উত্তর সিটি: বিটিআই ‘জালিয়াতি’, আমদানিকারক প্রতিষ্ঠান লাইসেন্সবিহীন

উত্তর সিটি: বিটিআই ‘জালিয়াতি’ আমদানিকারক প্রতিষ্ঠান লাইসেন্সবিহীন

ডেঙ্গুর প্রাদুর্ভাব ঠেকাতে এডিস মশার লার্ভা ধ্বংসে ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের (ডিএনসিসি) জন্য কেনা হয়েছে বহুল আলোচিত বিটিআই রাসায়নিক। কিন্তু এই রাসায়নিক সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠানের নেই আমদানি লাইসেন্স।

অথচ প্রতিষ্ঠানটি জৈব কীটনাশক ব্যাসিলাস থুরিনজেনসিস ইসরায়েলেনসিস বা বিটিআই সরবরাহের জন্য ডিএনসিসির উন্মুক্ত দরপত্রে অংশ নেয় এবং এই রাসায়নিক আমদানির জন্য সেরা দরদাতা নির্বাচিত হন।

টেন্ডার নথিতে স্পষ্টভাবে বলা ছিল, অবশ্যই মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, ইইউভুক্ত দেশ, সিঙ্গাপুর, ভারত বা মালয়েশিয়া থেকে বিটিআই আমদানি করতে হবে।

সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠানটি সিঙ্গাপুর থেকে বিটিআই কীটনাশক আমদানির দাবি করলেও, এই দাবি মিথ্যা বলে জানা গেছে। বরং আমদানি শুল্ক নথি থেকে জানা গেছে, ডিএনসিসির জন্য বিটিআই আমদানি করা হয়েছে চীনা কোম্পানি শানডং গ্যানন অ্যাগ্রোকেমিক্যাল থেকে।

এ ধরনের কীটনাশক আমদানির লাইসেন্স দেয় কৃষি বিভাগের উদ্ভিদ সুরক্ষা উইং (পিপিডব্লিউ)। ডিএনসিসি ও পিপিডব্লিউ—এই ২ কর্তৃপক্ষই নিশ্চিত করেছে, বিটিআই আমদানি করা প্রতিষ্ঠান মার্শাল অ্যাগ্রোভেট কেমিক্যাল ইন্ডাস্ট্রিজ লিমিটেডের এই লাইসেন্স নেই।

তবে দ্য ডেইলি স্টারের কাছে আসা এ সংক্রান্ত নথিপত্র যাচাই করে দেখা গেছে, মার্শাল অ্যাগ্রোর দাবি অনুযায়ী প্রতিষ্ঠানটি সিঙ্গাপুরের বেস্ট কেমিক্যাল কোম্পানি (এস) পিটি লিমিটেড (বেস্টকেম) থেকে ৫৩ লাখ টাকার বেশি মূল্যের ৫ টন বিটিআই আমদানি করেছে।

কিন্তু বেস্টকেমের ব্যবস্থাপনা পরিচালক জনি ওং বুধবার দ্য ডেইলি স্টারকে জানান, তারা মার্শাল আগ্রোভেট নামে কোনো প্রতিষ্ঠানের কাছে লার্ভা ধ্বংসকারী কীটনাশক বিক্রি করেনি।

চলতি সপ্তাহের শুরুতেই মার্শালের সিঙ্গাপুর থেকে বিটিআই আমদানির দাবি প্রত্যাখ্যান করে ফেসবুকে পোস্ট দেয় বেস্ট কেমিক্যাল।

সিঙ্গাপুর থেকে বিটিআই আমদানির ভুয়া দাবির খবর গণমাধ্যমে প্রকাশিত হলে ডিএনসিসি সোমবার মার্শাল অ্যাগ্রোভেটকে কারণ দর্শানোর নোটিশ জারি করে। নোটিশে আজ শুক্রবারের মধ্যে আমদানি করা বিটিআইয়ের উৎস জানতে চাওয়া হয়েছে।

গতকাল বৃহস্পতিবার পর্যন্ত মার্শাল অ্যাগ্রোভেট ডিএনসিসির চিঠির জবাব দেয়নি।

ডিএনসিসি কর্তৃপক্ষও ওই কীটনাশকের উৎস নিশ্চিত করতে পারেনি, যদিও মার্শালের সরবরাহকৃত বিটিআইয়ের বক্সের গায়ের লেবেলে লেখা আছে যে সেগুলো সিঙ্গাপুর থেকে এসেছে।

এ বিষয়ে জানতে চেয়ে মার্শাল অ্যাগ্রোভেটের নির্বাহী পরিচালক মো. নাসিরুদ্দিন আহমেদকে দ্য ডেইলি স্টারের পক্ষ থেকে গত ২ দিনে বেশ কয়েকবার ফোন দেওয়া হলেও এবং মেসেজ পাঠালেও কোনো জবাব পাওয়া যায়নি।

লাইসেন্স ছাড়াই কার্যাদেশ

ডেঙ্গু মোকাবিলায় এডিস মশার বংশবৃদ্ধি রোধ করতে বিটিআই সরবরাহ চেয়ে ডিএনসিসি কর্তৃপক্ষ গত ১১ এপ্রিল ই-টেন্ডার আহ্বান করে। দরপত্র জমা দেওয়ার শেষ তারিখ ছিল ৩ মে।

এর মধ্যেই ৩০ এপ্রিল ডিএনসিসির পক্ষ থেকে কৃষি বিভাগের পিপিডব্লিউ শাখাকে একটি অদ্ভুত চিঠি দেয়।

ডিএনসিসির উপসচিব রমেন্দ্র নাথ বিশ্বাসের সই করা এই চিঠিতে বলা হয়, নগর কর্তৃপক্ষ বিটিআই আমদানির পরিকল্পনা করছে, কিন্তু এর লাইসেন্স প্রক্রিয়া 'দীর্ঘ ও সময়সাপেক্ষ'। এ অবস্থায় আমাদের জানা দরকার যে আপনার সংস্থা (পিপিডব্লিউ) জনস্বাস্থ্য পণ্য হিসেবে এটি (বিটিআই) আমদানি করতে সেরা দরদাতাকে লাইসেন্স বা বিশেষ অনুমতি দিতে পারেন কি না।

টেন্ডার প্রক্রিয়া শেষ হওয়ার আগেই কেন এমন চিঠি দেওয়া হয়েছিল তা এখনো স্পষ্ট নয়। যেহেতু বেশ কিছু প্রতিষ্ঠানের ইতোমধ্যে এ ধরনের পণ্য আমদানির প্রয়োজনীয় লাইসেন্স আছে এবং তাদের এরকম বিশেষ অনুমতির কোনো প্রয়োজন নেই।

ডিএনসিসির চিঠির জবাবে ২ মে কৃষি বিভাগ জানায়, এর আগে কিছু কোম্পানিকে এ ধরনের লাইসেন্স দিয়েছে। কিন্তু তারা কোনো নাম প্রকাশ করেনি।

চিঠিতে আরও বলা যায়া, কীটনাশক আইন-২০১৮ অনুযায়ী বিটিআই আমদানির জন্য প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়া যেতে পারে।

এই আইনের অধীনে লাইসেন্স ছাড়া কেউ কীটনাশক আমদানি, উৎপাদন, প্যাকেজিং, নতুন করে প্যাকেজিং বা বিক্রি করতে পারবে না।

অথচ, যে ৩ প্রতিষ্ঠান শেষ পর্যন্ত দরপত্রে অংশ নিয়েছিল তাদের কারও লাইসেন্স ছিল না এবং তাদের মধ্যে মার্শাল অ্যাগ্রোভেট সর্বনিম্ন দরদাতা নির্বাচিত হয়। দরপত্র জমা দেওয়া অপর দুটি প্রতিষ্ঠান এমআর এন্টারপ্রাইজ ও প্রচেষ্টা।

জানতে চাইলে কৃষি বিভাগের পিপিডব্লিউ শাখার ভারপ্রাপ্ত পরিচালক মো. ফরিদুল হাসান দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, 'ডিএনসিসি কোনো প্রতিষ্ঠানের নাম উল্লেখ না করে লার্ভিসাইড (বিটিআই) আমদানির জন্য বিশেষ অনুমতি চেয়েছিল। পরে তারা একটি নির্দিষ্ট কোম্পানিকে আমদানির অনুমতি দেয়।'

গত বুধবার রাজধানীর খামারবাড়িতে তার কার্যালয়ে দেখা হলে তিনি বলেন, 'শুধু ইস্পাহানি ও প্রত্যাশা—এই ২ প্রতিষ্ঠানের বিটিআই আমদানির লাইসেন্স আছে। মার্শালের বিটিআই আমদানির লাইসেন্স নেই। আমি জানি না তারা কীভাবে এই কীটনাশক আমদানি করল।'

'এ ধরনের লাইসেন্স পাওয়ার প্রক্রিয়া শেষ হতে প্রায় ২ বছর সময় লেগে যায়। এর মধ্যে সরকারি ল্যাবরেটরিতে নমুনা পরীক্ষাও করা হয়ে থাকে,' যোগ করেন তিনি।

মো. ফরিদুল আরও জানান, মার্শালের আমদানি করা বিটিআই কীটনাশক 'নকল' বলে অভিযোগ ওঠার পর ডিএনসিসি কর্তৃপক্ষ সেগুলোর নমুনা পরীক্ষার তাদের কাছে পাঠিয়েছে।

১০ দিনের মধ্যে পরীক্ষা করে ডিএনসিসিকে প্রতিবেদন দেওয়া হবে বলে জানান তিনি।

আইনের  ব্যত্যয়

বিটিআই সরবরাহের এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে কীটতত্ত্ববিদ মঞ্জুর এ চৌধুরী দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, 'ডিএনসিসি কর্তৃপক্ষ ও মার্শাল আগ্রোভেট উভয়ই এ ক্ষেত্রে ২০১৮ সালের কীটনাশক আইনসহ বেশ কয়েকটি আইন লঙ্ঘন করেছে।'

বিটিআই ব্যবহার করে মশা নিধনে ডিএনসিসির অভিযানের কার্যকারিতা নিয়েও প্রশ্ন তোলেন তিনি।

তিনি বলেন, 'মার্শালের সরবরাহ করা বিটিআইয়ের প্যাকেটের লেবেলে লেখা আছে যে ড্রেন, গর্ত ও নর্দমায় প্রয়োগ করতে হবে। কিন্তু এসব জায়গায় এডিস মশা বংশবিস্তার করে না।'

এসব বিষয়ে জানতে ডিএনসিসি মেয়র মো. আতিকুল ইসলামের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি ডেইলি স্টারকে বলেন, 'আমাদের তদন্তে মার্শালের বিরুদ্ধে কোনো জালিয়াতির প্রমাণ পাওয়া গেলে তাদের বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা নেওয়া হবে।'

'যদি দেখি যে মার্শাল অ্যাগ্রো সিঙ্গাপুরের বেস্টকেম থেকে বিটিআই আমদানি করেনি, আমরা তাদের কালো তালিকাভুক্ত করব এবং তাদের বিরুদ্ধে অন্যান্য আইনি ব্যবস্থা নেব,' বলেন তিনি।

তবে, মার্শাল অ্যাগ্রোকে কার্যাদেশ দেওয়ার পক্ষেই অবস্থান মেয়র আতিকের।

তিনি বলেন, 'কৃষি বিভাগ আমাদের চিঠির জবাবে জানিয়েছে, আমরা বিটিআই আমদানি করতে পারি। তাই আমরা পাবলিক প্রকিউরমেন্ট বিধি অনুযায়ী মার্শাল অ্যাগ্রোর জন্য কার্যাদেশ জারি করি, যেহেতু টেন্ডারে সর্বনিম্ন দরদাতা ছিল এই প্রতিষ্ঠানটি।'

 

Comments

The Daily Star  | English
CAAB pilot licence irregularities Bangladesh

Regulator repeatedly ignored red flags

Time after time, the internal safety department of the Civil Aviation Authority of Bangladesh uncovered irregularities in pilot licencing and raised concerns about aviation safety, only to be overridden by the civil aviation’s higher authorities.

10h ago