সরকার কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় ও গবেষণা প্রতিষ্ঠানের বাজেট-সক্ষমতা বাড়িয়েছে: প্রধানমন্ত্রী

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। ছবি: পিআইডি

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা খাদ্য ও সার রপ্তানির ওপর থেকে বিধিনিষেধ তুলে নিতে সমন্বিত পদক্ষেপ গ্রহণের ওপর জোর দিয়ে বিশ্বব্যাপী টেকসই, নিরাপদ ও পুষ্টিকর খাদ্য ব্যবস্থা নিশ্চিত করতে জাতিসংঘের 'খাদ্য ব্যবস্থা' সম্মেলনে ৫ দফা প্রস্তাব উত্থাপন করেন। তিনি আধুনিক কৃষিতে বিনিয়োগের জন্য বহুপাক্ষিক উন্নয়ন ব্যাংক ও বেসরকারি উদ্যোক্তাদের উৎসাহিত করার প্রয়োজনীয়তার ওপরও গুরুত্বারোপ করেন।

প্রধানমন্ত্রী এই সম্মেলনে গতকাল জলবায়ু ঝুঁকিপূর্ণ অঞ্চলে জলবায়ু-সহনশীল খাদ্য জোটকে সক্রিয় করার পাশাপাশি কার্যকর কৃষি-খাদ্য প্রযুক্তির অংশীদারিত্ব জোরদার করতে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন।

তিনি বলেন, 'আমাদের জলবায়ু-সহনশীল খাদ্য ব্যবস্থার জন্য জোট সক্রিয় করতে হবে, ২০২১ সালের জাতিসংঘ খাদ্য ব্যবস্থা শীর্ষ সম্মেলনে যার সহ-নেতৃত্ব প্রদানে বাংলাদেশ সম্মত হয়েছিল।' প্রধানমন্ত্রী এখানে এফএও সদর দপ্তরে জাতিসংঘ খাদ্য ব্যবস্থা সামিট + ২ স্টকটেকিং মোমেন্ট সম্মেলনে 'খাদ্য ব্যবস্থা ও জলবায়ু কর্মপন্থা' বিষয়ক পূর্ণাঙ্গ অধিবেশনে তার উত্থাপিত ৫টি প্রস্তাবের একটিতে এটি উল্লেখ করেছেন।

তিনি প্রস্তাব করেন, 'উন্নত দেশগুলিকে জলবায়ু-অভিযোজিত কৃষি-খাদ্য ব্যবস্থার প্রতি যথাযথ মনোযোগ দিয়ে জলবায়ু অর্থায়নের জন্য খাদ্য ব্যবস্থার রূপান্তরকে অগ্রাধিকার হিসেবে বিবেচনা করতে হবে।' এ ছাড়া অন্য এক প্রস্তাবে শেখ হাসিনা বলেন, 'জাতিসংঘ খাদ্য ব্যবস্থা সমন্বয় কেন্দ্রকে গবেষণা ও উদ্ভাবনে আন্তঃশৃঙ্খলা সহযোগিতার মাধ্যমে জ্ঞান-ব্যবস্থাপনা বাড়াতে হবে।'

আর এক প্রস্তাবে তিনি বলেন, 'নিম্ন ও মধ্যম আয়ের দেশগুলোতে খাদ্য ও সারের চাহিদার নিরিখে জলবায়ু-ইতিবাচক সমাধান প্রচারে বেসরকারি খাতকে সক্রিয়ভাবে সম্পৃক্ত করতে হবে।'

বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী আরও প্রস্তাব করেছেন যে 'ডেল্টা এবং উপকূলীয় অঞ্চলের মতো জলবায়ু ঝুকিপূর্ণ অঞ্চলে কার্যকর কৃষি-খাদ্য প্রযুক্তি ব্যবহারের জন্য আন্তর্জাতিক অংশীদারিত্ব জোরদার করা দরকার।'

আধুনিক কৃষি-খাদ্য সরবরাহ ব্যবস্থা বিশ্বব্যাপী গ্রিন হাউস গ্যাস নির্গমনের অন্যতম বড় অবদানকারী হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, 'আমাদের খাদ্য উৎপাদন, প্রক্রিয়াকরণ, ব্যবহার এবং সুষ্ঠু বিন্যাস জলবায়ু-নিরপেক্ষ করতে বিনিয়োগ করা উচিত।'

তিনি বলেন, 'এর জন্য অবশ্য আমাদের যথেষ্ট রাজনৈতিক সদিচ্ছা ও আন্তর্জাতিক জনমত প্রয়োজন।'

বাংলাদেশ সম্প্রতি গ্লোবাল মিথেন অঙ্গীকারে যোগদান করেছে উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, 'আমরা আশা করি, এই উদ্যোগের প্রধান পৃষ্ঠপোষকরা তাদের প্রতিশ্রুত আর্থিক ও প্রযুক্তিগত সহায়তা নিয়ে আসবে।'

তিনি বলেন, তার সরকার জি-২০ প্রস্তাবিত আন্তর্জাতিক বায়ো-ফুয়েল অ্যালায়েন্সের মতো করে উন্নয়নগুলো অনুসরণ করছে।

'আমরা আমাদের ক্ষুদ্র চাষিদের দ্বারাও সেচের জন্য সৌর বিদ্যুতের ব্যবহারকে উৎসাহিত করছি। আমাদের কৃষি, কম নির্গমনকারী পশুসম্পদ এবং বর্জ্য ব্যবস্থাপনার জন্য সাশ্রয়ী প্রযুক্তিতে প্রবেশাধিকার দরকার।'

প্রধানমন্ত্রী বঙ্গোপসাগরে বাংলাদেশের সামুদ্রিক এলাকায় টেকসই গভীর সমুদ্রে মাছ ধরার জন্য বিদেশি বিনিয়োগের আমন্ত্রণ জানান। জলবায়ু সংকটের জন্য একটি টেকসই ও রূপান্তরিত খাদ্য ব্যবস্থায় কাজ করা প্রয়োজন উল্লেখ করে তিনি বলেন, 'আর বিলম্ব না করে কী করা দরকার, তা আমাদের চিহ্নিত করতে হবে। খাদ্য নিরাপত্তা এখন জলবায়ু ন্যায়বিচারের সঙ্গে সম্পর্কিত।'

বিশ্বের বিভিন্ন স্থানে ক্রমবর্ধমান তাপমাত্রা, দীর্ঘস্থায়ী খরা, ব্যাপক বন্যা এবং পরিবর্তনশীল বৃষ্টিপাতের কথা উল্লেখ করে শেখ হাসিনা বলেন, 'বাংলাদেশে আমাদের উপকূলীয় ভূমিতে সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধি এবং লবণাক্ততা অনুপ্রবেশের ফলে ধান উৎপাদনে বিরূপ প্রভাব পড়েছে। নদীভাঙন, নগরায়ণ, শিল্প প্রবৃদ্ধি এবং অন্যান্য কারণের কারণে বাংলাদেশে প্রতি বছর আবাদি জমি হ্রাস পাচ্ছে।'

প্রধানমন্ত্রী বলেন, ১৯৭১ সালে আমাদের স্বাধীনতার পরপরই বাংলাদেশের জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান 'সবুজ বিপ্লবের' ডাক দিয়েছিলেন। এ প্রসঙ্গে তিনি আরও বলেন, এখন আবার জলবায়ু-স্মার্ট 'কৃষি-খাদ্য বিপ্লবের' সময় এসেছে। কৃষি খাতকে রূপান্তর করতে প্রকৃতি-ইতিবাচক সমাধান এবং উন্নত প্রযুক্তি উভয়ই প্রয়োগ করতে হবে। কৃষি ও খাদ্য উৎপাদনে আমাদের কঠোর অর্জনের ফলে, বাংলাদেশকে অনন্যভাবে বিশ্বব্যাপী এসব বিষয়ে নেতৃত্ব দেওয়ার জন্য স্থান দেওয়া হয়েছে।

তিনি বলেন, 'আমি মুগ্ধ যে কপ ২৮-এর মনোনীত প্রেসিডেন্ট এই ইস্যুর চ্যাম্পিয়ন হিসেবে গত সপ্তাহে ব্যক্তিগতভাবে আমাকে আমন্ত্রণ জানিয়েছেন।'

শেখ হাসিনা বাংলাদেশের প্রচেষ্টার কথাও তুলে ধরেন যেখানে এর কৃষি বিজ্ঞানী এবং সম্প্রসারণ কর্মকর্তারা কৃষকদের সঙ্গে জলবায়ু-সহনশীল কৃষি-খাদ্য সমাধানের উন্নয়নে কাজ করছেন।

তিনি বলেন, 'আমাদের সরকার আমাদের কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ে এবং গবেষণা প্রতিষ্ঠানের বাজেট ও সক্ষমতা উল্লেখযোগ্যভাবে বৃদ্ধি করেছে।'

তিনি বলেন, তার সরকারের শাসনামলে গত ১৪ বছরে মোট ৬৯০টি উন্নত ও উচ্চ ফলনশীল ফসলের জাত উদ্ভাবন বা প্রবর্তন করা হয়েছে। চাপ সহনশীল ধানের জাতগুলোর মধ্যে লবণাক্ততা প্রতিরোধী ১৪টি, পানিতে তলিয়ে যাওয়া ৬টি, খরার প্রতি ১০টি, ঠান্ডা আবহাওয়ার জন্য ৪টি এবং ৭টি প্রধান মানের।

তিনি বলেন, 'আমাদের বিজ্ঞানীরা দীর্ঘায়িত জলাবদ্ধতা এবং খরা প্রতিরোধী ধানের জাত নিয়ে কাজ করছেন। পুষ্টির উন্নতির জন্য, আমরা অ্যান্টি-অক্সিডেন্ট, ডায়াবেটিক ও প্রো-ভিটামিন জাতসহ ৮টি জিঙ্ক সমৃদ্ধ ধানের জাত প্রবর্তন করেছি।' তিনি উল্লেখ করেন যে, তার সরকার ভাসমান কৃষি, ছাদে কৃষি, রান্নাঘর বাগান, প্রসারে প্রণোদনা ও সহায়তা দিচ্ছে। হাইড্রোপনিক এবং অ্যারো-পনিক কৃষি বাংলাদেশের দক্ষিণাঞ্চলের ঐতিহ্যবাহী ভাসমান সবজি উৎপাদন পদ্ধতি এখন স্থানীয়ভাবে পরিচালিত জলবায়ু অভিযোজনের অন্যতম সেরা উদাহরণ হিসেবে বিবেচিত হয়।

শেখ হাসিনা বলেন, বাংলাদেশ তার কৃষকদের সহায়তার জন্য ডিজিটাল প্রযুক্তির সর্বোচ্চ ব্যবহার করছে।

এ লক্ষ্যে তিনি বলেন, তার সরকার সারাদেশে প্রায় ৫০০ কৃষি তথ্য ও যোগাযোগ কেন্দ্র স্থাপন করেছে। কৃষকরা একটি নির্দিষ্ট ফোন নম্বরে কল করে প্রাসঙ্গিক তথ্য চাইতে পারেন। ডেডিকেটেড ওয়েবসাইট এবং কমিউনিটি রেডিও কৃষি বিষয়ক তথ্য প্রদান করে। অনলাইনে সার সুপারিশ, সেচ পরিষেবা, কীটনাশক প্রেসক্রিপশন, ক্রপ-জোনিং অ্যাডভাইজরি, রাইস নলেজ ব্যাংক এবং অন্যান্য পরিষেবার ব্যবস্থা করা হয়েছে।

তিনি বলেন, সরকারি অ্যাপের পাশাপাশি কৃষি-প্রযুক্তি স্টার্ট-আপদের দেওয়া পরিষেবাও তৃণমূলে জনপ্রিয়তা পাচ্ছে।

প্রধানমন্ত্রী বলেন, গত ১৪ বছরে তাদের বিশেষজ্ঞরা ৬৪২টি নতুন প্রযুক্তি উদ্ভাবন ও প্রবর্তন করেছেন এবং এগুলো শক্তি, পানি, সার, বীজ ও কীটনাশক ব্যবহারের দক্ষতা বাড়াতে সাহায্য করেছে। তিনি বলেন, 'আমরা সাব-সাহারান আফ্রিকা এবং অন্যত্র জলবায়ু-চাপযুক্ত সেটিংসের সঙ্গে আমাদের দক্ষতা ভাগ করে নিতে প্রস্তুত আছি।'

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বক্তৃতা দেওয়ার সময় এফএও সদর দপ্তরের পূর্ণাঙ্গ অধিবেশ কক্ষে এবং আরও ২টি হলে বিপুল সংখ্যক শ্রোতা উপস্থিত ছিলেন। অংশগ্রহণকারীরা হাততালি দিয়ে তার বক্তব্যকে সমর্থন করেন।

সম্মেলনের আনুষ্ঠানিক উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে ইতালির প্রধানমন্ত্রী জর্জিয়া মেলোনি, ইথিওপিয়ার প্রধানমন্ত্রী আবি আহমেদ, নেপালের প্রধানমন্ত্রী পুষ্প কমল দাহাল, সামোয়া ফিয়ামের প্রধানমন্ত্রী নাওমি মাতাফা এবং জাতিসংঘের মহাসচিব আন্তোনিও গুতেরেস বক্তৃতা করেন।

Comments

The Daily Star  | English

CA approves draft Anti-Terrorism Ordinance

Chief Adviser Prof Muhammad Yunus today approved the draft of the Anti-Terrorism (Amendments) Ordinance 2025 in a special meeting of the advisory council at the state guest house Jamuna..The advisory council gave both policy and final approval to the ordinance, which includes provisions to

Now