম নিয়েছে আরও একটি প্রশ্ন– মোসাদ কি শুধু ইহুদিদেরই নিয়োগ দেয়?

আর এ প্রশ্নের উত্তর খুঁজতেও ঘাটতে হবে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের রক্তক্ষয়ী ইতিহাস, যেখানে হিটলার আর তার নাৎসি বাহিনী বেছে বেছে ইহুদিদের নিধনযজ্ঞে মেতেছিল। প্রায় ৬০ লাখ ইহুদি জীবন হারানোর পর ১৯৪৮ সালের দিকে 'ইসরায়েল' নামে যে রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠা হয়, সেখানে খ্রিস্টান, মুসলিম, ইহুদি সবার বসবাস থাকলেও পক্ষপাতের দণ্ডটা ইহুদিদের দিকেই হেলে থাকতে দেখা গেছে সবসময়। আর ইসরায়েল রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার খুব কম দিনের মধ্যেই যেহেতু মোসাদেরও যাত্রা শুরু, রাষ্ট্রটির ভিত্তির সঙ্গে মোসাদের ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে থাকাকে এড়ানো যায় না কোনোভাবেই।

বিশ্বে সরকারি-বেসরকারি গোয়েন্দা সংস্থার কমতি নেই, তবু এত এত সংস্থার ভিড়ে মোসাদের গায়ে প্রায়ই জোটে 'বিশ্বের সবচেয়ে ভয়ানক, নিষ্ঠুর ও দুর্ধর্ষ গোয়েন্দা সংস্থা'র তকমা। এ সংস্থার প্রতিষ্ঠাতার অপর নাম ছিল মোসাদ।

১৯৪৮ সালের ১৩ ডিসেম্বর ইসরায়েলের প্রতিষ্ঠাতা মনে করা হয় যাকে, সেই ডেভিড বেন গুরিয়নের হাতে মোসাদ প্রতিষ্ঠিত হয়। এই ব্যক্তি ছিলেন জায়নিজমের ধ্বজাধারী এবং হিব্রু ভাষাকে ইসরায়েলের মাটিতে রাষ্ট্রীয় ভাষার মর্যাদা দানকারী।

মোসাদের বিভিন্ন গোপন ও প্রকাশিত উদ্দেশ্যগুলো থেকে সংক্ষেপে যে নির্যাস সেঁচে আনা যায়, তা থেকে বলা চলে– ইসরায়েলের বাহির ও ভেতরে গোপন সব তথ্যের সংগ্রহ ও সংরক্ষণ, শত্রুরাষ্ট্র এমনকি শত্রুতার ভাব আছে এমন রাষ্ট্রগুলোর সামরিক খবরাখবর সম্পর্কে সদা সচেতন থাকা, ইসরায়েলের যেকোনো অঞ্চল বা স্থানে আক্রমণ সম্পর্কে আগে থেকেই সতর্ক হওয়া এবং আগাম প্রতিরোধ গড়ে তোলা ইত্যাদি।

এসব মৌলিক বিষয় ছাড়াও শুধু 'ইহুদি' সংক্রান্ত বিশেষ কার্যক্রমও পরিচালনা করতে হয় মোসাদকে। ইসরায়েল যেহেতু শুরু থেকেই ইহুদিদের জন্য মুক্তদ্বার রাষ্ট্র, সেক্ষেত্রে ইহুদিদের অনায়াসে আগমনে মোসাদও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে।

যেসব রাষ্ট্রে ইসরায়েলের অভিবাসন সংস্থা আইনিভাবে কার্যকর নয়, সেসব রাষ্ট্র থেকে ইহুদিদের ইসরায়েলে নিয়ে যায় মোসাদ। সেক্ষেত্রে এই বাড়তি ইহুদিদের মোসাদ নিজের কাজে যুক্ত করে কি না– সে প্রশ্ন মাথায় আসাও খুব স্বাভাবিক। কিন্তু গোপন রহস্যের জালে ঘেরা মোসাদ থেকে অন্য আর সব না জানা উত্তরের মতো এটিও বোধহয় উৎসুক পাঠকের অনুমানের ওপরই ছেড়ে দেওয়া সমীচীন।

মোসাদের সাফল্য-ব্যর্থতা

মোসাদের দিনলিপিতে সফল অভিযানের সংখ্যা অপেক্ষাকৃত বেশি, তা বললে ভুল হবে না। আবার এমনটাও হওয়া অসম্ভব নয় যে, নিজেদের ঘিরে চলমান রহস্যকে জিইয়ে রাখতে সাফল্যের গল্পগুলোই বেশি ছড়িয়ে দেয় তারা।

সে যাই হোক, মোসাদের সাফল্যের কথা বলতে গেলে ১৯৬০ সালের 'অপারেশন ফিনালে', ১৯৬২ সালে নাৎসি বিজ্ঞানীদের বিরুদ্ধে মোসাদের অভিযান, ১৯৬৬ সালে 'অপারেশন ডায়মন্ড' তথা ফাইটার জেট ছিনতাই– এমন বহু ঘটনাই আসবে।

অন্যদিকে, ব্যর্থতার দৃষ্টান্ত হিসেবে ১৯৯৭ সালে মোসাদের 'কিল খালিদ' অপারেশনে হামাসের প্রধান খালিদ মিশালকে বিষপ্রয়োগে হত্যা করতে গিয়ে ইসরায়েলের ২ ভুয়া পাসপোর্টধারী এজেন্ট জর্ডানে ধরা পড়ে। তাই শেষমেশ খালিদকে বাঁচিয়ে তুলতে হয় ইসরায়েল সরকারকেই।

এমন বহু রোমহর্ষক গল্প-বাস্তবকে সঙ্গে নিয়ে চলা মোসাদকে নিয়ে লেখা হয়েছে বেশ কিছু বই, তৈরি হয়েছে চলচ্চিত্র। ২০০৫ সালে মুক্তিপ্রাপ্ত স্টিভেন স্পিলবার্গের 'মিউনিখ' সিনেমাটি মোসাদকে নিয়ে এযাবৎ নির্মিত সবচেয়ে আকর্ষণীয় সিনেমার কাতারে থাকবে। এর প্রেক্ষাপট ছিল 'অপারেশন র‌্যাথ অব গড'।

তথ্যসূত্র:

১. britannica

২. israelradar

৩. reuters

৪, mossad

৫. go.gale

৬. indiatimes

 

Comments

The Daily Star  | English

Personal data up for sale online!

A section of government officials are selling citizens’ NID card and phone call details through hundreds of Facebook, Telegram, and WhatsApp groups, the National Telecommunication Monitoring Center has found.

31m ago