অস্তিত্বহীন লেখকের লেখায় সরকারের প্রশংসা, এএফপির বিশ্লেষণ

২০২২ সালের সেপ্টেম্বরের দিকে বিভিন্ন অনলাইন পোর্টালে এমন বেশ কিছু লেখা দেখা যায়। ওই একই সময়ে বাংলাদেশের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় নেতিবাচক ‘প্রচারণা’ মোকাবিলায় ‘ভালো কলাম লেখকদের’ লেখার আহ্বান জানিয়েছিল।
ঢাকার রাস্তার পাশে দেয়ালে সাঁটানো পত্রিকা পড়ছেন পথচারীরা। ছবি: এএফপি

বাংলাদেশে বিভিন্ন সময়ে সরকারের বিভিন্ন কর্মকাণ্ডের প্রশংসা করে 'স্বাধীন বিশেষজ্ঞদের' অসংখ্য লেখা প্রকাশ হয়েছে জাতীয় ও আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমে। কিন্তু এসব লেখকদের পরিচয় ও অস্তিত্ব নিয়ে সন্দেহ তৈরি হয়েছে।

এসব লেখকদের অনেকে ভুয়া ছবি ব্যবহার করেছেন। এমনকি অনেক লেখকের অস্তিত্ব পর্যন্ত নেই বলে বার্তাসংস্থা এএফপির অনুসন্ধানে জানা গেছে।

বিশ্লেষকরা বলছেন, আগামী জানুয়ারিতে জাতীয় নির্বাচনের আগে 'অস্তিত্বহীন' লেখকদের এ ধরনের লেখা বাংলাদেশে ক্রমাগত বিভ্রান্তিকর প্রচারণার অংশ। একইসঙ্গে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সরকারকে সুবিধা দিতেই এসব অপপ্রচার চালানো হচ্ছে বলে মনে করছেন তারা।

চীনের রাষ্ট্রীয় বার্তাসংস্থা সিনহুয়া এবং এশিয়ার শীর্ষ গণমাধ্যমগুলোতে এসব লেখা প্রকাশিত হয়েছে। লেখায় ওয়াশিংটনভিত্তিক ফরেন পলিসি ম্যাগাজিনের দক্ষিণ এশিয়া ব্রিফের বরাতও দেওয়া হয়েছে। 

সমালোচনা বন্ধে ও ভিন্নমত দমনে বাংলাদেশে সরকারের বিভিন্ন কর্মকাণ্ডে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রসহ বিভিন্ন দেশ ও আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থা দীর্ঘদিন ধরেই উদ্বেগ জানিয়ে আসছে।

এএফপির বিশ্লেষণে দেখা গেছে, তথাকথিত বিশেষজ্ঞদের একটি নেটওয়ার্ক নিয়মিতভাবে বিভিন্ন গণমাধ্যমে মতামতজাতীয় লেখা প্রকাশ করে যাচ্ছেন। তাদের পরিচয় দেওয়া হচ্ছে বিশ্বের শীর্ষস্থানীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষাবিদ। এসব লেখায় লেখকের ভুয়া ছবি ব্যবহার করা হচ্ছে, খ্যাতিমান বিশ্লেষকদের নাম ব্যবহার করে মনগড়া উদ্ধৃতি দেওয়া হচ্ছে।

এ প্রসঙ্গে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের সাংবাদিকতা বিভাগের অধ্যাপক এ আল মামুন বলেন, 'এগুলো মানুষকে প্রভাবিত করার একটা চেষ্টা। লেখাগুলোতে মূলত বাংলাদেশের বর্তমান সরকারের পক্ষের বক্তব্যগুলো প্রচার করা হয়েছে।'

২০২২ সালের সেপ্টেম্বরের দিকে বিভিন্ন অনলাইন পোর্টালে এমন বেশ কিছু লেখা দেখা যায়। ওই একই সময়ে বাংলাদেশের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় নেতিবাচক 'প্রচারণা' মোকাবিলায় 'ভালো কলাম লেখকদের' লেখার আহ্বান জানিয়েছিল।

'অস্তিত্বহীন বিশেষজ্ঞের' বিষয়ে মন্তব্য জানতে বাংলাদেশের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ও তথ্য মন্ত্রণালয়ের শীর্ষ কর্মকর্তাদের এএফপির পক্ষ থেকে যোগাযোগ করা হলেও কোনো জবাব পাওয়া যায়নি।

পররাষ্ট্রমন্ত্রী এ কে আবদুল মোমেন এএফপিকে বলেছেন, মন্তব্য করার মতো 'যথেষ্ট সময়' তার নেই।

'অস্তিত্বহীন লেখক'

অন্তত ৬০টি দেশি ও বিদেশি সংবাদমাধ্যমে প্রকাশিত ৩৫ জনের নামে ৭০০টির বেশি লেখা বিশ্লেষণ করেছে এএফপি। এর সবগুলো গত বছর প্রথমবারের মতো অনলাইনে প্রকাশিত হয়েছিল। এগুলোতে বাংলাদেশ সরকারের বিভিন্ন কার্যক্রমকে ব্যাপকভাবে সমর্থন দেওয়া হয়েছে। এগুলোর কয়েকটি বাংলাদেশ সরকারের ওয়েবসাইটেও পোস্ট করা হয়।

বেশ কিছু লেখায় কট্টরভাবে চীনকে সমর্থন করা হয়েছে। বাংলাদেশে অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচনের প্রয়োজনীয়তার বিষয়ে ওয়াশিংটনের বিভিন্ন বক্তব্যের সমালোচনা করা হয়েছে এসব লেখায়।

এএফপি ওই ৩৫ লেখকের অস্তিত্ব খুঁজে পায়নি। এসব লেখা ছাড়া তাদের আর কোনো অনলাইন উপস্থিতিও খুঁজে পাওয়া যায়নি। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমেও তাদের কারো কোনো প্রোফাইল নেই। এমনকি কোনো একাডেমিক জার্নালেও তাদের কোনো গবেষণাপত্র প্রকাশ হয়নি।

৩৫ লেখকের মধ্যে অন্তত ১৭ জন নিজেদের এশিয়া ও পশ্চিমা বিশ্বের শীর্ষ বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট বলে দাবি করেছেন। কিন্তু বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে তাদের কোনো রেকর্ড খুঁজে পায়নি এএফপি।

এর মধ্যে ৯ জন লেখকের পরিচয়ে ৮টি শীর্ষ বিশ্ববিদ্যালয়ের উল্লেখ ছিল। বিশ্ববিদ্যালয়গুলো এসব লেখকের নাম পর্যন্ত শোনেনি বলে এএফপিকে নিশ্চিত করেছে।

বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর মধ্যে আছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ডেলাওয়্যার বিশ্ববিদ্যালয়, কানাডার ইউনিভার্সিটি অব টরন্টো, সুইজারল্যান্ডের ইউনিভার্সিটি অব লুসার্ন এবং ন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি অব সিঙ্গাপুর।

ভারতের জওহরলাল নেহরু ইউনিভার্সিটির সঙ্গে সংশ্লিষ্ট দাবি করা এক লেখক সম্পর্কে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ বলছে, 'আমরা আমাদের রেকর্ড পরীক্ষা করেছি। তার নাম খুঁজে পাইনি।'

লেখকদের অন্তত ৮ জনের ছবিও তাদের নিজের নয়। কেউ আবার নিজের ছবি হিসেবে ভারতের সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে জনপ্রিয় এক ফ্যাশন ইনফ্লুয়েন্সারের ছবি ব্যবহার করেছেন।

এএফপির বিশ্লেষণে এমনও দেখা গেছে যে একই লেখা ইংরেজি ও বাংলায় ভিন্ন ভিন্ন নামে প্রকাশিত হয়েছে।

এমনই এক লেখক ডরিন চৌধুরী। আপাতদৃষ্টিতে পরিশ্রমী কলামিস্ট হিসেবে অন্তত ৬০টি লেখায় তার নাম। তার লেখায় উঠে এসেছে বাংলাদেশ সরকারের প্রশংসা, চীনের সঙ্গে ক্রমবর্ধমান সম্পর্ক সমর্থন এবং 'মানবাধিকারের জন্য হুমকি' হিসেবে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের অবস্থান।

এই লেখকের ছবি হিসেবে ভারতের এক অভিনেতার ছবি ব্যবহার করা হয়েছে। পরিচয় দেওয়া হয়েছে নেদারল্যান্ডসের গ্রোনিনজেন বিশ্ববিদ্যালয়ের 'পলিটিক্স' বিষয়ের 'ডক্টরাল রিসার্চার'। কিন্তু বিশ্ববিদ্যালয়টি বলছে, তাদের রেকর্ডে এই পরিচয়ের কেউ নেই।

এএফপি এই লেখকের দেওয়া একটি ইমেইলে যোগাযোগ করলে উত্তর আসে, 'নিরাপত্তাজনিত উদ্বেগ এড়াতে ছদ্মনাম' ব্যবহার করা হয়েছে। আবার ইমেইলের উত্তরদাতা নিজের আসল পরিচয় দিতে এবং ভুয়া ছবি ব্যবহারের ব্যাখ্যা দিতেও অস্বীকৃতি জানিয়েছেন।

'সম্পূর্ণ বানোয়াট'

ফুমিকো ইয়ামাদাকে অস্ট্রেলিয়ার মেলবোর্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলাদেশ স্টাডিজের একজন বিশেষজ্ঞ হিসেবে পরিচয় করিয়ে দেওয়া হয়েছে।

তবে, এএফপির অনুসন্ধানে ওই বিশ্ববিদ্যালয়ে তার কোনো রেকর্ড খুঁজে পাওয়া যায়নি এবং ওই বিশ্ববিদ্যালয়ে 'বাংলাদেশ স্টাডিজ' নামে আলাদাভাবে কোনো গবেষণার ক্ষেত্র নেই।

ফুমিকো ইয়ামাদার লেখায় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার 'গুরুত্বপূর্ণ পরামর্শ'র প্রশংসা করা থেকে শুরু করে ওয়াশিংটনের 'অন্যদের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে ক্রমাগত হস্তক্ষেপের মাধ্যমে গণতন্ত্র ও মানবাধিকারের বিষয়ে দ্বৈত মানদণ্ড' তুলে ধরা হয়েছে।

অন্যান্য লেখায় পরিচিত বিশেষজ্ঞদের কিছু উদ্ধৃতি ব্যবহার হয়েছে। কিন্তু বিশেষজ্ঞরা বলছেন এসব উদ্ধৃতি তাদের নয়।

নেদারল্যান্ডসের ইন্টারন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব সোশ্যাল স্টাডিজের অধ্যাপক জেরার্ড ম্যাকার্থি জানান, পৃথ্বীরাজ চতুর্বেদীর বাইলাইনে লেখা মিয়ানমারের প্রতি 'পশ্চিমা দ্বিচারিতা'র নিন্দা করে একটি লেখায় তার নাম ব্যবহার করে 'সম্পূর্ণ বানোয়াট' বক্তব্য দেওয়া হয়েছে।

'অস্তিত্বহীন লেখকের' এসব লেখা যেসব সংবাদপত্রে প্রকাশিত হয়েছে, সেগুলোর সম্পাদকরা বলছেন, তারা লেখকদের শিক্ষাগত যোগ্যতা এবং অন্যান্য জায়গায় প্রকাশিত লেখা দেখে সরল বিশ্বাসে লেখা ছাপিয়েছেন।

বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডের ফিচার এডিটর মুবিন এস খান বলেন, 'আমরা তথ্যসূত্রের ওপর আস্থা রেখেছিলাম।'

ডেইলি নিউ এজ পত্রিকার সম্পাদক নুরুল কবির জানান, তাকে ২০২৩ সালের শুরুর দিকে বেশ কয়েকটি মতামত পাঠানো হয়েছিল। এর 'বেশিরভাগই ভারত, চীন ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে বাংলাদেশের সম্পর্ক' নিয়ে লেখা।

পরবর্তীতে তিনি সেগুলো প্রকাশ করেনি এই ভয়ে যে, এই 'ভাড়াটে লেখকদের' কোনো 'বিশেষ স্বার্থ' থাকতে পারে। কিন্তু এই লেখকরা যে অস্তিত্বহীন, সেটা জেনে তিনি বিস্মিত হন।

তিনি বলেন, 'এই ভুল তথ্য ছড়ানো ও অপপ্রচারের যুগে লেখকদের পরিচয় যাচাইয়ের বিষয়ে আমার আরেকটু সচেতন হওয়া উচিত ছিল।'

এএফপির ফ্যাক্টচেক সম্পাদক কদরউদ্দিন শিশিরের অনুসন্ধানী প্রতিবেদনের অনুবাদ

 

Comments

The Daily Star  | English
Effects of global warming on Dhaka's temperature rise

Dhaka getting hotter

Dhaka is now one of the fastest-warming cities in the world, as it has seen a staggering 97 percent rise in the number of days with temperature above 35 degrees Celsius over the last three decades.

10h ago