প্রস্তাবিত সাইবার নিরাপত্তা আইন

শুধু নাম বদল করে নতুন আইন করা অর্থহীন: সম্পাদক পরিষদ

সরকার ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের জায়গায় সাইবার নিরাপত্তা আইন করার ব্যাপারে যে নীতিগত সিদ্ধান্ত নিয়েছে তাতে মৌলিক কোনো পরিবর্তনের সম্ভাবনা দেখছে না সম্পাদক পরিষদ। সেই সঙ্গে এই আইন প্রণয়নের আগে গণমাধ্যমের প্রতিনিধিদের মতামত না নেওয়ায় জনমনে উদ্বেগ থেকেই যাচ্ছে বলে মনে করছে দেশের জাতীয় দৈনিকগুলোর সম্পাদকদের সংগঠনটি।

সম্পাদক পরিষদের সভাপতি মাহফুজ আনাম ও সাধারণ সম্পাদক দেওয়ান হানিফ মাহমুদের সই করা এক বিবৃতিতে বলা হয়, 'ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন বাতিল করার ব্যাপারে সরকার যে নীতিগত সিদ্ধান্ত নিয়েছে তাতে এই আইনটি সম্পর্কে সম্পাদক পরিষদসহ সংবাদমাধ্যমের অংশীজনরা এত দিন যে উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা প্রকাশ করে আসছিলেন, সেটা যথার্থ বলে প্রমাণিত হয়েছে।'

নতুন আইন প্রণয়নের আগে সরকার গণমাধ্যমসহ অংশীজনদের মতামত না নেওয়ায় উদ্বেগ তুলে ধরে সম্পাদক পরিষদ বলেছে, 'সরকার সাইবার নিরাপত্তা আইন নামে যেই আইনটি করার ঘোষণা দিয়েছে, তা শেষ পর্যন্ত কী দাঁড়ায় সেটা দেখার অপেক্ষায় আছি। সরকার ২০১৮ সালে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন করার সময় সম্পাদক পরিষদসহ সংবাদমাধ্যমের অংশীজনদের উদ্বেগ আমলে নেয়নি। সেই আইন সংশোধন, বাতিল বা নতুন কিছু করার ক্ষেত্রে অংশীজনদের সঙ্গে আলাপ-আলোচনা ও তাদের মতামত নেওয়া হবে সেটাই প্রত্যাশিত ছিল। কিন্তু অবস্থাদৃষ্টে মনে হচ্ছে সেরকম কিছু না করেই সরকার প্রস্তাবিত সাইবার নিরাপত্তা আইনের খসড়া তৈরি এবং তা আইনে পরিণত করার উদ্যোগ নিচ্ছে। ফলে এ নিয়ে সংবাদমাধ্যমের অংশীজনসহ জনমনে প্রশ্ন দেখা দেওয়া স্বাভাবিক।'

ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের সঙ্গে নতুন প্রস্তাবিত আইনটি চরিত্রগত কোনো পার্থক্য না থাকলে শুধু নাম পরিবর্তন করাকে 'অর্থহীন' অভিহিত করেছে সম্পাদক পরিষদ। তারা বলেছেন, 'আইনমন্ত্রী আনিসুল হকের ভাষ্য থেকে সংবাদমাধ্যমে যেসব তথ্য পাওয়া গেছে, তাতে সম্পাদক পরিষদ শঙ্কামুক্ত হতে পারছে না। কারণ কিছু ক্ষেত্রে শাস্তি কমানো ও অজামিনযোগ্য কিছু ধরা জামিনযোগ্য করা ছাড়া আর কোনো পরিবর্তন হয়েছে বলে প্রতীয়মান হচ্ছে না।'

বিবৃতিতে আরও বলা হয়, 'সংবাদ পরিবেশনের ক্ষেত্রে মানহানির মামলায় সাংবাদিকদের শাস্তি কারাদণ্ডের বদলে ২৫ লাখ টাকা জরিমানার বিধানের কথা বলা হয়েছে। উদ্বেগের বিষয় হলো, দণ্ডবিধি ১৮৬০ এর অধীনে মানহানির দায়ে যে শাস্তির বিধান আছে, সেটা সংশোধন না করা হলে নতুন বিধান অকার্যকর হতে বাধ্য। দ্বিতীয়ত ২৫ লাখ টাকা জরিমানা শোধ না হলে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিকে শেষ পর্যন্ত কারাদণ্ডই ভোগ করতে হবে। সবচেয়ে বড় কথা প্রচলিত ফৌজদারি আইনে যে অপরাধের শাস্তির বিধান রয়েছে, সাংবাদিকতার ক্ষেত্রে যে বিধিবিধান আছে তার পরিবর্তে এসব শাস্তির বিধানের যৌক্তিকতা নিয়ে প্রশ্ন ওঠা স্বাভাবিক।'

'ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের ২১ ও ২৮ ধারা দুটি জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ে মত প্রকাশের স্বাধীনতার পরিপন্থী, রাজনৈতিক প্রতিপক্ষকে হয়রানির হাতিয়ার ও বিভ্রান্তিকর হিসেবে বিবেচিত হওয়ায় ধারা দুটি বাতিলের পক্ষে জোরালো দাবি উঠেছে। শাস্তি কমিয়ে এই দুটি বিধান রেখে দেওয়ায় এর অপপ্রয়োগ ও খেয়ালখুশিমতো ব্যবহারের সুযোগ থেকেই যাবে।'

অফিশিয়াল সিক্রেসি আইনে কোনো বদল না আসার ব্যাপারেও উদ্বেগের কথা তুলে ধরেছে সম্পাদক পরিষদ। তারা বলেছেন, 'উদ্বেগের বিষয় হলো ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের ৩২ ধারাটি রেখে দেওয়া হয়েছে। এই ধারার মাধ্যমে শাস্তির মাত্রা কিছু কমানো হলেও ঔপনিবেশিক আমলের ১৯২৩ সালের অফিশিয়াল সিক্রেটস অ্যাক্টকে রেখে দেওয়া হয়েছে। ঔপনিবেশিক আমলে শাসকগোষ্ঠী এ দেশের মানুষকে সন্দেহ করত বলে অফিশিয়াল সিক্রেটস আইন জারি করেছিল। স্বাধীন বাংলাদেশে এই আইন থাকার কোনো যুক্তি আছে বলে মনে করি না।'

ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের অগ্রহণযোগ্য ধারাগুলো প্রস্তাবিত সাইবার নিরাপত্তা আইনেও থেকে যাচ্ছে বলে উদ্বেগ জানিয়ে তারা বলেন, 'ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের ৪৩ ধারা ধারা অনুযায়ী, পুলিশকে বাসাবাড়িতে প্রবেশ, অফিসে তল্লাশি, লোকজনের দেহ তল্লাশি এবং কম্পিউটার, কম্পিউটার নেটওয়ার্ক, সার্ভার ও ডিজিটাল প্ল্যাটফর্ম-সংক্রান্ত সবকিছু জব্দ করার ক্ষেত্রে ক্ষমতা দেওয়া হয়েছে। পুলিশ এই ধরা বলে পরোয়ানা ছাড়াই সন্দেহবশত যেকোনো ব্যক্তিকে গ্রেপ্তার করতে পারে। এর মাধ্যমে পুলিশকে কার্যত ''বিচারিক ক্ষমতা'' দেওয়া হয়েছে, যা কোনোভাবে গ্রহণযোগ্য নয়। এই ধারাটিও যেহেতু বহাল থাকছে তাই নতুন সাইবার নিরাপত্তা আইনকে নতুন কিছু হিসেবে বিবেচনা করা যাচ্ছে না।'

'ডিজিটাল বা সাইবার মাধ্যমে সংঘটিত অপরাধের শাস্তি হোক, সেটা আমরাও চাই। কিন্তু প্রস্তাবিত সাইবার নিরাপত্তা আইনও যেন ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের মতো সংবাদমাধ্যমের স্বাধীনতা হরণের হাতিয়ারে পরিণত না হয়, সে জন্য এটি চূড়ান্ত করার আগে সংবাদমাধ্যমের অংশীজনদের সঙ্গে আলোচনা করা প্রয়োজন বলে মনে করি। যেহেতু সরকার ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনটি বাতিল করার নীতিগত সিদ্ধান্ত নিয়েছে, সেহেতু এই আইনে করা মামলাগুলোও প্রত্যাহার এবং এই আইনে যারা ইতিমধ্যে গ্রেপ্তার হয়েছেন এবং কারাভোগ করেছেন, তাদের মুক্তি দেওয়া হোক,' বিবৃতিতে উল্লেখ করেছে সম্পাদক পরিষদ।

Comments

The Daily Star  | English

Life insurers mired in irregularities

One-fourth of the life insurance firms in the country are plagued with financial irregularities and mismanagement that have put the entire industry in danger.

6h ago