প্রতিমার বসনে শীতলপাটি, তাল-খেজুর পাতার অলংকার

মণ্ডপের সজ্জায় ব্যবহার করা হয়েছে বাঁশ, বেত, শখের হাড়ি ও মাটির সরাচিত্র। ছবি: স্টার

গ্রাম-বাংলার ঐতিহ্যবাহী শীতলপাটিতে প্রতিমার বসন, অলংকার হিসেবে ব্যবহার করা হয়েছে তাল ও খেজুর পাতা। মণ্ডপের সজ্জায় ব্যবহার করা হয়েছে বাঁশ, বেত, শখের হাড়ি ও মাটির সরাচিত্র।

হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের শারদীয় দুর্গাপূজা উপলক্ষে পরিবেশ রক্ষার বার্তা দিয়ে ভিন্নধর্মী এই আয়োজন করেছেন নারায়ণগঞ্জ শহরের শ্রী শ্রী গোপীনাথ জিউর আখড়া মন্দির কমিটি। প্রতিমা ও মণ্ডপের সজ্জায় সচেতনভাবেই রাখা হয়েছে আদিবাসী সাঁওতাল সংস্কৃতিরও ছাপ। যা নজর কেড়েছে দর্শনার্থীদের।

শীতলক্ষ্যা নদীর পাড়ে শহরের মিনাবাজার এলাকার অবস্থিত এ মন্দিরে এ বছর ৬৭তম দুর্গাপূজার আয়োজন করা হয়েছে। বিগত বছরগুলোতে মণ্ডপসজ্জায় পরিবেশ দূষণে ভূমিকা রাখা প্ল্যাস্টিকজাত বস্তুর ব্যবহার থাকলেও এবার তা বর্জনের সর্বোচ্চ চেষ্টা করেছেন বলে জানান আয়োজকরা। মণ্ডপের সজ্জায় এবার ব্যবহার করা হয়েছে বাঁশ, বেত, মাটির তৈরি সরাচিত্র, শখের হাড়ি, তাল ও খেজুর পাতাসহ বিভিন্ন প্রাকৃতিক উপাদান।

মন্দির কমিটির উপদেষ্টা ও নারায়ণগঞ্জ সাংস্কৃতিক জোটের সাবেক সভাপতি ভবানী শংকর রায় দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, 'প্রতিনিয়ত আমরা পরিবেশ দূষণ করছি। দুর্গাপূজা মণ্ডপের সজ্জাতেও প্ল্যাস্টিক, কর্কশিট, পলিথিনসহ অনেক কিছু ব্যবহার হয়, যা আমাদের পরিবেশের ক্ষতি করে। পরিবেশবান্ধব একটা কিছু করার চিন্তা থেকে এবার আমাদের ঐতিহ্যের বাঁশ, বেত, পাতা এইসব ব্যবহার করেছি।'

নারায়ণগঞ্জ চারুকলা ইনস্টিটিউটের প্রাক্তন ও বর্তমান কয়েকজন শিক্ষার্থী মিলে মণ্ডপ ও প্রতিমার সজ্জার কাজটি করেছেন। আট বছর ধরে দুর্গাপূজার মণ্ডপসজ্জার কাজের সঙ্গে জড়িত থাকলেও প্রাকৃতিক উপাদান ব্যবহার করে কাজ করতে দিয়ে ভিন্ন এক উপলব্ধির কথা জানান অভি কর নয়ন।

'প্রকৃতির সংস্পর্শে থেকে প্রাকৃতিক উপাদান দিয়েও যে সাজসজ্জার কাজ করা যায়, সেটাই আমরা তুলে ধরেছি। আদিবাসী সাঁওতালরাও প্রকৃতির সংস্পর্শে থেকে যুগের পর যুগ টিকে আছে। আমরা এই থিমটিকে সজ্জার মাধ্যমে ফুটিয়ে তোলার চেষ্টা করেছি। এই ব্যাপারটি আমার জন্যও নতুন উপলব্ধি। এখন থেকে যেই কাজগুলো করব, তা পরিবেশবান্ধবই করব বলে সিদ্ধান্ত নিয়েছি', বলেন অভি।

মণ্ডপের ব্যতিক্রমী এই সজ্জার প্রশংসা করছেন দর্শনার্থীরাও। তারা বলছেন, কৃত্রিমতা থেকে বেরিয়ে এসে প্রাকৃতিক উপাদান ব্যবহার করে একদিকে যেমন পরিবেশ দূষণ রোধে ভূমিকা রাখা যাচ্ছে, তেমনি বাঙালির ঐতিহ্য ও সংস্কৃতিরও উপস্থাপন হচ্ছে নতুন প্রজন্মের কাছে।

বন্ধুদের নিয়ে নারায়ণগঞ্জ শহরের বেশ কয়েকটি পূজা মণ্ডপ ঘুরেছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী জাহ্নবি নাহা জয়া। কৃত্রিম চাকচিক্যের মাঝে প্রাকৃতিক উপাদানে সাজানো গোপীনাথ জিউর আখড়া মন্দিরের মন্ডপটির সজ্জা মুগ্ধ করেছে তাকে।

দ্য ডেইলি স্টারকে এই শিক্ষার্থী বলেন, 'আধুনিকতা মানে যে সব সময় কৃত্রিমতা নয়, প্রাকৃতিক জিনিসপত্র ব্যবহার করেও বিশেষ করে শীতলপাটি ও পাতা দিয়ে মায়ের প্রতিমাকে এত সুন্দরভাবে সাজানো যায় তা এই মণ্ডপটি না ঘুরলে ধারণাতেও থাকতো না। এতে প্রতিমার সৌন্দর্যের কমতি তো হয়নি বরং আরও সুন্দরভাবে ফুটে উঠেছে। অন্যদেরও এই চর্চা করা উচিত।'

একই উপলব্ধির কথা জানালেন রাজশাহী প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী সুনীত মালাকার।

'নারায়ণগঞ্জে বরাবরই জাকজমকপূর্ণ পূজার আয়োজন করা হয়। তবে এবার মণ্ডপগুলোতে ভিন্ন ধরনের কিছু ব্যাপার আমরা দেখতে পেয়েছি। কয়েকটি মণ্ডপে সজ্জায় প্রাকৃতিক উপাদান ব্যবহার করা হয়েছে। আমরা যে কৃত্রিমতা থেকে বেরিয়ে আসছি এটা ভালো ব্যাপার। এই চর্চা আমাদের পরিবেশ দূষণ রোধে উদ্ধুদ্ধ করে', বলেন এই শিক্ষার্থী।

শুধু সজ্জার ক্ষেত্রে নয় এ মণ্ডপটিতে শব্দ ও আলোকসজ্জার ব্যাপারেও এবার সচেতনতা অবলম্বন করা হয়েছে বলে জানান আয়োজক কমিটির ভবানী শংকর রায়।

তিনি বলেন, 'আমরা অহেতুক চোখ ও কানের যন্ত্রণা যাতে না হয় সেজন্য আলো ও শব্দযন্ত্র ব্যবহারের ক্ষেত্রেও সচেতনতা অবলম্বন করেছি। পরিবেশ রক্ষার এই বার্তাটি আমরা ছড়িয়ে দিতে চাই, যাতে অন্যরা অনুসরণ করেন।'

নারায়ণগঞ্জে এ বছর ২২৪টি পূজামণ্ডপে দুর্গাপূজার আয়োজন করা হয়েছে।

 

Comments

The Daily Star  | English

The end of exemption?

TRIPS waiver end poses dual challenge: legal and technological

20h ago