মাইক্রোসফট ওয়ার্ডের ৪০ বছর
গত ২৫ অক্টোবর ছিল মাইক্রোসফট ওয়ার্ডের ৪০তম জন্মদিন। ১৯৮৩ সালের এই দিনে বিশ্বের অন্যতম জনপ্রিয় এই ওয়ার্ড প্রসেসিং সফটওয়্যারের যাত্রা শুরু হয়। গত চার দশকে এই সফটওয়্যার লেখালেখি ও যোগাযোগে বৈপ্লবিক পরিবর্তন এনেছে।
যে সময় এসেছে ওয়ার্ড
কম্পিউটার যুগের একেবারে শুরুর দিকে মাইক্রোসফট ওয়ার্ডের আগমন। মাত্রই মানুষ টাইপরাইটার ছেড়ে কম্পিউটারে ওয়ার্ড প্রসেসিংয়ের ধারণার সঙ্গে পরিচিত হচ্ছে। তারপর একে একে চলে গেছে ৪০ বছর।
আর কালের প্রভাবে এখন আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স (এআই) বা কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার যুগ। মাঝখানের দীর্ঘ এই সময়টায় অনেক কিছুই বদলে গেছে। পার্সোনাল কম্পিউটার খাতে ব্যাপক পরিবর্তন এসেছে, বিশ্বের প্রায় সর্বত্র মানুষ ইন্টারনেট ব্যবহার করতে পারছে আর এখন কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার মাধ্যমে মানুষ আরেকটি যুগান্তকারী পরিবর্তনের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে।
ওয়ার্ডের ৪০ বছর পূর্তি উপলক্ষে লেখা এক ব্লগ পোস্টে মাইক্রোসফট ১৯৮৩ সালকে এভাবে স্মরণ করেছে- সে বছরের সেরা সিনেমা ছিল জেমস বন্ডের স্পাই থ্রিলার 'নেভার সে নেভার এগেন', বছরের সেরা গান ছিল বনি টাইলারের 'টোটাল এক্লিপস অব দ্য হার্ট' এবং সেরা টিভি শো ছিল 'ডালাস'।
শের শাহর আমল না হলেও, তখন ১ গ্যালন গ্যাসের দাম ছিল ১ ডলার ৫৯ সেন্ট।
সে বছরই বাজারে আসে ছয় হাজার ডলার দামের অ্যাপলের পার্সোনাল কম্পিউটার (পিসি) লিসা।
জীবনের অবিচ্ছেদ্য অংশ হয়ে ওঠা
মাইক্রোসফট ওয়ার্ড দীর্ঘদিন ধরেই বহু মানুষের জীবনের অবিচ্ছেদ্য অংশ। এই সফটওয়্যার আমাদের জীবনের সঙ্গে এমনভাবে মিশে গেছে যে আমরা এখন আর এর প্রভাব সেভাবে লক্ষ্যও করি না।
শুরুতে এই সফটওয়্যারের নাম ছিল 'মাল্টি-টুল ওয়ার্ড'। এক পর্যায়ে বাজারে এ ধরনের প্রায় ৩০০ সফটওয়্যার পাওয়া যেত। বর্ষীয়ানরা হয়তো এখনো 'ওয়ার্ড পারফেক্ট' ও 'ওয়ার্ড স্টার' এর কথা মনে করতে পারবেন। তবে মাত্র এক দশকের মধ্যেই মাইক্রোসফট ওয়ার্ড সবাইকে ছাড়িয়ে যায়।
১৯৯৪ সালে মাইক্রোসফট ঘোষণা করে, ওয়ার্ড প্রসেসিং মার্কেটে তাদের শেয়ার ৯০ শতাংশ। সময়ের ধারাবাহিকতায় মাইক্রোসফট ওয়ার্ড ইতিহাসের অন্যতম সফল ও জনপ্রিয় সফটওয়্যারে পরিণত হয়।
বর্তমানে ঠিক কত সংখ্যক মানুষ এই সফটওয়্যারটি ব্যবহার করেন, তা নির্ণয় করাটা কঠিন। তবে প্রতি মাসে ১৪০ কোটি উইন্ডোজ ডিভাইস অন্তত একবার হলেও ব্যবহৃত হয় এবং ধরে নেওয়া যায়, এগুলোতে ওয়ার্ডের কোনো না কোনো ভার্সন কার্যকর আছে।
এ ছাড়া, বিশ্বের শীর্ষস্থানীয় ৫০০ বা 'ফরচুন ৫০০' প্রতিষ্ঠানের অর্ধেকের বেশি এই সফটওয়্যার ব্যবহার করে।
সহজ ডিজাইন ও বিশ্বস্ততা
অন্য সফটওয়্যারের তুলনায় জনপ্রিয়তা পেলেও ওয়ার্ড প্রসেসিং খাতের অনেক নতুন ও আধুনিক ফিচার ওয়ার্ড নয়, বরং অন্যান্য সফটওয়ার থেকে এসেছে।
গ্রামার চেকিং, ট্র্যাক চেঞ্জের মতো জনপ্রিয় কিছু ফিচার এসেছে অন্যান্য সফটওয়্যার থেকে।
শুরুতে নতুন নতুন ফিচার আনার দিক দিয়ে পিছিয়ে থাকলেও ওয়ার্ড জনপ্রিয় হয় এর সহজ ও স্মার্ট ডিজাইনের কারণে। ওয়ার্ডের একটি বড় সুবিধা হল, এটা মোটামুটি সবাই, খুব সহজেই ব্যবহার করতে পারে।
মাইক্রোসফট ওয়ার্ডই প্রথম লাইন ব্রেকস ফিচার চালু করে। বোল্ড ও ইটালিক ফন্টও তাদেরই আবিস্কার। ওয়ার্ড টেমপ্লেটও এসেছে মাইক্রোসফটের হাত ধরেই, যা যোগাযোগের ক্ষেত্রে এই সফটওয়্যারটির অবস্থানকে আরও সুদৃঢ় করেছিল।
সব মিলিয়ে, উপযোগী ফিচার ও স্থিতিশীল পারফরম্যান্স দিয়ে ব্যবহারকারীদের বিশ্বস্ত সঙ্গীতে পরিণত হয় ওয়ার্ড।
যোগাযোগের সার্বজনীন ভাষা 'ওয়ার্ড'
মাইক্রোসফটের ব্লগে দাবি করা হয়, ব্যবসা বাণিজ্য বিষয়ক যোগাযোগের ক্ষেত্রে মাইক্রোসফট ওয়ার্ডের রয়েছে একচ্ছত্র আধিপত্য।
ইমেইলের জন্য ভিন্ন সফটওয়্যার ব্যবহার করলেও, অনেকেই প্রথমে ওয়ার্ডে লিখে স্পেলিং ও গ্রামার চেক করে নেন।
বিশ্লেষকদের মত, ওয়ার্ডের কল্যাণে যোগাযোগের মাধ্যম হিসেবে ইংরেজি ভাষাও জনপ্রিয় হয়েছে। আজও ওয়ার্ডের স্পেলিং ও গ্রামার চেকিং টুলগুলো মূলত ইংরেজির জন্যই প্রযোজ্য।
মাইক্রোসফট ওয়ার্ডের ভুল বানান নির্দেশক (স্পেল চেকার) ও গ্রামার ফিচারগুলো কীভাবে পারস্পরিক যোগাযোগকে প্রভাবিত করেছে, সে বিষয়টি ব্যাখ্যা করতে যেয়ে ভাষাতত্ব বিশেষজ্ঞ নোয়েল ওলফ বলেন, সাদা চোখে স্পেল চেকার বা গ্রামার টুলগুলোকে তেমন গুরুত্বপূর্ণ মনে না হলেও, দীর্ঘমেয়াদে এগুলো লেখার ক্ষেত্রে 'নির্ভুলতা ও ধারাবাহিকতা' প্রতিষ্ঠার পরোক্ষ প্রচেষ্টা চালিয়ে থাকে। এর ইতিবাচক ও নেতিবাচক, দুইটি দিকই আছে।
ওলফ মত দেন, এক দিকে যেমন যেকোনো ভুল বানান বা ব্যাকরণকে লাল রঙে চিহ্নিত করে ওয়ার্ড আপনার লেখাকে আরও উপযোগী করছে, অপরদিকে এ বিষয়গুলোর দিকে বাড়তি নজর রাখতে যেয়ে অনেকেই হারাচ্ছেন লেখালেখির ক্ষেত্রে তাদের স্বকীয় ধারা।
ওয়ার্ডে লেখার ক্ষেত্রে অটোকারেক্ট বা ভুল শব্দ স্বয়ংক্রিয়ভাবে সংশোধনের ফিচার খুবই গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে। আগে নির্দিষ্ট শব্দের ভুল সংশোধন করতে হতো। তবে এখন ওয়ার্ড স্বয়ংক্রিয়ভাবে ভুল শব্দটি চিহ্নিত করে এবং সংশোধন করে। তবে এই অটোকারেক্ট ফিচারটি কিন্তু আপনার লেখার ধরন অনুসারে সংশোধিত শব্দের পরামর্শ দেয় না, বরং কোন প্রেক্ষাপটে কোন শব্দের ক্ষেত্রে কোন অটোকারেক্ট সাজেশন আসবে, সেটি মাইক্রোসফট ওয়ার্ডের অ্যালগরিদমেই উল্লেখ করা আছে। অর্থাৎ, মাইক্রোসফট আপনাকে যে শব্দের অটোকারেক্ট দেখায়, আরও কোটি কোটি ব্যবহারকারীকেও একই অটোকারেক্ট দেখায়। আপনার কাছে নির্দোষ মনে হতে পারে, তবে ওয়ার্ড কীভাবে ইংরেজি ভাষার মানদণ্ড প্রতিষ্ঠা করতে সহায়তা করেছে, এটি তার আরেকটি উদাহরণ।
মানুষের যোগাযোগের ক্ষমতা ও বৈচিত্র্য
মাইক্রোসফট ওয়ার্ড অসংখ্য মানুষকে যোগাযোগের ক্ষমতা দিয়েছে এবং যোগাযোগ খাতে বৈচিত্র্য সৃষ্টি করতে পেরেছে। ওয়ার্ড এখন দৈনন্দিন জীবনের অংশ হওয়ায় মানুষ আরও সহজে নতুন কিছু লিখতে বা সৃষ্টি করতে পারছেন। ফলে বিভিন্ন খাতের মানুষের কথা জানতে পারছি আমরা। ২০১৮ সালে মাইক্রোসফট ভয়েসের মাধ্যমে টাইপের ফিচার চালু করে, ফলে যাদের টাইপ করতে অসুবিধা হয়, তারা ভয়েস কমান্ডের মাধ্যমেই টাইপ করতে পারছেন।
শুরুর দিকে মাইক্রোসফট ওয়ার্ডের মতো সফটওয়্যারগুলোর সাহায্যে আরও ভালো প্রবন্ধ লেখা যায়, এমনটা প্রচার করা হয়েছিল। ১৯৯২ সালে করা একটি গবেষণায় দেখা গেছে, ওয়ার্ড প্রসেসরের মাধ্যমে লেখা প্রবন্ধগুলো হাতে লেখা প্রবন্ধগুলোর চেয়ে 'উল্লেখযোগ্যভাবে ভালো'। এসব সফটওয়্যারের মাধ্যমে কোনো কিছু লিখলে তা যেকোনো সময় আরও পরিবর্তন ও পরিবর্ধনের সুযোগ থাকে, যার ফলে লেখার মানও ক্রমান্বয়ে উন্নত হয়।
বর্তমানে আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স (এআই) বা কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার জোয়ার চলছে। মাইক্রোসফট ওয়ার্ডের মতো সফটওয়্যারগুলোতেও এআই যুক্ত হচ্ছে, ফলে এর কার্যকারিতা বহুগুণ বৃদ্ধি পাচ্ছে। তবে ওয়ার্ডে এআই যুক্ত করা উচিত হবে কিনা, তা নিয়ে অনেকেই দ্বিধাবিভক্ত। কেউ বলছে, বানান ভুল, বাক্য গঠন কিংবা এ ধরনের কাজগুলো যদি এআই'র মাধ্যমে করা যায়, তাহলে মানুষ অন্য সৃজনশীল কাজগুলোর দিকে আরও বেশি মনোযোগী হতে পারবে। তাছাড়া এআই খুব দ্রুত একজন লেখকের লেখার ধরন বুঝতে পারবে এবং সে অনুযায়ী তাকে বিভিন্ন শব্দ বা বাক্য সম্পর্কে পরামর্শ দিতে পারবে।
তবে এআই'র উপর অতিরিক্ত নির্ভরশীলতার ফলে মানুষের নতুন কিছু শেখা, লেখা ও ভাষাগত উন্নতির আগ্রহ চলে যেতে পারে বলেও শঙ্কা আছে।
সূত্র: বিবিসি, মাইক্রোসফট, দ্য ভার্জ
Comments