আল জাজিরার বিশ্লেষণ: গাজা যে কারণে ‘সম্পূর্ণ’ অবরুদ্ধ করে রেখেছে ইসরায়েল

উত্তর গাজায় বিমান হামলার পর অসংখ্য দালান ক্ষতিগ্রস্ত হয়। ছবি: রয়টার্স
উত্তর গাজায় বিমান হামলার পর অসংখ্য দালান ক্ষতিগ্রস্ত হয়। ছবি: রয়টার্স

সব দিক থেকে অবরুদ্ধ করে রেখে গাজায় গত প্রায় দুই সপ্তাহ ধরে চলছে ইসরায়েলের বোমা হামলা। এর মধ্যে গতকাল শনিবার দুটো ঘটনা ছিল উল্লেখযোগ্য। রাফাহ সীমান্ত দিয়ে ত্রাণবাহী গাড়ি ঢুকতে দেওয়া এবং দুই জিম্মিকে হামাসের মুক্তি।

তা সত্ত্বেও, গাজায় ইসরায়েলের হামলা অব্যাহত আছে। ইতোমধ্যে জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদে যুদ্ধ বন্ধের প্রস্তাবে ভেটো দিয়েছে যুক্তরাষ্ট্র। রাশিয়ার উদ্যোগে আবারও নিরাপত্তা পরিষদের বৈঠক হতে যাচ্ছে। কিন্তু এবারও যে যুক্তরাষ্ট্র ভেটো দেবে না, সে বিষয়ে কোনো নিশ্চয়তা নেই।

আল জাজিরার বিশ্লেষণে বলা হয়েছে, অবরুদ্ধ করে রেখে হামলা বহু পুরোনো সামরিক কৌশল।

এ সব ক্ষেত্রে হামলাকারী শুরুতেই প্রতিপক্ষের সব ধরনের যোগাযোগব্যবস্থা বন্ধ করে দেয়। সঙ্গে তাদের কাছে রসদ পৌঁছানোর সব রাস্তাও অবরুদ্ধ করে ফেলে। তারা আশা করে, জীবনধারণের অত্যাবশ্যক খাবার, পানি, জ্বালানিসহ অন্যান্য সেবা ও উপকরণের অভাব, রোগের প্রকোপ ও সার্বিকভাবে মনোবল হারিয়ে ফেলে প্রতিপক্ষের সেনাবাহিনী ও বেসামরিক ব্যক্তিরা হতোদ্যম হয়ে পড়বে এবং আত্মসমর্পণ করবে।

এখানে আরেকটি মনোভাব কাজ করে। যদি প্রতিপক্ষ দ্রুত আত্মসমর্পণ নাও করে, তবুও, দীর্ঘ সময় ধরে অবরোধ ও হামলা অব্যাহত রাখলে তাদের প্রতিরোধ ক্ষমতা ও পালটা হামলা চালানোর সক্ষমতা এক সময় ফুরিয়ে আসবে।

আগের দিনগুলোতে বেসামরিক ব্যক্তিদের হয় হামলাকারীদের হাতে মরতে হতো অথবা তাদের বন্দি, জিম্মি অথবা কৃতদাসের ভাগ্য বরণ করতে হতো। আজকের দিনে এ বিষয়গুলো গ্রহণযোগ্য না হলেও, যেকোনো সংঘাতে বেসামরিক ব্যক্তিদের চরম দুর্দশার মধ্য দিয়ে যেতে হয়।

এভাবে অবরুদ্ধ করে হামলা চালানোর বিষয়টি একইসঙ্গে নির্দয় ও নির্মম। এই কৌশলের মাধ্যমে মানুষকে ক্ষুধা, তৃষ্ণা, বিনা চিকিৎসায় অসুস্থ থাকা ও নানা ধরনের দুর্দশার মধ্য দিয়ে যেতে হয়। পানির সরবরাহ না থাকায় ন্যুনতম স্বাস্থ্য-সুরক্ষাও নিশ্চিত করা যায় না। যার ফলে কলেরা, ডায়রিয়া, পানিশুন্যতার মতো নানা রোগের প্রাদুর্ভাব দেখা দেয়।

গাজা উপত্যকাকে ১৬ বছরেরও বেশি সময় ধরে অবরুদ্ধ করে রাখা হয়েছে। তবে এতদিন পর্যন্ত এখানকার বাসিন্দাদের অন্তত জীবনধারণের মৌলিক চাহিদাগুলো পূরণ হচ্ছিল। ৭ অক্টোবর হামাসের হামলার পর ইসরায়েল গাজায় সব ধরনের পণ্য প্রবেশ বন্ধ করে দেয়। তারা একইসঙ্গে পানি ও বিদ্যুৎ সরবরাহও বিচ্ছিন্ন করে। গাজায় প্রবেশের সব পথ বন্ধ থাকায় সেখানে কোনো ধরনের মানবিক সহায়তা বা ত্রাণ পৌঁছাতে পারেনি। সঙ্গে ইসরায়েলের নির্বিচার বিমান হামলা ও উত্তর থেকে সরে দক্ষিণে চলে যাওয়ার নির্দেশে গাজার বাসিন্দারা নিরুপায় ও অসহায় অবস্থায় পড়েছেন।

গাজাবাসীদের জন্য ত্রাণসামগ্রী নিয়ে সীমান্ত খোলার অপেক্ষায় ট্রাক। ছবি: রয়টার্স
গাজাবাসীদের জন্য ত্রাণসামগ্রী নিয়ে সীমান্ত খোলার অপেক্ষায় ট্রাক। ছবি: রয়টার্স

এর অর্থ হচ্ছে, গাজার ২০ লাখেরও বেশি ফিলিস্তিনি এখন পুরোপুরি ত্রাণ সহায়তার ওপর নির্ভরশীল হয়ে পড়েছেন।

১৯৯০ সালে বসনিয়া ও আফগানিস্তানেও একই ধরনের হামলার ঘটনা ঘটে। কাবুলের হামলার খুঁটিনাটি পশ্চিমা গণমাধ্যমে খুব একটা উল্লেখ করা না হলেও, বসনিয়ার সারায়েভো শহরের বিরুদ্ধে সার্বদের হামলার বর্বরতা সারা বিশ্বকে নাড়া দিয়েছিল।

প্রায় চার বছর সার্বরা বসনিয়ার রাজধানী অবরুদ্ধ রেখে হামলা চালায়। সে সময় হামলা থামাতে কেউ উদ্যোগী না হলেও থেমে থাকেনি বৈশ্বিক ত্রাণ সহায়তা।

গড়ে একজন মানুষের বেঁচে থাকতে হলে দৈনিক প্রায় ২২০০ ক্যালোরি প্রয়োজন। বিশেষজ্ঞরা দাবি করেছেন, স্বল্প সময়ের জন্য প্রায় এক বা বড় জোর দুই মাস একজন মানুষ ১২০০ ক্যালরি পেয়ে বেঁচে থাকতে পারেন। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় জার্মান কনসেন্ট্রেশন ক্যাম্পের বন্দীদের দিনে ১০০০ ক্যালরি সমৃদ্ধ খাবার দেওয়া হতো।

বসনিয়ার মানুষ দৈনিক ৩০০ গ্রাম করে ত্রাণ পেয়েছিলেন এবং ক্যালরির পরিমাণ ছিল দৈনন্দিন চাহিদার অনেক কম। যারা স্নাইপারের গুলি ও বোমা হামলা এড়িয়ে প্রাণ বাঁচতে পেরেছিলেন, তারা রুগ্ন ও অসুস্থ অবস্থায় বাকি জীবন কাটান বা এখনো কাটাচ্ছেন।

পাশাপাশি, একজন মানুষের তৃষ্ণা মেটানো, রান্না, গোসল ও টয়লেটের জন্য দৈনিক ন্যুনতম পাঁচ লিটার পানি প্রয়োজন। বিশেষজ্ঞরা জানিয়েছেন, জরুরি পরিস্থিতিতে দেড় লিটার পানিতেও জীবনধারণ সম্ভব। তবে সে ক্ষেত্রে অনেক বুঝেশুনে চলতে হয়।

বসনিয়া হার্জেগোভিনার মানুষ পর্যাপ্ত নদ-নদী ও লেকের পানি ব্যবহার করতে পেরেছিল। কিন্তু গাজায় মিঠা পানির উৎস নেই বললেই চলে।

খাদ্য ও পানির মৌলিক চাহিদাকে মাথায় রেখে বলা যায়, গাজার ফিলিস্তিনিদের দৈনিক অন্তত দুই কেজি ত্রাণ প্রয়োজন। প্রায় ২০ লাখ মানুষের জন্য তা দাঁড়ায় দৈনিক চার হাজার টন। একটি ট্রাকে মাত্র ২০ টন পণ্য ধারণ করা সম্ভব।

রাফাহ সীমান্ত দিয়ে মিশরে প্রবেশের জন্য ওঅপেক্ষা করছেন ফিলিস্তিনিরা। ছবি: এএফপি
রাফাহ সীমান্ত দিয়ে মিশরে প্রবেশের জন্য ওঅপেক্ষা করছেন ফিলিস্তিনিরা। ছবি: এএফপি

অংকের হিসাবে বলা যায়, গাজার প্রতিদিনের চাহিদা পূরণে ট্রাক ভর্তি ত্রাণ পাঠানো হলে সেই ট্রাকগুলো অন্তত চার কিলোমিটার রাস্তা দখল করবে।

এ ছাড়া, এসব ত্রাণ ভুক্তভোগীদের কাছে পৌঁছানোও অনেকটা কষ্টের কাজ। বহির্বিশ্ব থেকে ত্রাণ অব্যাহত রাখতে একটি বন্দরকে শুধু এ কাজের জন্য নিয়োজিত রাখতে হবে এবং সেখানে দৈনিক দুই জাহাজ ভর্তি ত্রাণ পৌঁছাতে হবে। সৌভাগ্যবশত মিশর উপকূলে, রাফাহ থেকে মাত্র ৪০ কিলোমিটার দূরে সিনাই শহরে এ ধরনের একটি বন্দর রয়েছে।

উড়োজাহাজে করে কিছু জরুরি সামগ্রী নিয়ে আসা সম্ভব, কিন্তু তাতে গাজার বাসিন্দাদের সব চাহিদা পূরণ সম্ভব নয়। গাজা উপত্যকার একেবারে দক্ষিণে অবস্থিত গাজা বিমানবন্দর ২০০১ সালে ইসরায়েল ধ্বংস করে দেয়। তবে এর কাছাকাছি মিশরের দুইটি বিমানবন্দর আছে—আল-গোরাহ ও এল আরিশ।

এসব বিমানবন্দরে অসংখ্য মালবাহী উড়োজাহাজ অবতরণ করতে পারে, কিন্তু শুধু আকাশ পথে পরিবহনের ওপর ভরসা করে গাজাবাসীর ত্রাণ চাহিদা পূরণ হবে না। বসনিয়ায় দেখা গেছে, প্রতিটি ফ্লাইটে ১১ টন পণ্য আনা সম্ভব। সেক্ষেত্রে প্রতিদিন ৩৬০টি ফ্লাইট অবতরণ করলেই তবে ফিলিস্তিনিদের দৈনিক চাহিদা পূরণ হবে, তবে এটি বাস্তবসম্মত নয়।

এ ধরনের লজিস্টিক খুঁটিনাটি নিয়ে বিশ্লেষণের আগে যে বিষয়টি গুরুত্বপূর্ণ, তা হলো, গাজায় নিয়মিত ত্রাণ আদৌ পৌঁছানো যাবে কী না, সে বিষয়টি এখনো নিশ্চিত নয়। চলতি বন্দোবস্ত অনুযায়ী মাত্র ২০ ট্রাক ত্রাণ রাফাহ সীমান্ত পার হতে পেরেছে। যা একেবারেই অপ্রতুল।

Comments

The Daily Star  | English

JP central office vandalised, set ablaze

A group of unidentified people set fire to the central office of Jatiyo Party in Dhaka's Kakrail area this evening

48m ago